অনাবিল সুখের নীড় ♥⚘

পারিবারিকভাবেই আমাদের বিয়েটা সম্পূর্ন হয়। বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। আর আমার বউয়ের ১৮। অবশ্য এত অল্প বয়সে বিয়ে করারও একটা কারণ আছে। মেয়েটি আমাকে অনেক ভালোবাসত। বাস্তবিক কারণেই বয়স ১৬ হওয়ার সাথে সাথে ওর জন্য প্রায় প্রায় বিয়ের প্রস্তাব আসত। আর ও ফিরিয়ে দিতো । কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
আমার ফ্যামিলী এ বিষয়ে অবগত ছিলো। মুন্নিকে আমার আম্মু আব্বুও অনেক পছন্দ করত। ও হ্যা, বলায় তো হয় নি, ওর নাম মুন্নি। এই পাগলি মেয়েটা আমাকে এতোটাই ভালোবাসে যে আমার চোখে সামান্য পানি আসলেই ও বাচ্চা শিশুর মতো কেঁদে ওঠে।
.
সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্কটাও গভীরতা লাভ করছিলো। শুরুর দিকে আমার তেমন কোন ফিলিংস ছিলো না। কিন্তু এখন ওকে ছাড়া একটা মূহুর্ত চলে না।
.
সেদিন ছিলো সত্যি আমার জন্য খুবই কষ্টের। যখন শুনি মুন্নি হাসপাতালে ।
জানতে পারলাম ওকে দেখতে এসেছিল পাত্রপক্ষ । দেখতে এসেই পছন্দ। আর মুন্নি দেখতে অনেক সুন্দর। যে কেও দেখলেই পছন্দ হয়ে যাবে। দেখতে আসা ছেলেটি অনেক ধনী পরিবারের । মুন্নির পরিবার ঐদিন ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু ও হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলো । সময় মত হাসপাতালে নেওয়ার কারণেই আজ আমি মুন্নিকে পেয়েছি।
.
পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। আমাকে দেখা মাত্রই উঠে আসতে চেয়েছিলো । না, আমি ওকে উঠতে দেয় নি। ওর পাশে গিয়ে কান্নাচোখে বসলাম। আর ও বরাবরের মতোই আমার চোখের পানি দেখে কান্না জুড়ে দিল। জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, হয় আমি তোমার হবো নয় তো মরব। সেদিন মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মুন্নির বাবা-মা আমায় জামাই হিসেবে মেনে নিলো ।
.
আব্বু আম্মু যখন জানল মুন্নি এমন একটা পাগলামি করেছে সেই মুহুর্তে ওকে দেখতে এলো হাসপাতালে, ওর বাবা মার সঙ্গে কথা বলল। আর এক মূহুর্ত দেরি নয় । আগামীকালই ওদের বিয়ে ।
.
হ্যা, এভাবেই আমাদের বিয়েটা হয়। আমি অনার্স প্রথম বর্ষে ছিলাম আর মুন্নি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছিলো।
আমি আগে থেকেই টিউশনি করতাম। আর এই পাগলিটাকে জিবনের সাথে জড়িয়ে যাওয়ার কারণেই আরও তিনটা টিউশনি করি । টিউশনি থেকে মোট ৮ হাজার টাকা পেতাম।
.
আব্বু ছিলো স্কুলের শিক্ষক। আমি সহ আমার আরও দুই ভাইবোন লেখাপড়ত। তাদের খরচ, আমার খরচ দিয়ে সংসারটা কোনমতে চলে যেত। তার উপর আবার আমায় বিয়ে দিলো। আব্বু আমাকে বিয়ের কয়েকদিন পর বলেছিলো , দেখো বাবা তোমাকে বিয়ে দিয়ে এনেছি মেয়েটার ভালোর জন্য । আজ থেকে তুমি আমাদের সন্তান বটে কিন্তু আমি তোমাকে তোমার লেখাপড়ার জন্য কোন খরচ দিতে পারব না।
তোমার খরচের জায়গাটা আমি আমার বউমাকে দিলাম।
.
খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। আমি আমার লেখাপড়ার খরচটা টিউশনি করে চালিয়ে দিতাম। আর পরিবার থেকে আমার প্রাপ্যটা মুন্নির জন্য। এভাবে কোনমতে ভালোই চলছিলো দিনগুলো। মুন্নি আমার পরিবারের সাথে পুরোপুরিভাবে মিশে গিয়েছিলো। সারাদিন ছোট দুই ভাই বোনের সাথেই দুষ্টুমিতে মেতে থাকত।
.
মুন্নি আসাতে আমার পরিবারে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলো আমার আব্বু। অবশ্য তারও একটা কারণ আছে।
.
আমার আব্বুর বয়স যখন মাত্র দুই বছর। তখন তিনি তার পিতাকে হারান। আমার দাদি আব্বুকে সেই সময় থেকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। লেখাপড়া শিখেছেন।
আব্বু তার মা,কে ছাড়া কিছুই বুঝত না। অনেক ভালোবাসত আমার দাদিকে।
আমার বয়স যখন তিনবছর তখন আমার দাদি মারা যায়। আব্বু পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়ে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক সময় লেগেছিলো আব্বুর। আব্বু মাঝে মাঝে ঘুমের ঘরে মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠত। তখন সবারই ঘুম ভেঙ্গে যেত।
.
আমার দাদি দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো ঠিক মুন্নির মতো। আম্মু বলেছে মুন্নিকে দেখতে অনেকটায় আমার দাদির মতো । সত্য বলতে কি মুন্নির চেহারার গঠনটা প্রায় আমার দাদির মতো। পাড়ার কাকা-কাকিরা বলা বলি করতো আমার আব্বুর মা ফিরে এসেছে। এই বিষয়টা জেনে সত্যি আমি এবং আমার পরিবার অনেক খুশি ।
মুন্নিকে অনেক স্নেহ করে আমার আব্বু। মুন্নিও আব্বুর অনেক দেখাশোনা করত। স্কুলে যাওয়ার সময় জুতা জোড়া এগিয়ে দিতো। আব্বুর একটা অভ্যাস ছিলো স্কুলে যাওয়ার সময় চশমাটা ভুলে যাওয়া। সেইটা এখন আর হয় না।
.
আমার আম্মুকে কোন রকম কষ্ট করতে দিতো না। রান্নাবাড়া থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই করত মুন্নি। আম্মু ওকে এত কাজ করতে দিতো না। শাশুড়ি বউমা মিলেই করত।
.
ছোট বোনটাকে অনেক আদর করে মুন্নি। গোসল পর মাথার চুল বেঁধে দেওয়া থেকে শুরু করে কাপড় পড়িয়ে স্কুলে পাঠানো সবই মুন্নি করত। আর বোনটাও তার ভাবীকে ছাড়া থাকতে পারে না। সব সময় ননদ ভাবী মিলে দুষ্টামি, খেলাধুলা, হাসি-খুশিতে মেতে থাকে ।
.
ছোট ভাইটার কথা আর কি বলব, ও মাদ্রাসার ছাত্র। ভাবীকে যথেষ্ট সম্মান করে। মুন্নিও ওকে খুব স্নেহ করে। ভাইটা আমার খুব ঘুম কাতুরে। সকালে উঠতে দেরি করে। যার ফলে মাঝে মাঝে ফজরের নামাজটা মিছ করে ফেলে । কিন্তু মুন্নি আসার পর থেকে এটা আর হয় না। প্রতিদিন সময় মতো ঘুম থেকে ডেকে উঠাবে।
.
আমার কথা আর কি বলব। সপ্তাহে একবার আসতাম বাসায়। ও আমাকে কোন পাত্তায় দিতো না। সারাদিন পরিবার নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। অবশ্য এতে আমার মোটেই খারাপ লাগত না। বরংচ খুশি হওয়ার পরিমানটায় বেশি। মুন্নি আমাকে সব সময় বলত,, আমি তোমাকে পেয়ে যতোটা খুশি তার থেকে বেশি খুশি এত সুন্দর একটা পরিবারকে পেয়ে। এই পরিবারটার জন্য আমি আমার জিবনটাও দিতে রাজি।
.
সত্যি নিজেকে খুব বেশি ভাগ্যবান মনে হয় মুন্নির মতো একটা মেয়েকে নিজের অর্ধাঙ্গিনি হিসেবে পেয়ে। আমার আম্মু মাঝে মাঝে ফোন করে বলত, খুব বড় ভাগ্য না থাকলে এমন একটা বউমা পাওয়া যায় না। আম্মু ফোন করলেই শুধু মুন্নির প্রশংসা করত। মাঝে মাঝে আম্মুকে বলতাম আমার প্রশংসা করতে পারো না। আম্মু বলত, ভালো কাজতো জিবনে একটায় করছিস, এতো সুন্দর একটা বউমা উপহার দিয়ে। আর কোন ভালো কাজ জিবনে করেছিস যে তোর প্রশংসা করব।
.
পরিবারকে এতোটা খুশি দেখে নিজের ভেতর পরিতৃপ্তির এক ধরনের বাতাস বয়ে যেত। যা সবায় উপলব্ধি করতে পারে না। যেটা আমি প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করতে পারি। যখন শুনি পরিবারের ভালো থাকার কথা, তখনকার অনূভুতিটা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
.
এবার ঈদের ছুটিতে বাসায় যাচ্ছি। লম্বা একটা ছুটি। প্রায় এক মাস মতো।
টিউশনির টাকা থেকে নিজের খরচ বাদে জমানো টাকা দিয়ে আব্বু ও ভাইটার জন্য পাঞ্জাবী , বোনটার জন্য একটা জামা, আম্মুর জন্য একটা শাড়ি ও এক জোড়া স্যান্ডেল কিনেছি । মুন্নিটা না হয় পরেই জানবেন।
.
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে পৌঁছালাম। আব্বুকে পাঞ্জাবীটা ও আম্মুকে শাঁড়ি দিতেই দিলো এক ঝাড়ি। সবারই একই কথা কে বলেছে এসব করতে। আম্মু বলেছে, এমন করার আগে অবশ্যই জানাবি বাবা। আগে চাকরি-বাকরি কিছু একটা কর তারপর না হয় দিস।
ছোট ভাই বোন ঈদের জামা, পাঞ্জাবি পেয়ে অনেক খুশি।
.
.
রুমে যাওয়ার সাথে সাথেই মুন্নি আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
.
__ বলতে পারো তুমি এতো ভালো কেন?
__ কেন পারব না, তোমার জন্য ।
__ হয়েছে হয়েছে, এবার খেতে আসেন। খাবার রেডি করেছি ।
__ যাবো, তার আগে একটা কাজ করো ।
__ কি কাজ?
__ ব্যাগের চেইনটা খুলে দেখো তো ব্যাগে কিছু আছে কি না?
.
মুন্নি ব্যাগের চেইনটা খুলল। ভেতর থেকে একটা নীল শাঁড়ি বের করে আনলো । হ্যা, মুন্নির নীল রং অনেক পছন্দ। ওর পছন্দ মতোই একটা নীল শাঁড়ি কিনেছি ।
.
__ পছন্দ হয়েছে তোমার?
__ না হয় নি। তোমাকে আমি কিনতে বলেছি?
__ বাহ! রে স্বামী হিসেবে আমার কি কোন দায়িত্ব কর্তব্য নেই যে তোমার বলতে হবে।
পছন্দ না হলে ফেরত দিয়ে আসি, অন্য রঙ্গের একটা নিয়ে আসবো।
__ কতো টাকা দিয়ে কিনেছো?
__ খুবই অল্প দাম।
__ বলতে বলছি বলো।
__ মাত্র ১৭০০ টাকা।
__ তুমি জানো এই টাকা দিয়ে ৫০০ টাকার তিনটা শাড়ি হতো। অনেক দিন পড়তে পারতাম।
__ প্লীজ এভাবে বলো না। তোমাকে দিতে পেরেছি এটাই আমার স্বার্থকতা। ব্যার্থতা এই যে তোমাকে এর থেকেও দামি শাঁড়ি দিতে পারি নি।
__ আমার কিছুই চায় না সোনা। তুমি আমাকে এত সুন্দর একটা পরিবার উপর দিয়েছো এটাই আমার সর্বকালের বড় পাওয়া। আমার আর কোন কিছুর দরকার নেই।
.
জড়িয়ে ধরলাম পাগলিটাকে। সুখের আবেশে চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। পরক্ষনেই মুছে ফেললাম। জানি, আমার চোখের পানি দেখলে ও আবারও কান্না শুরু করবে।
মুন্নি আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবার ব্যাগ দেখতে লাগল। কি যেন খুজছে।
.
__ তুমি তোমার জন্য কিছু আনো নি?
__ আনতে হবে কেন , গত ঈদের কাপড় তো আছে।
.
দেখলাম রেগে আগুন হয়ে আছে। সরাসরি আব্বুকে নালিশ দিলো।
__ আব্বু , আব্বু, আপনার ছেলে নিজের জন্য কিছু আনে নি।
.
আব্বু আমাকে দিলো এক ঝাড়ি।
বলল, তুমি কালকেই আমার সাথে বাজারে যাবে। ভাবছিলাম তোমার পেছনে কিছু খরচ করব না। কিন্তু তুমি বাধ্য করলে।
আমি আব্বুর কথার উপর না করতে পারলাম না।
এদিকে মুন্নি মিটমিট করে হাসছে।
.
♥কি নাম দিবো আমার এই পরিবারের। হ্যা নামটা অবশ্যই সুখের হবে। যে পরিবার হাসি-খুশি, আনন্দ আর অনাবিল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে সেই ফ্যামিলীর নাম তো অব্যশই সুখের হবে ।♥⚘⚘

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url