Breaking News

গল্পঃ সময়-অসময় | লেখাঃ আলম সরকার


মুহাম্মদ আলী বারান্দায় ধপাস করে বসে পড়লেন। ভাঙা গলায় স্ত্রী’কে ডাকলেন,’কই গো আলমের মা? আমারে এক গ্লাস পানি দাও তো,বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছে।আয়না বেগম রান্নাঘরে পাঠায় মসলা ভাঁটছিলেন।স্বামীর ডাক শুনে মসলা ভাঁটা বন্ধ করে হাত ধুয়ে কলস থেকে পানি নিয়ে আসলেন।এসে দেখেন –আলমের বাপ জানি কেমন করতেছে!আয়না বেগম পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’কী হইছে গো আলমের বাপ?শইলডা খারাপ লাগতেছে নাকি?এই নেন পানি খান।
মুহাম্মদ আলী এক চুমুকে পুরোটা পানি শেষ করলেন।তারপর মুখ তোলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।করুন সুরে বললেন,’এবারও ফসল ভালো হয়নাই আলমের মা।কষ্টের ফসল পোকায় খাইলো।লোকজনের কাছ থেকে যে –এতটাকা ধার দেনা করলাম, এখন সেই টাকা দিমু কেমনে?এবার টাকা না দিতে পারলে লোকজন আমার মাথায় বাড়ি দিবো।এই তো আইজ,আজিজ বেপারী টাকার লাগি আমারে কত কী কইলো!গঞ্জে বেবাক মাইনষের সামনে আমারে বেইজ্জতি করলো।আমি কিচ্ছু কইতে পারি নাই।কী কমু?আইজ এ কইলো,কাইল ও কইবো, কয়জনের মুখ বন্ধু করমু?শেষ বয়সে দেনার দায়ে মাইনষের কাছে এভাবে বেইজ্জি হওনের থাইকা মইরা গেলেও ভালো হইতো।অনেক ভালো হইতো গো আলমের মা।
আয়না বেগমের চোখ ছলছল করছে।ছলছল চোখে স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’এভাবে কইয়েন না আলমের বাপ,কষ্ট লাগে।আপনে একটু শান্ত হোন।মাইনষের জীবনে সবটা সময় সমান যায় না।আইজ আমাদের সময়টা খারাপ,কাইল ভালো হতেও পারে।ধৈর্য ধরুণ।উপরে আল্লাহ আছে,তিনিই সব দেখবেন।আল্লাহ যদি চায়, পোলাডার এক কামের বন্দবস্ত হইয়া গেলেই আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।মুহাম্মদ আলী দীর্ঘশ্বাস ছেলে বললেন,’তা-ই যেন হয় আলমের মা।তা-ই যেন হয়।
মুহাম্মদ আলী একবারে মাটির মানুষ।রুক্ষ মাটির বুকে সুক্ষ্ণ লাঙলের আঁচড় কেটে ফসল ফলান।তা দিয়েই সংসার চলে।গত বছর থেকে তাঁর ফসল তেমন একটা ভালো হচ্ছে না।ঈঁদুর পোকায় কেটে-কুটে খেয়ে সর্বনাশ করে ফেলে।মুহাম্মদ আলী প্রায় ভেঙে পড়েছেন।দুশ্চিন্তায় দু’চোখে ঘুম আসে না।লাখ টাকা দেনার দায়ে ভুগছেন।সেই টাকা আবার সুদ হিশেবে আনা।দিন যতই যাচ্ছে টাকার অংক ততই বাড়ছে।চতুর্দিক থেকে টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে।অনেকে অনেক মন্দচারিও বলছে।
মুহাম্মদ আলী ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন কী করবেন!খুবই আর্থিক সংকটে আছেন।সংসারই ঠিকমত চলে না।এই অবস্থায় এতটাকা ঋণ পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।উনার আরো কিছু সময় দরকার।কিন্তু মানুষ তো আর এটা বুঝে না। সময় মতো টাকা পরিশোধ করো।অল্হমের নিচে গেলে মনে থাকে না।দিতে পারবে না তো নিয়েছিলে কেন?শুনেন ভাই,’পেরে কেউ গলা পানিতে নামে না।অপারক হয়েই নামতে হয়।মুহাম্মদ আলীর অবস্থা ঠিক তেমনই হয়েছিলো।
বছর দুয়েক আগে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন।পাত্র পক্ষের চাহিদা মতো যৌতুকের পঞ্চাশ হাজার টাকা সহ যাবতীয় খরচা হয়েছে প্রায় লক্ষাদিক টাকার ওপরে।কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মেয়েটার কপালে সুখ হলো না।বিয়ের সাত মাসের মাথায় জামাইডা মইরা গেছে।কোন রোগব্যাধি ছিলো না,সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থাতেই মারা গেছে।হয়তো তাঁর হায়াত-ই এতটুকু ছিলো।তয় পোলাডা খুব ভালা মানুষ আছিলো।সেই কথা মনে পড়লে আজও চোখ ভিজে উঠে।’
জামাই মইরা যাওনের পর মুহাম্মদ আলী তাঁর মেয়েকে শ্বশুড় বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন।নিজের কাছেই রেখে দেন।চিন্তা ভাবনা করছিলেন,মেয়েটাকে আবার বিয়ে দিবেন।ক’দিন-ই বা সংসার করছে!একটা পোলা-মাইয়াও হয়নাই।কিন্তু মেয়েটা রাজি হতে চায় না।আবারো যদি কপাল পুড়ে।
দুঃখ যখন আসে –তখন চারদিক থেকেই আসে।মুহাম্মদ আলীর একটা মাত্র পোলা।বুক ভরা আসা নিয়ে পোলাডারে বিদেশে পাঠাইছেন।তিন লাখ টাকা খরচা হয়েছে।পুরোটাই জমি বন্ধক দিয়ে আর ধার দেনা করে আনা।পোলায় কাজ করে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাইলে ধার দেনা পরিশোধ করে দিবেন।কিন্তু দুঃখের বিষয় –ছয় মাস হইয়া গেলো আইজও পোলাডার কোন কাম-কাজের ব্যবস্থা হয়নি।মুহাম্মদ আলীর পোলার লাইগা বড় দুশ্চিন্তা হয়।বিদেশের বাড়ি,কোথায় থাকে?কী খায়?আল্লাই জানে!ফোন করলে শুধু বলে,”আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা কইরো না।আমি ভালোই আছি।এখানে আমার এক বন্ধুর খোঁজ পাইছি।খুব ভালো ছেলে।তাঁর কাছেই আছি,থাকছি, খাচ্ছি।কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।আর ও বলেছে,খুব শীঘ্রই একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবে।তোমরা কোন চিন্তা কইরো না।নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া কইরো।মুহাম্মদ আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ষশ্বাস ছেড়ে বলে,’তাই যেন হয়।তাই যেন হয়।
বছর তিনেক পরের কথা।সময় অনেকটা পাল্টে গেছে।দুঃসময়ের খারাপিগুলো জড়ো হয়ে মাটি চাপা পড়েছে,সেই মাটিতে ভালোর বিজ রোপন হয়েছে।মুহাম্মদ আলীর সময় পরিবর্তন হয়েছে।ছেলেটার ভালো একটা চাকরি হয়েছে।মাসে মাসে বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে।সেই টাকা দিয়ে মুহাম্মদ আলীর সব ঋণ পরিশোধ করেছেন।সুদে আসলে পাই পাই হিশেব করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।আর বন্ধক রাখা জমিগুলোও ছাড়িয়ে এনেছেন।সেই জমিতে এখন সোনা ফসল ফলে।
এবার অগ্রাণের ফসল তুলে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন।অবশ্য মেয়েটা রাজি হতে চাচ্ছিলো না,একপ্রকার জোর করেই দিয়েছেন।সেটার ফল ভালোই হয়েছে।মেয়েটা এখন মোটামুটি সুখেই আছে।এবার শুধু ছেলেটাকে বিয়ে করানো বাকি।মুহাম্মদ আলী ভেবে রেখেছেন,ছেলেটা বাড়িতে আসলেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবেন।তারপর তিনি সবকিছু থেকে অবসর নিবেন।
আমাদের জীবনে দুঃসময় আসে আবার চলেও যায়।একটু ধৈর্যসহকারে মোকাবেলা করলেই হয়।কিন্তু আমাদের অতো ধৈর্য নেই।আমরা অল্পতেই ভেঙে পড়ি।যার ফলে সময়ের খারাপিগুলো আমাদের হতাশ করে।

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com