আল ফাতিহা, তাফসীর আয় নং- ০১ । তাফসীর ইবনে কাসীর
এর আর একটি নাম সূরাতুর রকিয়্যাহ'। হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) সাপে কাটা রুগীর উপর ফু দিলে সে ভাল হয়ে যায়। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ এটা যে রকিয়্যাহ (অর্থাৎ পড়ে ফুঁ দেয়ার সূরা) তা তুমি কেমন করে জানলে?'হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ সূরাকে আসাসুল কুরআন বলতেন। অর্থাৎ কুরআনের মূল বা ভিত্তি। আর এই সূরার ভিত্তি হলো (আরবী) সুফইয়ান বিন উয়াইনাহ (রঃ) বলেন যে, এই সূরার নাম অফিয়াহ্। ইয়াহ্ইয়া বিন কাসীর (রাঃ) বলেন যে, এর নাম কাফিয়াও বটে। কেননা, এটা অন্যান্য সূরাকে বাদ দিয়েও একাই যথেষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য কোন সূরা একে বাদ দিয়ে যথেষ্ট হয় না। কোন কোন মুরসাল (যে হাদীসের সনদের ইনকিতা' শেষের দিকে হয়েছে অর্থাৎ সাহাবীর নামই বাদ পড়েছে এবং তাবেঈ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে হাদীসে’ মুরসাল বলে) হাদীসের মধ্যেও একথা এসেছে যে, উম্মুল কুরআন সবারই স্থলাভিষিক্ত হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য সূরাগুলো উম্মুল কুরআনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। (আল্লামা যামাখশারীর তাফসীর-ই-কাশশাফ দ্রব্য)একে সূরাতুস সালাত এবং সূরাতুল কাজও বলা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ (রঃ) এবং আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, এই সূরাটি মাক্কী। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), আতা’ বিন ইয়াসার (রঃ) এবং ইমাম যুহরী (রঃ) বলেন যে, এই সূরাটি মাদানী। এটাও একটি অভিমত যে, এই সূরাটি দুইবার অবতীর্ণ হয়েছে। একবার মক্কায় এবং অন্যবার মদীনায়।
কিন্তু প্রথমটিই বেশী সঠিক ও অভ্রান্ত। কেননা অন্য আয়াতে আছে (আরবী) অর্থাৎ ‘আমি তোমাকে সাবআ মাসানী (বারবার আবৃত্ত সাতটি আয়াত) প্রদান করেছি'।' (১৫:৮৭) আল্লাহ তা'আলাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানেন।আবু লাইস সমরকন্দীর (রঃ) একটি অভিমত কুরতুবী (রঃ) এও নকল করেছেন যে, এই সূরাটির প্রথম অর্ধাংশ মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং শেষ অর্ধাংশ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু হাদীসের পরিভাষায় এই কথাটিও সম্পূর্ণ গারীব বা দুর্বল। এ সূরার আয়াত সম্পর্কে সবাই একমত যে ওগুলি ৭টা। কিন্তু আমর বিন উবায়েদ ৮টা এবং হুসাইন যফী ৬টাও বলেছেন। এ দুটো মতই সাধারণ মতের বহির্ভূত ও পরিপন্থী (আরবী) এই সূরাটির পৃথক আয়াত কিনা তাতে মতভেদ রয়েছে। সমস্ত কারী, সাহাবী (রাঃ) এবং তাবেঈর (রঃ) একটি বিরাট দল এবং পরবর্তী যুগের অনেক বয়োবৃদ্ধ মুরব্বী একে সূরা -ই-ফাতিহার প্রথম, পূর্ণ একটি পৃথক আয়াত বলে থাকেন। কেউ কেউ একে সূরা-ই-ফাতিহারই অংশ বিশেষ বলে মনে করেন। আর কেউ কেউ একে এর প্রথমে মানতে বা স্বীকার করতেই চান না। যেমন মদীনা শরীফের কারী ও ফকীহগণের এই তিনটিই অভিমত। ইনশাআল্লাহ পূর্ণ বিবরণ সামনে প্রদত্ত হবে।
এই সূরাটির শব্দ হলো পঁচিশটি এবং অক্ষর হলো একশো তেরটি। ইমাম বুখারী (রঃ) সহীহ বুখারীর কিতাবুত তাফসীরের মধ্যে লিখেছেনঃ “এই সূরাটির নাম উম্মুল কিতাব' রাখার কারণ এই যে, কুরআন মাজীদের লিখন এ সূরা হতেই আরম্ভ হয়ে থাকে এবং নামাযের কিরআতও এ থেকেই শুরু হয়। একটি অভিমত এও আছে যে, যেহেতু পূর্ণ কুরআন কারীমের বিষয়াবলী সংক্ষিপ্তভাবে এর মধ্যে নিহিত রয়েছে, সেহেতু এর নাম উম্মুল কিতাব হয়েছে। কারণ, আরব দেশের মধ্যে এ প্রথা চালু আছে যে, তারা একটি ব্যাপক কাজ বা কাজের মূলকে ওর অধীনস্থ শাখাগুলির ‘উম্ম’ বা ‘মা’ বলে থাকে। যেমন (আরবী) তারা ঐ চামড়াকে বলে যা সম্পূর্ণ মাথাকে ঘিরে রয়েছে এবং সামরিক বাহিনীর পতাকাকেও তারা (আরবী) বলে থাকে যার নীচে জনগণ একত্রিত হয়। কবিদের কবিতার মধ্যেও একথার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়।
মক্কা শরীফকেও উম্মুল কুরা বলার কারণ এই যে, ওটাই সারা বিশ্ব জাহানের প্রথম ঘর। পৃথিবী সেখান হতেই ব্যাপ্তি ও বিস্তার লাভ করেছে। নামাযের কিরআত ওটা হতেই শুরু হয় এবং সাহাবীগণ কুরআন কারীম লিখার সময় একেই প্রথমে লিখেছিলেন বলে একে ফাতিহাও বলা হয়। এর আর একটি সঠিক নাম ‘সাবআ মাসানীও রয়েছে, কেননা এটা নামাযের মধ্যে বারবার পঠিত হয়। একে প্রতি রাকাতেই পাঠ করা হয়। মাসানীর অর্থ আরও আছে যা ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে বর্ণিত হবে। মুসনাদে-ই-আহমাদের মধ্যে হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) উম্মুল কুরা' সম্পর্কে বলেছেনঃ 'এটাই উম্মুল কুরআন এটাই সাবআ মাসানী এবং এটাই কুরআনে আযীম। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘এটাই ‘উম্মুল কুরআন, এটাই 'ফাতিহাতুল কিতাব’ এবং এটাই সাবআ মাসানী।তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াইতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ (আরবী)-এর সাতটি আয়াত। (আরবী) ও ওগুলোর মধ্যে একটি আয়াত।
এরই নাম সাবআ মাসানী’, এটাই, কুরআনে আযীম, এটাই ‘উম্মুল কিতাব, এটাই ‘ফাতিহাতুল কিতাব’ এবং এটাই কুরআনে আযীম।ইমাম দারকুতনীও (রঃ) স্বীয় হাদীস গ্রন্থে এরূপ একটি হাদীস এনেছেন এবং তিনি তার সমস্ত বর্ণনাকারীদেরই নির্ভরযোগ্য বলেছেন। বায়হাকীতে রয়েছে যে, হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) সাবআ মাসানী’র ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ ‘এটা সূরা-ই-ফাতিহা এবং -এর সপ্তম আয়াত। (আরবী)-এর আলোচনায় (আরবী)-এর বর্ণনা পূর্ণভাবে দেওয়া হবে।হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ আপনার লিখিত কুরআন কারীমের প্রারম্ভে আপনি সূরা-ই-ফাতিহা লিখেননি কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ যদি আমি লিখতাম তবে প্রত্যেক সূরারই প্রথমে ওটাকে লিখতাম। আবু বকর বিন আবি দাউদ (রঃ) বলেনঃ একথার ভাবার্থ এই যে, . নামাযের মধ্যে তা পাঠ করা হয় এবং সমস্ত মুসলমানের এটা মুখস্থ আছে বলে তা’ লিখার আর প্রয়োজন হয় না।
দালাইলুন নবুওয়াত’ এ ইমাম বায়হাকী (রঃ) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে যে, এই সুরাটি সর্বপ্রথম অবর্তীণ হয়েছে। বাকিলানীর (রঃ) তিনটি উক্তি বর্ণিত হয়েছেঃ (১) সূরা-ই-ফাতিহা সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। (২) (আরবী) সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। (৩) (আরবী) সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। শেষ উক্তিটিই সঠিক। এর পূর্ণ বিবরণ ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে আসবে।
সূরা-ই-ফাতিহার ফযীলত ও মাহাত্ম্যঃ মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “আমি নামায পড়ছিলাম, এমন সময়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ডাক দিলেন, আমি কোন উত্তর দিলাম না। নামায শেষ করে আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ এতক্ষণ তুমি কি কাজ করছিলে? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি নামাযে ছিলাম। তিনি বললেনঃ আল্লাহ তা'আলার এই নির্দেশ কি তুমি শুননি? (আরবী) অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সঃ) ডাকে সাড়া দাও যখন তাঁরা তোমাদেরকে আহ্বান করেন। (৮:২৪) জেনে রেখো, মসজিদ হতে যাবার পূর্বেই আমি তোমাদেরকেই বলে দিচ্ছি, পবিত্র কুরআনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সূরা কোটি। অতঃপর তিনি আমার হাত ধরে মসজিদ হতে চলে যাবার ইচ্ছে করলে আমি তাকে তার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম।
তিনি বললেনঃ ‘ঐ সূরাটি হলো (আরবী) এটাই সাবআ’ মাসানী এবং এটাই কুরআন আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে। এভাবেই এই বর্ণনাটি সহীহ বুখারী শরীফ, সুনান-ই আবি দাউদ এবং সুনান-ই-ইবনে মাজার মধ্যেও অন্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। ওয়াকেদী (রঃ) এই ঘটনাটি হযরত উবাই ইবনে কা'বের (রাঃ) বলে বর্ণনা করেছেন। মুআত্তা-ই-ইমাম মালিকে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) কে ডাক দিলেন। তিনি নামায পড়ছিলেন। নামায শেষ করে তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি বলেনঃ তিনি (নবী সঃ) স্বীয় হাতখানা আমার হাতের উপর রাখলেন। মসজিদ হতে বের হতে হতেই বললেনঃ আমি চাচ্ছি যে, মসজিদ হতে বের হওয়ার পূর্বেই তোমাকে এমন একটি সূরার কথা বলবো যার মত সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে নেই। এখন আমি এই আশায় আস্তে আস্তে চলতে লাগলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম-“হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সেই সূরাটি কি? তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ নামাযের প্রারম্ভে তোমরা কি পাঠ কর?' আমি বললাম (আরবী) তিনি বললেনঃ “এই সূরা সেটি।
সাবআ’ মাসানী এবং কুরআন আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে তাও এই সূৱাই বটে। এই হাদীসটির শেষ বর্ণনাকারী হলেন আবু সাঈদ (রঃ)। এর উপর ভিত্তি করে ইবনে আসীর এবং তাঁর সঙ্গীগণ প্রতারিত হয়েছেন এবং তাঁকে আবু সাঈদ বিন মুআল্লা মনে করেছেন। এ আবু সাঈদ অন্য লোক, ইনি খাসাইর কৃতদাস এবং তাবেঈগণের অন্তর্ভুক্ত। আর উক্ত আবু সাঈদ আনসারী (রাঃ) একজন সাহাবী। তার হাদীস মুত্তাসিল (যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোন স্তরে কোন রাবী বাদ না পড়ে অর্থাৎ সকল রাবীর নামই যথাস্থানে উল্লেখ থাকে তাকে হাদীসে মুত্তাসিল বলে) এবং বিশুদ্ধ। পক্ষান্তরে এই হাদীসটি বাহ্যতঃ পরিত্যাজ্য যদি আবু সাঈদ তাবেঈর হযরত উবাই (রাঃ) হতে শুনা সাব্যস্ত না হয়। আর যদি শুনা সাব্যস্ত হয় তবে হাদীসটি যথার্থতার শর্তের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন।
এই হাদীসটির আরও অনেক সূত্র রয়েছে। মুসনাদ-ই- আহমাদে রয়েছে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উবাই বিন কা'বের (রাঃ) নিকট যান যখন তিনি নামায পড়ছিলেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ “হে উবাই (রাঃ)! এতে তিনি (তার ডাকের প্রতি মনোযোগ দেন কিন্তু কোন উত্তর দেন নি। আবার তিনি বলেনঃ “হে উবাই (রাঃ)!' তিনি বলেনঃ ‘আস্সালামু আলাইকা।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘ওয়াআলাইকাস সালাম। তারপর বলেনঃ “হে উবাই (রাঃ)! আমি তোমাকে ডাক দিলে উত্তর দাওনি কেন?' তিনি বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি নামাযে ছিলাম।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন উপরোক্ত আয়াতটিই পাঠ করে বলেনঃ তুমি কি এই আয়াতটি শুননি? তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাঁ (আমি শুনেছি) এরূপ কাজ আর আমার দ্বারা হবে না।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ তুমি কি চাও যে, তোমাকে আমি এমন একটি সূরার কথা বলে দেই যার মত কোন সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং কুরআনের মধ্যেই নেই? তিনি বলেনঃ হ্যা অবশ্যই বলুন।' তিনি বলেনঃ এখান থেকে যাবার পূর্বেই আমি তোমাকে তা বলে দেবো।'
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার হাত ধরে চলতে চলতে অন্য কথা বলতে থাকেন, আর আমি ধীর গতিতে চলতে থাকি। এই ভয়ে যে না জানি কথা থেকে যায় আর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বাড়ীতে পৌছে যান। অবশেষে দরজার নিকট পৌছে আমি তাঁকে তাঁর অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেই।' তিনি বলেনঃ নামাযে কি পড়’ আমি উম্মুল কুরা’ পড়ে শুনিয়ে দেই।' তিনি বলেনঃ “সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, এরূপ কোন সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল, জবুর এবং কুরআনের মধ্যে নেই। এটাই হলো ‘সাবআ মাসানী'। জামেউত তিরমিযীর মধ্যে আরও একটু বেশী আছে। তা হলো এই যে, এটাই বড় কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে। এই হাদীসটি সংজ্ঞা ও পরিভাষা অনুযায়ী হাসান ও সহীহ। হযরত আনাস (রাঃ) হতেও এ অধ্যায়ে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। মুসনাদ-ই-আহমাদেও এইভাবে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) একে পরিভাষার প্রেক্ষিতে হাসান গারীব বলে থাকেন। মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ বিন জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করি। সে সময় সবেমাত্র তিনি সৌচ ক্রিয়া সম্পাদন করেছেন। আমি তিনবার সালাম দেই কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না।
তিনি তো বাড়ীর মধ্যেই চলে গেলেন, আমি দুঃখিত, ও মর্মাহত অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করি। অল্পক্ষণ পরেই পবিত্র হয়ে তিনি আগমন করেন এবং তিনবার সালামের জওয়াব দেন। অতঃপর বলেন, “হে আবদুল্লাহ বিন জাবির (রাঃ)! জেনে রেখো, সম্পূর্ণ কুরআনের মধ্যে সর্বোত্তম সূরা হলো (আরবী) এই সূরাটি। এর ইসনাদ খুব চমক্কার। এর বর্ণনাকারী ইবনে আকীলের হাদীস বড় বড় ইমামগণ বর্ণনা করে থাকেন। এই আবদুল্লাহ বিন জাবির বলতে আবদী সাহাবীকে (রাঃ) বুঝানো হয়েছে। ইবনুল জাওযীর কথা এটাই। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন। হাফিয ইবনে আসাকীরের (রঃ) অভিমত এই যে, ইনি হলেন আবদুল্লাহ বিন জাবির আনসারী বিয়াযী (রাঃ)।
কুরআনের আয়াত ও সূরাসমূহ এবং ওগুলোর পারস্পরিক মর্যাদাএই হাদীস এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণ বের করে ইবনে রাহ্ইয়াহ, আবু বকর বিন আরবী, ইবনুল হাযার (রঃ) প্রমুখ অধিকাংশ আলেমগণ বলেছেন যে, কোন আয়াত এবং কোন সূরা অপর কোন আয়াত ও সূরার চেয়ে বেশী মর্যাদার অধিকারী। আবার অন্য একদলের ধারণা এই যে, আল্লাহর কালাম সবই সমান। একের উপর অন্যের প্রাধান্য দিলে যে অসুবিধার সৃষ্টি হবে তা হলো অন্য আয়াত ও সূরাগুলি কম মর্যাদা সম্পন্ন রূপে পরিগণিত ও প্রতিপন্ন হবে। অথচ আল্লাহপাকের সমস্ত কালামই সমমর্যাদাপূর্ণ। কুরতুবী এটাই নকল করেছেন আশআরী, আবু বকর বাকিল্লানী, আবু হাতিম ইবনে হাব্বান কূসতী, আবু হাব্বান এবং ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া হতে। ইমাম মালিক (রঃ) হতেও এই মর্মের অন্য একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।সূরা-ই-ফাতিহার মর্যাদার ব্যাপারে উপরোল্লিখিত হাদীসসমূহ ছাড়াও আরও হাদীস রয়েছে। সহীহ বুখারী শরীফের ফাযায়িলুল কুরআন অধ্যায়ে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “একবার আমরা সফরে ছিলাম। এক স্থানে আমরা অবতরণ করি। হঠাৎ একটি দাসী এসে বললোঃ “এ জায়গার গোত্রের নেতাকে সাপে কেটেছে। আমাদের লোকেরা এখন সবাই অনুপস্থিত। ঝাড় ফুক দিতে পারে এমন কেউ আপনাদের মধ্যে আছে কি? আমাদের মধ্য হতে একটি লোক তার সাথে গেল। সে যে ঝাড় ফুকও জানতো তা আমরা জানতাম না। তথায় গিয়ে সে কিছু ঝাড় ফুক করলো। আল্লাহর অপার মহিমায় তৎক্ষণাৎ সে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করলো।
অনন্তর সে ৩০টি ছাগী দিল এবং আমাদের আতিথেয়তায় অনেক দুধও পাঠিয়ে দিল। সে ফিরে আসলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ “তোমার কি এ বিদ্যা জানা ছিল?' সে বললোঃ 'আমিতো শুধু সূরা-ই-ফাতিহা পড়ে ফুক দিয়েছি। আমরা বললামঃ “তাহলে এ প্রাপ্ত মাল এখনও স্পর্শ করো না। প্রথমে ক্লাসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করো।' মদীনায় আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এ ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করলাম। তিনি বললেনঃ “এটা যে ফুক দেয়ার সূরা তা সে কি করে জানলো? এ মাল ভাগ করো। আমার জন্যেও একভাগ রেখো।' সহীহ মুসলিম ও সুনান-ই আবি দাউদেও এ হাদীসটি রয়েছে। সহীহ মুসলিমের কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, ফুক দাতা হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ছিলেন।সহীহ মুসলিম ও সুনান-ই নাসাঈর মধ্যে হাদীস আছে যে, একদা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকটে বসেছিলেন, এমন সময়ে উপর হতে এক বিকট শব্দ আসলো।
হযরত জিব্রাঈল (আঃ) উপরের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ আজ আকাশের ঐ দরজাটি খুলে গেছে যা ইতিপূর্বে কখনও খুলেনি। অতঃপর সেখান হতে একজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বললেন, আপনি খুশি হোন! এমন দুটি নূর আপনাকে দেয়া হলো যা ইতিপূর্বে কাউকেও দেয়া হয়নি। তা হলো সূরা-ই-ফাতিহা ও সূরা-ই- বাকারার শেষ আয়াতগুলো। ওর এক একটি অক্ষরের উপর নূর রয়েছে। এটা সুনান-ই-নাসাঈর শব্দ। সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নামাযে উম্মুল কুরআন পড়লো না তার নামায অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ পূর্ণ নয়। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আমরা যদি ইমামের পিছনে থাকি তা হলে? তিনি বললেনঃ “তাহলেও চুপে চুপে পড়ে নিও। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছি, তিনি বলতেন