Breaking News

স্বামী কখ‌নো প্রেমিক হয় না

বি‌য়ের দুইমাস প‌রে এ‌সে তারু আপা ব‌লে‌ছি‌লেন, খবরদার বি‌নি।
কখ‌নো বি‌য়ে ক‌রিস না বু‌ঝলি!
আ‌মি হাস‌তে হাস‌তে বললাম, সে‌কি এই না সে‌দিন বি‌য়ে কর‌লে। ওম‌নি বিরক্ত?
দেবদারু দাদা বু‌ঝি যত্ন নেয় না আর।
কথাটা আ‌মি ঠাট্টার ছ‌লেই ব‌লে‌ছিলাম। তারু আপার মুখ অন্ধকার হ‌য়ে যায়।
তার আর দোষ কি বল? স্বামী যে প্রেমিক হয় না রে!
ওই কথার মা‌নে আ‌মি সে‌দিন বু‌ঝি‌নি।
দেবদারু দাদা চমৎকার মানুষ। তারু আপা ওর সা‌থে পাক্কা চার বছর প্রেম ক‌রে‌ছে।
তারপরই তো বি‌য়ে। নতুন বি‌য়ে হল সা‌থে একটু ঝগড়া হ‌য়ে‌ছে হয়ত তাই ওমন বল‌ছে।
তারু আপাটা তো মস্ত ঝগড়ু‌টে। দেখতাম তো আ‌গে কথায় কথায় দাদা‌কে কেমন বকত।
দেবদারু দা তখন চুপ ক‌রে হাসত শুধু।
আ‌মি বলতাম, দাদা আমার এই দ‌স্যি বোনটা‌কে কি ক‌রে সহ‌্য ক‌রো ব‌লো‌তো।
দাদার হা‌সি আরও বিস্তৃত হত।
প্রেমি‌কের অ‌ধৈর্য‌্য হ‌লে চ‌লে না, বি‌নি।
আ‌মিও অবাক হ‌য়ে ভাবতাম, এটাই বু‌ঝি ভা‌লোবাসা?
তারু আপা আমার নি‌জের বোন নয়। একই পাড়ায় থাকতাম আমরা।
আ‌মি, এষা, নবান্নী আর তারু আপা সারাক্ষন একসা‌থে।
আপা আমা‌দের থে‌কে বয়সে বড় হ‌লে কি হ‌বে ঠিক যেন বান্ধবী।
আমরা দেবদারু দাদার সা‌থে দেখা কর‌তে যেতাম দল বে‌ধে।
আর ছোট্ট মফস্ব‌লে ও‌দের প্রেমের কথা কারই বা অজানা ছিল?
তবুও আপা জোর ক‌রে আমা‌দের সা‌থে নি‌য়ে ত‌বেই যেত। ওই‌দিনটা আপা খুব সুন্দর ক‌রে সাজত।
দাদার দেয়া ছাই রঙা শা‌ড়িটাই প্রতিবার প‌রে যেত। আমরা হাসাহা‌সি করতাম।
এটা বু‌ঝি তোমার প্রেম কর‌তে যাওয়ার ইউ‌নিফর্ম! সেও বু‌ঝি ওই আ‌গের পাঞ্জাবীটা প‌ড়েই আস‌বে?
এবার কিন্তু প‌রি‌স্থি‌তি খারাপ হ‌য়ে যেত।
এম‌নি‌তে নি‌জে যতই বকুক আমরা দেবদারু দাদা‌কে নি‌য়ে কিছু বল‌লে তারু আপা উ‌ল্টে আমা‌দের উপর রাগ করত। আমরাও কম কি‌সে? কত কত ফ‌ন্দি আটতাম আপা‌কে ক্ষেপা‌নোর জন‌্য। বলতাম,
মুসলমান ছে‌লের হিন্দু হিন্দু নাম, দেবদারু। কেমন ছে‌লের সা‌থে প্রেম ক‌রো, তারু আপা।
ওম‌নি পি‌ঠের উপর দড়াম ক‌রে কিল, না‌মের আবার হিন্দু মুসলমান কি‌রে।
দেবদারু একটা গা‌ছের নাম। তারপর অ‌পেক্ষাকৃত কোমল স্ব‌রে বলত, অ‌নেকটা যেন নি‌জে‌কেই বলা।
ওই মানুষটাও তেম‌নি। একটা গা‌ছের মতই। ‌কোন রাগ নেই,
অ‌ভিমান নেই, কেমন মাথার উপর ছায়া হ‌য়ে থা‌কে!
আপার ক‌ন্ঠে মুগ্ধতা ছ‌ড়ি‌য়ে পড়ত। দেবদারু দাদা‌কে নি‌য়ে কোন ঠাট্টা সহ‌্য করত না আপা।
আমরা ও‌কে দাদা ব‌লে ডাকতাম তা‌তেও রে‌গে যেত।
তারু আপাটার এত্ত রাগ ছিল! আমা‌দের কি দোষ না‌মের সা‌থে যে দাদাটাই মা‌নি‌য়ে যায়। ‌
দেবদারু নামের সা‌থে ভাইয়া যোগ কর‌লে যে না‌মের সৌন্দর্যই হা‌রি‌য়ে যা‌বে। আপা তা বুঝ‌তেই চাইত না।
দাদাকে নালিশ করত রী‌তিমত।
জা‌নো, ওরা তোমায় ব‌্যঙ্গ ক‌রে দাদা ব‌লে। তোমার না‌মের জন‌্য।
দেবদারু দার স্বভাব সুলভ হা‌সি।
আহ্, বলুক না। শুন‌তে তো ভা‌লোই লা‌গে।
আপা আরও রে‌গে যেত।
তু‌মি কি বোকা না‌কি! কিচ্ছু বো‌ঝো না।
আমা‌দের পক্ষ নি‌তে গি‌য়ে বেচারার আরও ঝা‌ড়ি শুন‌তে হত। তবুও ঠো‌ঁটের কো‌নে হা‌সি লে‌গেই থাকত। কি মি‌ষ্টি মধুর প্রেম ছিল ও‌দের।
এসবই বহু‌দিন আ‌গের কথা। ‌বি‌য়ের পর তারু আপার সা‌থে ওই একবারই দেখা হ‌য়ে‌ছিল।
তারপর আমরাও সবাই যে যার মত হা‌রি‌য়ে গেলাম। ঢাকায় আসার পর আর কা‌রো সা‌থেই যোগাযোগ ‌ছিল না কোন। নতুন প‌রি‌বে‌শে নতুন মানুষ‌দের সা‌থে এমন ভা‌বেই মি‌শে গে‌ছি, ফেলা আসা দি‌নের স্মৃ‌তি হ‌য়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগু‌লো আর উ‌ল্টে দেখার সময় হয় না। তাই বছর দু‌য়েক প‌রে যখন শুনলাম তারু আপার ডি‌ভোর্স হ‌য়ে গে‌ছে, সে খব‌রেও খুব একটা বিচ‌লিত হলাম না। কিংবা একবার খোঁজও নিলাম না। জীবন চ‌লে যা‌চ্ছে জীব‌নের নিয়মে।
কোন এক বস‌ন্তে আমার জীবনেও প্রেম এল। সে প্রনয় বি‌য়ে‌তে প‌রিন‌তি পে‌লো।
বেশ সু‌খের সংসার। কোন ঝগড়া-বিবাদ নেই, কোন দ্বন্দ্ব নেই। কেমন শা‌ন্তির জীবন।
অ‌মিত আমা‌কে বেশ তো ভা‌লোবা‌সে। কে ব‌লে‌ছে স্বামী প্রেমিক হয় না?
তারপর কিছুকাল এই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। স্বামী এক‌দিন বাবা হ‌তে চাইল। কিন্তু জান‌তে পারলাম আ‌মি মা হ‌তে পারব না। আর হি‌সেব মিল‌লো না। চেনা মানুষ কেমন অ‌চেনা হ‌য়ে যায়, মুহূ‌র্তে রং বদলায়, অতী‌ত মু‌ছে যায়।
এতই তার তীব্রতা যে কোনকা‌লে সে ছি‌লো ব‌লেই বোধ হয়না আর। তবু ছেড়া কাগ‌জে শেষ একবার রং ছ‌ড়ি‌য়ে দি‌তে চেয়েছিলাম। অ‌মিত‌কে বললাম, একটা বাচ্চ‌া দত্তক নেই আমরা? অ‌মিত নাক সিঁট‌কোয়।
সে‌কি! বি‌নিতা, তোমার মাথা খারাপ হ‌লো না‌কি? একটা প‌রের ছে‌লে কখ‌নো আপন হয় না‌কি। নি‌জের রক্ত তো নি‌জেরই।
কথাটা যে কতখা‌নি স‌ত্যি আ‌মি তা‌কি‌য়েই দেখলাম শুধু। চো‌খের সাম‌নে আ‌মি পর, আবার পরই হ‌য়ে গেলাম। অ‌মিত তার রক্তের সম্পর্কেই বাঁধা আ‌ছে। ভা‌লোবাসা তখন কোথায় পা‌লি‌য়ে সারা! এতটা দিন সংসার ক‌রেও আ‌মি ও‌দের আপন হ‌তে পারলাম না, ত‌বে একটা বাচ্চা দত্তক নেয়া তো কল্পনারও অতীত। এবার ত‌বে করনীয় কি?
সোজা সাপ্টা জবাব আ‌সে।
তোমার অক্ষমতার দায় আ‌মি কেন নেব?
অ‌মিত আর দ্বিতীয়বারভা‌বে না। কোথায় স্বামী, কি‌সের প্রেমিক!
দিন‌শে‌ষে অক্ষমতাই যখন ব‌্যর্থতার কারন, সে সম্প‌র্কে সফলতা ছিল ক‌বে?
আ‌মি আর আপ‌ত্তি ক‌রি‌নি। ভা‌লোবাসা ম‌রে গে‌লে সম্পর্ক বা‌ঁচি‌য়ে আর কি হ‌বে?
সেও ধু‌লোয় মি‌শে যাক। মাস তি‌নে‌কের ম‌ধ্যে সব ঝা‌মেলা শেষ হ‌লো। আ‌মি হঠাৎ একা হ‌য়ে গেলাম।
সকা‌লে ঘুম থে‌কে ওঠার তাড়া নেই, সংসারধর্ম নেই, স্বামী নেই যে!
সেই বিপুল বিস্তর উপন্যাস আজ একটা ছোট্ট গল্প, যার সমাপ্তিতেও শেষ নেই।
তবু খন্ড-অখন্ড অবস‌রে হঠাৎ হঠাৎ ম‌নে প‌ড়ে তারু আপার সেই কথাটা।
স্বামী কখ‌নো প্রেমিক হয় না রে!

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com