মায়াবতী । পর্ব - ০১
ফুটপাতের রাস্তার মোড়ে একাকী শুয়ে ছিল নিশু।
এদিকে নিশু অগ্রাহ্য করছে দেখে মেয়েটি রাতে ফুসতে থাকে।
কিন্তু মেয়েটি জানে, এখানে রাগ দেখালে উল্টো নিজেই বিপদে পড়ে যাবে।
শোয়া থেকে ওঠে বসল নিশু। এবার আড়চোখে নয়।
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল নিশু। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর ওর জানা নেই। তাই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল – ” কে আপনি? আর এত রাতে এখানে কী করছেন?”
- সেসব আমি পরে বলব। আগে বল তোমাকে কিডন্যাপ করলে মুক্তিপণ হিসেবে কত টাকা পাওয়া যাবে তোমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে?”
- আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আপনি? নাহলে আমি কিছুই বলব না। তাছাড়া আপনার সাথে কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না আমার। আপনি নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।”
নিশু এইসব ভাবছিল। হঠাৎ এক মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনে মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা বলল – ” কোনো কারণে কী তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছ না?”
- ঠিক তেমনটা নয়। আসলে আমি সবার সাথে কথা বলি না। আপনি যদি আমার সমবয়সী হতেন। তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলতাম। শুধু কথা না৷ আপনার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতাম। কিন্তু আপনি তো অনেক বড়।”
মেয়েটার এবার নড়ে-চড়ে বসল। এরপর জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে নিশুর দিকে তাকিয়ে বলল – ” বড়দের সাথে কী কথা বলা যায় না? তাদের সাথে কী ভাব জমানো যায় না?”
- আপনার সাথে কথা বলে আমার কোনো লাভ নেই। আমার বয়সী কোনো মেয়ে হলে, আমি তার সাথে কথা বলতাম। জানেন, আমার একটা স্বপ্ন আছে। স্বপ্নটা অন্যদের কাছে আহামরি কিছু না হলে-ও আমার কাছে বিশাল কিছু।”
- কী স্বপ্ন
- আজ নয়৷ কোনো একদিন চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানাবো। আমি নিশ্চিত, পৃথিবীর কোনো এক প্রান্ত থেকে আমার স্বপ্নের কথাটা আপনি শুনতে পারবেন।”
নিশুর কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো মেয়েটা। নিশু জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালে মেয়েটা সাথে সাথে হাসি থামিয়ে বলল – ” রাগ করো না প্লিজ। হঠাৎ করে হাসি এসে গেল। তাই না হেসে আর পারলাম না।”
নিশু প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। আবারও শুয়ে পড়ল সেখানেই।মেয়েটা মৃদু হাসি দিয়ে বলল – ” আমার প্রশ্নের উত্তর পেলেই ওঠে যাবো আমি।”
- কোন প্রশ্ন?
- এই যে, তোমাকে কিডন্যাপ করলে মুক্তিপণ হিসেবে কত টাকা পাওয়া যাবে তোমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে?”
নিশু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল – ” আপনি আমাকে কিডন্যাপ করবেন?”
- তোমাকে অলরেডি কিডন্যাপ করে ফেলেছি আমি।”
- কীভাবে?”
- সেভাবে উৎসব করে কিডন্যাপ করিনি। তবে তুমি আমার পাশে বসে আছ এখন। এর মানে হলো, তুমি আমার কাছে বন্দী। এখন আমি তোমার বাবা-মাকে ফোন করে মুক্তিপণ চাইবো। কিন্তু কত টাকা চাইবো, সেটাই বুঝতে পারছি না। তাই জিজ্ঞেস করছি তোমার বাবা-মায়ের কাছে মুক্তিপণ চাইলে কত টাকা পাওয়া যাবে?”
- তাই নাকি? তা আপনার কত টাকা লাগবে?”
- আপাতত ৫ লাখ হলেই হয়ে যাবে।”
নিশু বড় করে ঢোক গিলে বলল – ” এত টাকা! তবুও বলছেন আপাতত। মানে এরপর আরো টাকা লাগবে আপনার?”
- প্রয়োজন হলে তো অবশ্যই লাগবে।
- কিন্তু আপনি এত টাকা দিয়ে কী করবেন?
মেয়েটা এদিক-ওদিক একবার তাকালো। এরপর নিশুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল – ” আমার বয়ফ্রেন্ড কে দিবো।”
এবার বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল নিশু। সাথে সাথে মেয়েটা-ও ওঠে দাঁড়াল। মেয়েটার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিশু বলল – ” আপনি খুব সন্দেহজনক একজন মানুষ। এতক্ষণ ভেবেছিলাম হয়তো কোনো বিপদে পড়ে আমার এখানে এসেছেন। এরপর আমার মতো সহজ-সরল একটা ছেলে পেয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু এখন দেখছি আপনার ধান্দাটা-ই অন্যরকম।”
নিশুর হঠাৎ রাগান্বিত চেহারা আর কণ্ঠস্বর দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেল মেয়েটা।নিশুর কথা শুনে মেয়েটা ভরসা না পেলেও ভয় কিছুটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা দু’জনের মাঝে। হঠাৎ মেয়েটা বলল – ” তুমি কী সারারাত এখানেই থাকবে? বাড়িতে যাবে না? তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।”
- বাড়ি থাকলে তো যাবো। আমার কোনো বাড়ি-ঘর নেই। আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করার-ও কেউ নেই। আগে অবশ্য আমাকে নিয়ে চিন্তা করার জন্য মা ছিল। কিন্তু তিনি এখন আর বেঁচে নেই। সারাদিনে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াই। কখনো টুকটাক কাজ করি অবশ্য। আর রাত হলেই এই ফুটপাতে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। বলতে পারেন আমি একজন পথ শিশু। তবে আমি এখনো শিশু নই। শিশুর বয়সটা পেড়িয়ে গেছে আমার। তাই পথশিশু না বলে পথবাসী বললেই ভালো মানাবে।”
নিশুর কথা শুনে মেয়েটার চোখ দু’টো বিশাল আকার হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যেই। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল – ” যার টাকা-পয়সা তো দূরে থাক, পিছুটান বলে-ও কিছুই নেই। তাকেই কিনা কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ চাওয়ার কথা ভাবছি আমি। সায়েম ঠিকই বলে আমার সম্পর্কে। আমি আসলেই গ্রামের ক্ষ্যাত একটা মেয়ে। যার কোনো রুচিবোধ কিংবা ব্যক্তিত্ব বলে কিছুই নেই। যে শুধুমাত্র বোকামিই করতে পারে। গ্রামের এক গরীব কৃষক বাবার সন্তান ব্যতীত নিজের কোনো পরিচয়ই নেই আমার।”
মেয়েটা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশুর দিকে।মেয়েটার চোখের জল নিশুর দৃষ্টি আড়াতে পারেনি। নিশু বলল
মেয়েটা কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল
খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।”
নিশু মেয়েটার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
মেয়েটি আর একটুও অপেক্ষা করল না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিশুকে। কিন্তু আশ্চর্য! চোখ দিয়ে এক ফোঁটা-ও জল বেরোচ্ছে না। খুব যে ইচ্ছে করছে দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে কাঁদতে। কিন্তু এবার-ও ব্যর্থ হলো মেয়েটি।
- ” আচ্ছা, এই একটা মাত্র জীবনে কী আমি কখনোই সফলতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারব না?”
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল মেয়েটি। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। এভাবেই কিছুক্ষণ সময় অতিক্রম হওয়ার পর ওরা একে অপরকে ছেড়ে দিলো। নিশু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল – ” আপনার নামটা কী?”
- ” এই এক জীবনে মানুষ একেক সময় একেকটা চরিত্র নিয়ে হাজির হয়। আমার জীবনে শুধুমাত্র ব্যর্থতা এসেছে। কখনোই সফল হতে পারিনি আমি।”
- ” আগে পারেননি তো কী হয়েছে? এখন থেকে আপনার নতুন একটা চরিত্র শুরু হলো। নিজে নিজে ভাবুন যে, আপনার ব্যর্থতার চরিত্র শেষ। নতুন ভাবে আপনি জীবনে সফলতা নিয়ে আসুন।”
- ” আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। দেখলে না? একটু আগে যখন আমি চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করলাম। তখন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চোখ দিয়ে জল পড়েছে। আর যখন তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাইলাম, তখন আর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল-ও বের হয়নি। আমার জীবনটাই অভিশপ্ত। ব্যর্থতার ভরপুর আমার জীবন।”
- ” আল্লাহ সবাইকেই কিছু একটা দিয়ে পাঠান। কারোর জীবন’ই পুরোপুরি ব্যর্থতায় ডুবে নেই। একসময় না একসময় সফলতা আসবেই।”
- ” তোমরা বয়সটা খুব বেশি না
হলে-ও তুমি চমৎকার একজন মানুষ। আচ্ছা, নামটা তুমিই ঠিক করে দাও তাহলে।” - “আপনার মাঝে মায়া আছে খুব। আল্লাহ এই একটা জিনিস আপনার মাঝে খুব করে দিয়েছেন। তাই আপনার নাম হবে মায়াবতী। আমার মায়াবতী আপু। ছোট করে বললে শুধু মায়া আপু।”
মৃদু হাসি দিয়ে মেয়েটা বলল – ” ঠিক আছে৷ তোমার যেই নামে ডাকতে ইচ্ছে করে, তুমি সেই নামেই ডেকো। কিন্তু তোমার নাম কী?”
- ” আমার নাম নিশু।”
মায়া তখন আর কিছু বলল না৷ নিশু আবার শুয়ে পড়ল সেখানেই। নিশুর দেখাদেখি মায়া ও শুয়ে পড়ল নিশুর পাশে। এদিকে সময় তার নিজ গতিতে চলে যাচ্ছে। চাঁদের আবছায়া আলোটা মধ্যরাত থেকে আস্তে আস্তে ভোর রাত্রির দিকে ছুটে চলেছে। ঢাকা শহরের ফুটপাতে পাশাপাশি শুয়ে আছে নিশু আর মায়া। দু’জনের দৃষ্টি আকাশের দিকে থাকলেও ওদের কথোপকথন বেশ জমে উঠেছে। রাতটা এভাবেই পেড়িয়ে গেল।
২.
ভোরের আলো ফুটতেই নিশু বলল – ” আপনি এবার বাড়িতে ফিরে যান।”
- ” আমি বাড়িতে যেতে পারব না। এটা আর কখনোই সম্ভব হবে না।”
- ” তাহলে আপনি থাকবেন কোথায়? আর আপনার সেই বয়ফ্রেন্ড কোথায়? যাকে টাকা দেওয়ার জন্য আপনি মধ্যরাতে আমাকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণের কথা ভাবছিলেন?”
- ” আমি জানি না সে কোথায় আছে এখন। তবে সে বলেছে, যেদিন আমি ৫ লক্ষ্য টাকা জোগাড় করতে পারব, সেদিন সে ফিরে আসবে আমার কাছে।”
- ” সে কেমন বয়ফ্রেন্ড আপনার? যে টাকার জন্য রাতেরবেলা নিজের ভালোবাসার মানুষকে একা ছেড়ে চলে যায়।”
মায়া নিশ্চুপ। এর উত্তর ওর জানা নেই। নিশু আবারও বলল – ” তিনি আপনার কাছে এত টাকা কেন চাইলেন? তিনি কী জানেন না যে, আপনার কাছে এত টাকা নেই?”
- ” ও সবই জানে। আসলে আমিই হুয় বাড়ি থেকে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম ওর সাথে থাকব। কিন্তু ও আমাকে গ্রহণ করল না। ও বলল, যেখানে আমি নিজের খরচই চালাতে পারি না। সেখানে তোমার খরচ কীভাবে চালাবো আমি? তুমি বাড়ি থেকে কিছুই নিয়ে আসোনি সাথে করে। এখন কী করব আমি?
তখন আমি বললাম, আমি যে আর বাড়িতে যেতে পারব না। সেই রাস্তা আমি নিজেই বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। তুমি ছাড়া এখন আর কেউ নেই আমার। ও তখন রেগে গিয়ে আমাকে বলল, তাহলে নিজের রাস্তা নিজেই দেখ। নাহলে কোনোভাবে ৫ লক্ষ্য টাকার ব্যবস্থা কর। তারপর আমার কাছ এসো আবার। তখন আমি তোমাকে নিজের সাথে নিয়ে যাবো।”
মায়াকে থামিয়ে দিয়ে নিশু বলল – ” সে-জন্যই কী আপনি আর কোনো কিছু চিন্তা না করে আমাকে কিডন্যাপ করার কথা ভেবেছিলেন?”
মায়া মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিশু আবার বলল – ” এরপর কী হয়েছিল? মানে সত্যিই কী আপনার বয়ফ্রেন্ড আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে?”
মায়া এবার-ও মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলল। নিশু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল – “আপনার কাছে কী চার – পাঁচ’শ টাকা হবে?”
চোখের জল মুছতে মুছতে মায়া বলল- ” হুম। জমানো কিছু টাকা সাথে নিয়ে এসেছিলাম আমি।”
- ” তাহলে আমার সাথে আসুন।”
মায়া নিশুর পাশে দাঁড়াল। নিশু এদিক-ওদিক একবার তাকিয়ে সামনের দিকে যেতে শুরু করল। মায়া-ও তাই করল। নিশুর পিছু পিছু যেতে যেতে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়ল মায়া। মায়া তখন নিশুর দিকে তাকিয়ে বলল – ” আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তুমি? কেন জানি তোমাকে খুব ভয় করছে এখন।”
নিশু থেমে গেল। মায়ার কাছে এসে মায়ার একটা হাত ধরল। মায়া ঘাবড়ে গিয়ে সামনে-পিছনে তাকালো একবার। কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার নিশুর দিকে তাকালো। তবে এবারের দৃষ্টিতে আর করুণতা। নিশু বলল – ” এই ছোট ভাইটাকে একটু বিশ্বাস করুন। আপনার ক্ষতি করার জন্য পুরো একটা রাত আমার কাছে ছিল। চারিদিক ছিল জনশূন্যতা। আমি তো তখন আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে এই দিনের আলোয় কী ক্ষতি করব আপনার? আপনাকে একটা বাড়িরে নিয়ে যাচ্ছি আমি। যেখানে আপনি থাকবেন এখন। পরে আপনার ইচ্ছে হলে অন্য কোথায় চলে যেতে পারেন। কারণ যেই জায়গায় আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, সেখানে আপনি থাকতে পারবেন না। চারিদিকে ময়লা আবর্জনার স্তূপ আর হাজার হাজার গরীব মানুষদের কোলাহল সেখানে।”
মায়া মাথা নিচু করে আছে। নিজের মনে মনে বলল – ” ছেলেটাকে অবিশ্বাস করা মোটেও ঠিক হয়নি। আবার ঠিকমতো বিশ্বাস-ও করতে পারছি না।”
নিশু মায়ার হাত ধরে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। মায়া আর কোনো উপায় না পেয়ে নিশুর পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ঘরের সামনে গিয়ে থেমে গেল নিশু। এরপর ঘরের দরজায় টোকা দিলো। ঘরের ভিতর থেকে কর্কশ কণ্ঠে কেউ একজন বলল – “কোন হারামজাদারে?”
নিশু বলল – ” আমি নিশু।”
ওপাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ এলো না। নিশু-ও আর কোনো শব্দ করল না। কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে মধ্যবয়সী একটা লোক বেরিয়ে এসে নিশুর দিকে তাকিয়ে বলল – ” আবার এখানে এসেছিস কেন?”
- ” একটা ঘরের জন্য।”
নিশুর কথা শুনে লোকটা রেগে গেল। নিশুর কানে টান দিয়ে বলল – ” হারমজাদা। আগের মাসের ঘর ভাড়া না দিয়ে আবার ঘর ভাড়া নিতে এসেছিস।”
- ” এতদিন তো আমার মা ভাড়া দিয়েছে ঠিকমতো। আমার মা তো এখন বেঁচে নেই। তাই ভাড়া দিতে পারিনি আমি। কিন্তু আমি তোমাকে বলে রাখছি, এবার থেকে আমি সময়মত ভাড়া দিয়ে দিবো।”
মায়ার মনে হলো নিশুর কথা লোকটা বিশ্বাস করল না। তাই কোনো ঝামেলা হওয়ার আগেই মায়া টাকা বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল – ” এই নিন টাকা। ওকে ছেড়ে দিন এখন।”
লোকটা নিশুর কান ছেড়ে দিয়ে টাকা হাতে নিলো। টাকাটা ভালো করে দেখে নিজের হেফাজতে রেখে দিলো। এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল – ” আপনি কে?”
মায়া কিছু বলার আগেই পাশ থেকে নিশু বলল – ” উনি আমার বোন।”
লোকটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল – ” তোর তো মা ছাড়া কেউ নাই। তাইলে এই বোন কোত্থেকে জন্ম নিলো। এই মেয়ে তোর কোন সম্পর্কের বোন?”
- ” আত্মার সম্পর্কের বোন। আর তুমি এত কথা বলছ কেন? টাকা পেয়েছ, এখন ঘরের চাবি দেও।”
লোকটা আর কোনো কথা বলল না। কোমড়ে গুজে থাকা অনেকগুলো চাবির মধ্যে থেকে একটা চাবি বের করে নিশুর হাতে দিয়ে দিলো। চাবিটা নিয়ে নিশু আবার হাঁটা শুরু করল। মায়া নিশুর পিছু পিছু। ছোট্ট একটা ঘরের ভিতরে ঢুকল ওরা। চারিদিকে অন্ধকার থাকলেও ছিদ্রিত টিন ভেদ করে সূর্যের অসংখ্য আলো ঘরের ভিতরে এসে পড়েছে। যা ঘরটাকে আলোকিত করে তুলেছে।
৩.
- ” থেমে গেলে কেন? এরপর কী হয়েছে বল?”
নিশুর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পাশের কয়েদি বলল – ” বারবার তুমি মাঝপথে থেমে যাও কেন? এই গল্পের কী কোনো শেষ নেই? সবসময় এইটুকু বলে থেমে যাও তুমি। এরপর একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে যাও। আবার নতুন কোনো কয়েদি আমাদের সাথে এলে, এই গল্পটা প্রথম থেকে শুরু কর তুমি। আবার সেই এখানেই থেমে যাও। কিন্তু কেন? আমরা যে তোমার গল্পের শেষ পরিনতি শুনতে চাই।”
নিশু আবারও নিশ্চুপ।নিশু কাঁদতে কাঁদতে বলল – ” গল্পটা এখানে সমাপ্তি হলে কিংবা থমকে গেলেই ভালো হতো স্যার। কারণ এরপরের মুহূর্তগুলো শুধুমাত্র কষ্টের। এই গত চার বছর ধরে কয়েদি নামক যে যন্ত্রণা আমি সাথে নিয়ে আছি। তার থেকেও অধিক যন্ত্রনা এই গল্পটায়। সে-জন্যই তো গল্পটা আমি আজও শেষ করতে পারলাম না।”
- ” কিন্তু আমাদের যে জানতে ইচ্ছে করছে, কীভাবে তুই খুনের আসামী হলি?”
- ” বলব! কোনো একদিন সবাইকে এই গল্পটার সমাপ্তি বলব।”
জেলার সাহেব-ও হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন। কারণ তিনি জানেন, এই মুহূর্তে নিশুকে কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না। ও এখন আর কিছুই বলবে না। ও এখন থাকবে নিঃশব্দে। মধ্যরাত পর্যন্ত চোখের অশ্রু ঝড়াবে। এরপর সারাদিনের পরিশ্রমি ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে শুয়ে পড়বে শক্ত মেঝেতে।
চলবে..