হানিমুনেরন গল্প

বিয়ের আগে বুঝিনি যে অনিকের ভেতরে রোমান্টিকতা একেবারেই নেই। এমনিতে অবশ্য আমিও বেশী আহ্লাদীপনা পছন্দ করিনা। কিন্তু তবুও নতুন বিয়ে হ‌ওয়া প্রতিটা মেয়েই চায় তাদের বর তাদের সাথে একটু রংঢং করুক। হাতে হাত রেখে বলুক, ''তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি এ জীবনে কখনো দেখিনাই!" বা "তুমি চুলটা খোলা রাখবা সুন্দর লাগে।" অনিক এসবের ধারে কাছে নাই।
বিয়ের দুইদিন পর গম্ভীরমুখে অফিসে যাবার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছে এই সময় ওর মা এসে অবাক হয়ে বললেন, "এখন কিসের অফিস?"
অনিক বিরক্ত স্বরে বললো, "ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে!"
আমার শ্বাশুড়ি আরো বিরক্ত হয়ে বললেন, "দুইটা দিন তুমি অফিস ছাড়া থাকতে পারছো না? নতুন ব‌উ রেখে অফিসে যেতেই হবে?"
অনিক রাগত স্বরে বললো, "তো কি করবো? নতুন ব‌উ কোলে নিয়ে বসে থাকার সময় আমার নাই!"
বলেই গ্যাটগ্যাট করে বেরিয়ে গেল। আমি লজ্জায় শ্বাশুড়ির চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না।
কিছুদিন পার হতেই আমি বুঝতে পারলাম এই ছেলের কাছ থেকে কিছু আশা করা বৃথা। সে ভ্যালেন্টাইস ডে তে ফুল দিবে না, বার্থডের দিন রাত বারোটায় কেক আনবে না,অফিস থেকে ফেরার পথে বেলি ফুলের মালা নিয়ে এসে মাথায় গুঁজে না দিয়ে ফোন করে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করবে, "বাড়িতে কাঁচাবাজার কিছু লাগবে?"
আমার এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হলো যেদিন আমি একটু রেগে গিয়ে ওকে বললাম, "আজ টেডি ডে, আমার বান্ধবীদের বরেরা সবাই তাদের টেডি গিফট করেছে তুমি করোনাই!
সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, "আমি কিভাবে করবো? তোমার বান্ধবীদের কি আমি চিনি?"
এরপর আমার আর কিছু বলবার র‌ইলো না। আমি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে কাঁদতে আম্মুকে ফোন দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার দিকের আত্নীয়স্বজনে বাড়ি ভরে গেল।
আমি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিচার দিলাম, "অনিক আমাকে ভালোবাসে না। আমার সাথে থাকতে ওর ভালো লাগেনা। ওকে বাসা থেকে জোর করে বিয়ে না দিলে বিয়েও করতো না আমারে!"
অনিকের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমার ফুপু এক রামধমক দিয়ে বললেন, "কেন গো জামাই? আমাদের এত সুন্দর মেয়ে তোমার ভালো লাগেনা? পছন্দ না হলে বিয়ে করলা কেন? আমাদের মেয়ের কি ছেলের অভাব হ‌ইতো? হ‌ইতো না! আমার ননদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার তার সাথে দিতাম।"
অন্যদিক থেকে ফুপা মিনমিন করে বললেন, "নিশ্চয়ই অন্য কোন কাহিনী আছে। আদার লেডি এট্রাকশন.. পরকিয়া টরকিয়া করছে।"
ফুপু হাতে কিল দিয়ে বললো, "রাইট! এটাই হবে!"
অনিকের মা দুঃখী দুঃখী গলায় বললো, "এইসব কি বলেন বেয়ান! আমার ছেলের কোন মেয়েমানুষের ওপর কোনো আকর্ষন‌ই নাই। সে ছোটবেলা থেকেই এরকম। পড়াশোনা নিয়ে থাকে,চাকরি পাবার পর কাজকর্ম নিয়ে থাকে। একটু কম রোমান্টিক কিন্তু ছেলের চরিত্র খারাপ না! এতবড় অপবাদ দিয়েন না।"
আমার আত্নীয়স্বজন কোন কথাই শুনলো না। আমাকে নিয়ে বাড়ি চলে এল।
এদিকে অনিক রোমান্টিক না হতে পারে কিন্তু আমি তো ওকে ভালবাসি! দিনের পর দিন ওকে ছাড়া থাকতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তারচেয়েও রাগ উঠছে অনিক একবার‌ও আমাকে ফোন দিয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করছেনা। এরমধ্যে সে শুধু একদিন ফোন দিয়েছে।
আমি বাথরুমে ছিলাম। ফোনের আওয়াজ শুনে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে‌ ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ও গম্ভীর গলায় বললো,
"আমার সাদা পাঞ্জাবিটা কোথায় রেখেছো? ভেতরে হালকা ফুল দিয়ে ডিজাইন করা।"
আমি কোনমতে নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করলাম, "কেন কি করবা?"
"বন্ধুর আকদ! সেখানে যাবো"
আমি হাহাকার করে উঠলাম, "বাহ! তুমি তো ভালোই আছো! সুখে আছো! বন্ধুর বিয়ে খাচ্ছো! আমার কথা একবার‌ও মনে পড়েনা?"
অনিক সহজ স্বরে বললো, মনে না পড়ার কি আছে। ব‌উ ছিলা তুমি। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে।
-মনে যদি পড়ে ফোন দাও না কেন?
:আজব তো! মনে পড়লেই ফোন দিয়ে তোমাকে ইনফর্ম করতে হবে যে মনে পড়েছে?
আমি ফোন রেখে দিলাম। আইফোন না হলে ফোনটা একটা আছাড় দিতাম। আইফোন বলে আছাড় না দিয়ে ফোন অফ করে দিলাম। যদিও তার দরকার ছিল না। অনিক বারবার ফোন দিয়ে আমাকে বিরক্ত করবে এই আশা করাও বৃথা।
আমাদের কেস কোর্টে উঠেছে। আমি তুলিনাই। আমার ফুপুই দায়িত্ব নিয়ে তুলেছেন। ফুপু আমার ডিভোর্স করিয়ে তার ননদের ছেলের সাথে বিয়ে দিবে। অনেক কষ্টে ননদকে রাজি করিয়েছেন।
জজ সাহেব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি ওনার সাথে থাকতে চান না?"
আমি ইতস্তত করে বললাম, "চাই! তবে একটু রোমান্টিক হলে!"
জজসাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলেন। তারপর অনিককে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনার কিছু বলার আছে?"
অনিক গম্ভীর গলায় বললো, "আমি আর কি বলবো বলেন! রোমান্টিক কিভাবে হয় আমার জানা নাই। তাছাড়া আমার দিক থেকে তো কোন রেস্ট্রিকশন নাই। থাকলে থাকবে,না থাকলে ডিভোর্স চাইলে দিবো।"
আমি চিৎকার করে উঠলাম, "এইটাই তোমার সমস্যা! না থাকলে জোর করবা না কেন? আমি তোমার ব‌উ না! হাত ধরে নিয়ে যেতে পারো না?"
অনিক আরো জোরে চিৎকার করে বললো, "বাচ্চা নাকি তুমি যে হাত ধরে কোলে করে নিয়ে যাবো! এডাল্ট মেয়ে! থাকতে না‌ চাইলে আটকাবো কেন?"
আমি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে জজ সাহেবের কাছে বিচার দিলাম, "স্যার! আমি চলে গেলে ও আরেকটা বিয়ে করবে!"
এদিকে জজ সাহেব ঠাস ঠাস করে টেবিলে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছেন আর বলছেন, "সাইলেন্স! সাইলেন্স!! সাইলেন্স!!!"
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "আপনার মামলা জোরদার না। আপনি নিজেই জানেন না কি করবেন। একবার বলেন থাকবো,একবার বলেন‌ রোমান্টিক না হলে চলে যাবো। আপনারা সময় নিন। নিজেরা আগে ঠিক করেন কি করবেন। যান বাড়ি যান।"
আমরা যার যার বাড়ি চলে গেলাম। বাড়ি গিয়ে ফুপুর কাছে অনেক ঝাড়ি খেলাম। আমার দোষে আমরা কেস হারবো,আমার জীবন নষ্ট হবে ইত্যাদি।
এরমধ্যে অনিকের মা ফোন দিয়ে বললেন, "মা তুমি কান্নাকাটি ক‌ইরোনা আমি আমার ছেলেরে বুঝিয়ে বলছি।"
সারাদিন আমি খাই নাই। দরজা বন্ধ করে কেঁদেছি। সন্ধ্যার পর মা এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো, অনিক এসেছে। তোকে ডাকে।
আমার আবার রাগ উঠে গেল। কেমন একটা বর! দরজায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়বে তা না!....
ড্রয়িংরুমে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলাম। অনিক চার পাঁচটা বড়বড় টেডি এনেছে। পান্ডা,বিড়াল,কুকুর দিয়ে ছড়াছড়ি। সেইসাথে গোলাপ এনেছে শখানেক। চকলেট এনেছে, ব‌ই এনেছে, মেকআপ আইটেম এনেছে।
আমি ঘরে ঢুকতেই আমার হাত ধরে বললো,‌ "চলো। টিকিট কাটা আছে,ব্যাগ গুছাও।"
আমি অবাক হয়ে বললাম, "কোথাকার?"
অনিক গম্ভীর স্বরে বললো, "হানিমুন। অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েছি এরমধ্যে ঘোরাঘুরি সারবা। আর এই নাও তোমার টেডি ফেডি যা চাইছিলা। ফেরত চলো‌, রোমান্টিক তো হ‌ইছি আর কত!?"
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url