গল্পঃ দুর্ভোগ

রাত বারটা ঘরে শুয়ে শুয়ে ফেসবুক চালাচ্ছি হঠাৎই মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো৷ এত রাতে কে কল করলো? তাকিয়ে দেখি আননোন নাম্বার৷ রিসিভ করে কানে ঠেকাতে ঐপাশ থেকে নারীকন্ঠ ভেসে আসলো “আমি মারিয়া, আমার মোবাইলটা তিন দিন আগে চুরি হয়ে গেছে বলে তোমাকে কল দিতে পারিনি৷ আজকে আম্মুর নাম্বারর থেকে কল দিলাম৷ প্লিজ লক্ষ্মীটি রাগ করোনা৷ তোমাকে না আজকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে৷ তুমি কি প্লিজ বগুড়া আসবে? প্লিজ এখনি চলে আসোনা লক্ষ্মীটি৷
ঐযে আম্মু মোবাইলের জন্য ডাকছে, রাখি এখন তুমি এলে কথা হবে”৷ আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে দিলো৷ মারিয়া আমাকে ডাকছে আর আমি যাবোনা? আমি কি সেই নরাধম পুরুষ নাকি যে নারীর ডাক উপেক্ষা করবে? আমি জটপট ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে রওনা দিলাম৷ দারোয়ান ব্যাটা গেটে তালা লাগিয়ে তার রুমে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, অনেক ডাকাডাকির পরও খুলছে না৷ শেষে বললাম কাকা গেট খোলেন পাঁচশো টাকা দেবো৷ বলতেই না বলতেই আলিবাবার চিচিং ফাকের মতই ভোজবাজির মতই গেটটা খুলে গেলো৷ ব্যাটা এতক্ষণ ঘুমের ভাঁন করছিলো, টাকার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠেছে৷ কি আর করা এত কষ্টের টাকা থেকে কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম৷
গাবতলি এসে দেখি এত রাতে কোন বাস নেই! এখন আমি কি করি? সমাধানের আশায় এদিক ওদিক ঘুরছি তখন দাড়ি টুপিওয়ালা একজন বয়স্কলোক এসে জিজ্ঞেস করলো “বাবা তুই কই যাইবি?” অপরিচিত মানুষের মুখে তুই-তুকারি শুনতে বিশ্রী খারাপ লাগে৷ তবে লোকটার ডাকার ভঙ্গিটা অবজ্ঞাসূচক নয় বরং আপনসূচক বলে খারাপ লাগলো না৷
বললাম “চাচা বগুড়া যাবো, কিন্তু কোন বাসই তো নেই”৷ চাচা বললেন “বাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারি তবে তার জন্য এক হাজার টাকা লাগবে”৷ বললাম “চাচা অত টাকা তো সাথে নেই, গাড়ি ভাড়া বাদে আপনাকে পাঁচশো দিতে পারি”৷ চাচা বললেন “অন্য কেউ বললে রাজি হতাম না, কিন্তু তোকে দেখে আমার মৃত ছেলেটার কথা মনে পরলো, তাই রাজি হলাম”৷ টাকা পেয়ে চাচা একটা বাস দেখিয়ে দিলো বললো “এটা ঘন্টাখানেক পর বগুড়া যাবে, তুই ভিতরে বসে থাক”৷ আমি বরাবরই সহজ সরল মানুষ তাই উনার কথা মত ভিতরে ঢুকে বসে থাকলাম৷ এক ঘন্টার জায়গায় দুই তিন ঘন্টা হয়ে গেলো কিন্তু কারও আসার নাম নেই৷ আর সব বোকাদের মতই আমি অনেক দেরিতে টের পেলাম যে আমাকে আসলে ঠকানো হয়েছে৷ তবুও বাঁচোয়া যে ইমানদার বেইমানের পাল্লায় পরেছি, ফার্ষ্টক্লাশ বাটপারের পাল্লায় পরলে সবই তো নিয়ে যেতো৷
রাত তখন সাড়ে তিনটা বাজে, বাস থেকে নেমে হাটাহাটি করছি, ঠিক তখনই একটা প্রাইভেটকার এসে আমার সামনে থামলো৷ ভিতর থেকে একজন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলো “আপনি কোথায় যাবেন?” বললাম “আমি বগুড়া যাবো”৷ লোকটা বললো “আরে তাই নাকি! আমরাও তো বগুড়া যাচ্ছি, এত রাতে আপনাকে তো রাস্তায় ফেলে যেতে পারিনা৷ উঠে পরুন বগুড়ায় নামিয়ে দেবো”৷
কে বলেছে দেশে মানবতা নেই? দেশে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে যারা অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয়৷ এই ভদ্রলোকগুলোই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ৷ কিছু দুর এসে গাড়ির সবাই আমাকে চেপে ধরলো৷ একজন মুখ চেপে ধরায় চিৎকারও করতে পারলাম না৷ তারা আমার মোবাইল, মানিব্যাগ, হাতঘড়ি সব কেড়ে নিলো৷ অতঃপর অত্যান্ত সম্মানের সহীত পাছায় লাথি মেরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে সাঁ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো৷
নির্ঝন রাস্তায় এই শীতে একা একা দাড়িয়ে কাঁপছি৷ কোন দিক যাবো সেটাও জানা নেই৷ আর ঘন্টাখানেক পরই ভোর হয়ে যাবে, যদিও কিভাবে বাসায় ফিরবো সেটা নিয়ে টেনশন হচ্ছে৷ তবুও দিনের বেলা কোন না কোন ভাবে একটা ব্যবস্থা হবেই, আমি কিছুতেই হতাশ হওয়ার মানুষ না৷ আমি মনে মনে এসব ভাবছি তখনই আমার পাশে একটা মটরসাইকেল থামলো৷ মটরসাইকেলের আরোহীর চেহারা দেখে আন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো৷ চিকন চাকন ঢ্যাঙ্গা, খাঁটো, চেহারা দেখলেই মনে হয় গাঁজাখোর৷
আমি বুঝতে পারলাম মানুষ কেন আমাকে দেখলে বাঁজে মানুষ ভাবে৷ লোকটা জিজ্ঞেস করলো আমার সমস্যা কি, আমি কেন এত রাতে এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছি? সত্যি কথা বললে লোকটা বুঝবে আমার কাছে নেওয়ার মত কিছু নেই, তাই ছিনতাইয়ের ঘটনা খুঁলে বললাম৷ শুনে লোকটা বললো যদিও আমি বগুড়া যেতাম না, তার একটু আগেই আমার বাড়ি৷ কিন্তু বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করা মানুষেরই কর্তব্য৷ আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমার মতই ভদ্রলোক, চলুন আপনাকে বগুড়া নামিয়ে দিয়ে আসি৷
আমাকে লোকটা কোথায় না কোথায় নিয়ে যায়, শেষে কিডনি খুলে বেচে দেয় কিনা কে জানে? ঘরপোঁড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়৷ ভয়ে আমি না না করলাম৷ কিন্তু লোকটার অতিরিক্ত পিড়াপিড়িতে রিস্ক নিবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম৷
লোকটা আমাকে বগুড়া নামিয়ে দিলো, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের এক হাজার টাকাও দিলো! তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললো “আমার নাম্বারটা রাখুন, নাম্বারটাতে বিকাশ করা আছে, যদি কখনো পারেন টাকাটা শোধ করে দিয়েন৷ টাকা ছাড়া তো আর আপনি ঢাকা ফিরতে পারবেন না”৷ আমি উপলব্ধি করলাম মানুষের চেহারা দেখে তাকে জাজ করা উচিৎ না৷ লোকটা জিজ্ঞাসা করলো “আপনি বগুড়া কার কাছে যাবেন?” বললাম “আমি এসেছি মারিয়ার সাথে দেখা করতে”৷ লোকটা বললো “ওহ আচ্ছা, তা এই মারিয়াটা কে? আপনার কি হয়?” প্রশ্নটা তখন আমার মাথায়ও ঘুরতে লাগলো, “আসলেই এই মারিয়াটা আসলে কে?”
No comments