Breaking News

বাবা মানে দুই বর্ণের শব্দ

বিয়ের প্রথম রাতে আমার স্বামী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার বাবা কিভাবে মারা গিয়েছেন?”
তার সরাসরি প্রশ্নবাণে আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম! হঠাৎ পুরুষকণ্ঠে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছি। মুহূর্তেই ঘোমটার ভেতরে উত্তপ্ত হাওয়ার উপস্থিতি বোধ হতে লাগল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা জড়ো হতে থাকে। অঢেল জড়তা এসে চেপে ধরে ঠোঁটজোড়ায়! সেই জড়তা কাটিয়ে উত্তর দেওয়া হলো না। অনেকটা সময় নিরুত্তরে বসে রইলাম। তিনি বোধ হয় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন। স্থির অবস্থায় উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন৷ অপেক্ষা ব্যর্থ হতে চলেছে আঁচ করতে পেরে আমার সমুখে এসে দাঁড়ালেন। ভ্রু বাকিয়ে নীরব ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার উপর। যেন লাল টকটকে সুতোর ঘন বুননের শাড়ী ভেদ করে আমাকে দেখছেন!
আমার পানির তৃষ্ণা গলা ছেড়ে বুকে বয়ে চলেছে। যেকোনো সময় খরা সৃষ্টি হতে পারে বুকের পাটাতনে। এমন অদ্ভুত অস্বস্তি কাটিয়ে উঠাও কঠিনত্ব ঠেকল। কানের কাছে তার বিরক্তে ছেড়ে দেওয়া নিশ্বাসের অস্পষ্ট শব্দ আমার অন্তরে বাড়ি দিচ্ছে! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। ভয়ে আরো বেশি কুঁকড়িয়ে যাচ্ছি। অন্তর কণ্ঠ চিৎকার করে একটিবার মা ডাকার অনুমতি চাচ্ছে। কী অদ্ভুত! সেই অনুমতিটাও কেন জানি দিতে পারছিলাম না৷
“তুমি কথা বলতে পারো না?”
দূরের কণ্ঠটা অতি নিকটে এসে দ্বিতীয় দফায় বেজে উঠায় আমি ভীষণ চমকে উঠি। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল,রূহটা বেরিয়েই পড়বে! ভয় মিশ্রিত চমকপ্রদে আমার শিরদাঁড়া টান টান হয়ে পড়ে। ঘোমটার ভেতর থেকেই অতিকষ্টে ঠোঁট নাড়াতে সক্ষম হলাম। অস্পষ্ট গলায় বললাম,
“অসুখ করেছিল।”
“কী অসুখ?”
তার অতি দ্রুত প্রশ্নে আমার কণ্ঠস্বর ক্ষনিকের জন্য থেমে গেল। অনুভব করলাম কণ্ঠনালী কাঁপছে! হাতদুটোও। মুষ্ঠিবদ্ধে আটকে থাকা শাড়ীর অংশ ছুটে গিয়েছে। পুনরায় খামচে ধরার শক্তিটুকুও নেই যেন। চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল বার বার। আমার ভীত মনে আম্মুর হাসি মুখটি উদয় হলো। চোখের পাতায় পাতায় ভেসে উঠে দুদিন আগের ঘটনা। সেদিন আমি কাঁদছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে চোখের চারপাশ ফুলে গিয়েছিল। রাত যত গভীর হচ্ছিল আমার কান্নার দমক তত বাড়ছিল। সেই সময় আম্মুর মমতামাখা হাত পড়ে আমার মাথায়। স্নেহের স্পর্শ পেয়েই আম্মুকে জড়িয়ে ধরি। অঝরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলি,
“আমি ভাবির নেইলপলিশ নেইনি,আম্মু!”
আম্মু সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না। আমাকে কাঁদতে দিল কিছুক্ষণ। অনেক্ষণ পর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,
“রুমি বকা দিছে?”
আমি আম্মুর বুক থেকে মাথা তুললাম না। সেখানে মুখ গুঁজেই ফুঁপিয়ে উঠে বললাম,
“না। ভাইয়া বকেছে। ঐ রুমে যেতে মানা করেছে।”
কথাটা শেষ করতেই আমার চোখ দুটো জলে পূর্ণ হয়ে উঠে। ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে দেই। আম্মু কিছু বললেন না। শক্ত হাতে মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে রাখল অনেক্ষণ। নীরব সময় অতিবাহিত করে সহসা বলল,
“আমাদের রুমে দরজা নেই দেখে তোর খুব খারাপ লাগে তাই না?”
ততক্ষণে আমার কান্না অনেকটাই কমে এসেছিল। মায়ের উদাস গলার প্রশ্নে আমি মাথা তুলে তাকালাম। কিছু বলার আগেই আম্মু বলল,
“তোর যদি এমন একটা রুম হয় যেখানে অবশ্যই একটি দরজা থাকবে। সাথে আরেকটা জিনিস থাকবে..”
“কী জিনিস?”
আমার কৌতুহলি প্রশ্নে আম্মু মৃদু হাসল। এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেই রুমের কর্তৃত্ব।”
“মানে?”
আমার প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আম্মু চেয়ে থাকে অনেক্ষণ। তারপর বলল,
“বউ সাজবি?”
আম্মুর মুখে বউ শব্দটা শুনে আমার হৃদয় কেঁপে উঠেছিল। আমার বয়সটা খুব বেশি নাহলেও পুতুল খেলার বয়সটা পেরিয়ে এসেছিলাম অনেক আগে। কয়েকদিন আগেই তো সতেরোতে পা দিয়েছিলাম। আম্মুর রহস্য করে কথা বলার মানে খুব সহজেই ধরে ফেলি। রাগ নিয়ে আম্মুর কাছ থেকে সরে আসতে চাইলাম। পারলাম না। আরো শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
“আমি তোর সংসার দেখতে চাই,দুচোখ ভরে তোর সুখ দেখতে চাই। মাথার উপর একটা পুরুষ হাত দেখতে চাই রে মা। বয়স তো আর কম হয়নি! এই অসুখ,সেই অসুখ লেগেই থাকে। কোন দিন জানি চোখ মেলে দেখবি,আমি মরে পড়ে আছি তখন? তখন তোর কী হবে? আমি তো মরেও শান্তি পাব না। রাজি হয়ে যা,মা!”
আমার শুকিয়ে যাওয়া চোখ দুটো আবারও ছলছল করে উঠল। ঠিক কোন কথাটার জন্য বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আম্মুর কাছ থেকে সরে আসতে পারলাম না। উপরন্তু আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ঝাপসা কণ্ঠে বললাম,
“তোমাকে ছাড়া আমার দরজাওয়ালা রুম লাগবে না,আম্মু। আমার সব চাওয়া তোমার মধ্যেই পরিপূর্ণ!”
আমার ঝাপসা কথাটা আম্মু বুঝতে পারেনি হয় তো। নাহলে দুই দিনের মধ্যেই কি পাত্র খুঁজে এই এত দূর,অপরিচিত মানুষটার সাথে পাঠিয়ে দিতে পারে? আমি ভাবনার মধ্যেই শিউরে উঠলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো অপরিচিত মানুষটা আমার সামনেই বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টি এখনও আমার মধ্যেই নিবদ্ধ। আমি শুকনো ঢোক গিলে নিভুসুরে বললাম,
“আম্মু বলেছিল,বড় রোগ হয়েছিল। কী রোগ সেটা বলেনি।”
“আম্মু বলেছিল মানে? তুমি দেখনি? তিনি কত বছর আগে মারা গিয়েছেন? তখন তোমার বয়স কত ছিল?”
সামনে থেকে তড়িৎগতির প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যাই। ভয়ের সাথে কিছু রাগও যোগ হচ্ছে। সে আমার অপরিচিত মানে,আমিও তার অপরিচিত। পরিচিত পর্ব তো অন্যভাবেও হতে পারতো। এমন গম্ভীর আর কঠিন প্রশ্নে কেন হচ্ছে? তাহলে কি মানুষটার কণ্ঠের মতো সবকিছুই গম্ভীর? আমি উত্তর দেওয়ার পূর্বেই তিনি আবার বললেন,
“তুমি এত নরমস্বরে কথা বলছো যে,আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। তার মধ্যে একেকটা উত্তরের মধ্যে আধঘন্টা,একঘন্টা সমান বিরতি নিচ্ছো! ঘোমটা সরাও,হয় তো বুঝতে সুবিধা হবে।”
আমি আড়ষ্টভঙ্গিতে ঘোমটা সরালাম। মাথা তুললাম না। বিছানার লাল,সাদার কারুকার্যে তাকিয়ে থেকে বললাম,
“আম্মু বলেছিল,আমার বয়স তখন ছয় মাস। সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছিলাম।”
আমি আমার উত্তরটা তার সামনে রেখে চুপ করে রইলাম। তার পরবর্তী প্রশ্নের অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু না এবার সে সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রশ্ন করেনি। অন্য কিছুও বলল না। আমি একটু অবাক হলাম। তার দিকে তাকানোর আগ্রহ তৈরি হলো। কোন দিকে চেয়ে আছেন? কী আশ্চর্য! এতক্ষণ ঘোমটার আড়ালে থেকেও তার চলনভঙ্গিসহ সব কিছুই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম অথচ এখন? কিছুই বুঝতে পারছি না। এভাবেই মিনিট কয়েক পার হল। নীরবতা তিনিই ভাঙলেন। বললেন,
“আমার বাবা দুই বছর হলো মারা গিয়েছেন। রোড এক্সিডেন্টে!”
তার কণ্ঠস্বর করুণ শোনায়। আমার কোথাও একটা তীক্ষ্ণ ছুঁচ বিঁধল! মনের সকল কোণ পূর্ণ হলো গভীর মায়ায়। সে মায়া নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে নয়,অন্য দিকে চেয়ে আছেন। দৃষ্টি অনুসরণ করতে দেয়ালে চোখ আটকাল। কাঁচের ফ্রেমে একজন ষাটোর্ধ বয়সের গম্ভীরমুখ বন্দী। থমথমে মানুষটার মধ্যে আমি আমার স্বামীকেই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। যদিও এখনও মুখটা দেখা হয়নি। অর্ধেকাংশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আমি ধীরস্বরে বললাম,
“উনি আপনার বাবা?”
তিনি মাথা নাড়লেন। আমার দিকে ফিরলেন না। সেই দিকে চোখ রেখেই গভীর নিশ্বাস টানলেন। আড়ালে চোখ মুছলেন কি?
“হুম। আমার পৃথিবীর দিবারাত্রির সূর্য ছিলেন তিনি। হঠাৎ সব আঁধার করে অস্ত গেলেন। সব কিছু অগোছালো হয়ে গিয়েছিল আমার। এখনও অগোছালোই। কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারিনি। তার মধ্যে মা আবার তোমাকে..”
কথাটা শেষ করলেন না। চতুরতাসহিত আড়াল করে বললেন,
“তোমার বাবর কথা মনে পড়ে না?”  “না।”
তিনি চমকালেন। তার চমকানোটা স্পষ্ট ধরা পড়ল আমার কাছে। কিন্তু কেন চমকালেন বুঝতে পারলাম না। উত্তরটা পছন্দ হয়নি নাকি সঙ্গ সঙ্গে উত্তর পেলেন বলে?
তিনি পুনরায় একই প্রশ্ন অন্যভাবে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি,তোমার বাবাকে মিস করো না?”
আমি এবারও দ্রুত উত্তর দিলাম,  “না।”
এবার তিনি শুধু অবাকই নয়,প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হলেন। উত্তরটা তার একদম পছন্দ হয়নি বোঝা যাচ্ছে। তারমতে,আমার উত্তর হ্যাঁ হওয়া উচিত ছিল। তিনি বিরক্ত নিয়ে বললেন,
“কেন?”
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। জড়তা কাটিয়ে উঠেছি অনেকটাই। হঠাৎই অনুধাবন করতে পারছি,তার সাথে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগছে। ভালো লাগাটাকে আরো বাড়াতে দ্রুত উত্তর দিলাম,
“মিস তো তাকেই করা হয়,যার সাথে পূর্বে অল্প কী বেশি সময় কাটানো হয়। অতঃপর অল্প কী বেশি সময়ের জন্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়! আমার তো তেমন হয়নি,তাহলে কেন করব?”
আমার কথা শুনে তিনি আমার দিকে পূর্ণ চোখে তাকালেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন,
“তুমি বলতে চাচ্ছো,তোমার কখনোই বাবার কথা মনে পড়ে না? কষ্ট হয় না? দুঃখ হয় না? অভাববোধ হয় না?”
আমি মাথা দুদিকে নাড়লাম। তিনি আমার দিকে ঘুরে বসলেন। একপা ভাজ করে বসেছেন। অতিশয় আগ্রহ নিয়ে বললেন,
“অন্যের বাবারা যখন তার মেয়েদেরকে আদর করে,ভালোবাসে,এটা-সেটা কিনে দেয়,তোমার চোখে পড়লে খারাপ লাগে না?” আমি এবারও মাথা নাড়লাম। সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বললাম,
“না। তার জন্য তো আমার ভাই ছিল।”
“ভাইয়ের আদর আর বাবার আদর কি এক হলো?”
“আমি কী করে বলব? যে জিনিসটা আমি কখনও পাইনি সে জিনিসটাকে তুলনায় আনব কী করে? আমার কাছে যা ছিল তাই সর্বশ্রেষ্ঠ। তবে..”
“তবে?”
উনার প্রশ্ন শুনে আমি তার মুখপানে চাইলাম। গম্ভীর মুখটাতে সীমাহীন কৌতুহল। কণ্ঠে অস্থিরতা! আমি বুঝতে পারলাম এই উত্তরটাও আমাকে দ্রুত দিতে হবে। উনার ধৈর্য্যশক্তি পূর্বাপেক্ষা অনেকটাই কমে এসেছে। আমার মায়া হলো। বললাম,
“দুই বছর আগের ঘটনা। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। রেজিস্ট্রেশনের ডেট চলে এসেছে। আমি বাসায় গিয়েই আম্মুকে জানালাম। তখন ভাইয়া নতুন বিয়ে করেছেন। আম্মু রেজিস্ট্রেশনের টাকা চাইতে,ভাইয়া মুখ কালো করে কিছু একটা বলল। আম্মু মাথা নত করে চলে আসছিল তখনি পেছন থেকে ভাবি এমন কিছু বলল যে,আম্মু রুমে এসেই আমাকে বলল,’তোর পরীক্ষা দিতে হবে না। চুপচাপ পড়ে থাক।’ আমি ভীষণ অবাক হলাম। আম্মুকে রেখে আমি নিজে ভাইয়ার কাছে যেতে চাইলাম।
আম্মু দিল না। রাগ দেখাল। দুইটা থাপ্পড় মারল! আমি কান্না করলাম। সারারাত কান্না করলাম। তাও আম্মুর মন গলেনি। তার পরের দিনগুলো আমাকে রুম থেকে বের হতে দেইনি। রেজিস্ট্রেশনের শেষ দিনে আমি লুকিয়ে ভাইয়ার কাছে যাই। ভাইয়া ছিল না,ভাবির কাছে টাকা চাই। ভাবি কিছু বলার আগেই আম্মু চলে আসে। আমাকে এলোপাথাড়ি চড় লাগাতে শুরু করে। আমার খুব কষ্ট হয়।
রাগ হয়,অভিমান হয়। আম্মুর সাথে কথা বলিনি অনেক দিন। আম্মুও আমার রাগ ভাঙাতে আসেনি। এক সকালে আমি বাসা থেকে বের হলাম। রাস্তায় আসতে আন্নার সাথে দেখা। সেও এসএসসির পরীক্ষার্থী ছিল। কিন্তু শেষ টেস্ট পরীক্ষায় চার সাবজেক্টে ফেল। শুনেছিলাম তাকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে না। তার মধ্যে তাদের জীবন ব্যবস্থাও ছিল অনেক খারাপ। ওর বাবা দিনমজুর ছিল। এত টাকা কোথায় পাবে? আমরা ভেবেছিলাম হয় তো ওর আর পড়া হবেই না।
কিন্তু ও কে দেখে আমি ভীষণ অবাক! ওর পড়নে আকাশী রঙের নতুন ইউনিফর্ম,পায়ে সাদা চকচকে সু,হাতে ফাইল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম ও পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা সাবজেক্টের জরিমানাসহ দ্বিগুন টাকা দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে দিয়েছে ওর বাবা। আমার মন খারাপ হল! এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো,ওর মতো যদি আমার একটা বাবা থাকতো!”
আমার কথা শেষ হতেই উনি বললেন,
“এটাই হলো অভাববোধ। এবার স্বীকার করো তুমি তোমার বাবাকে মিস করো,তার অভাববোধ অনুভব করো।”
তার আত্ববিশ্বাসী কথায় আমি সামান্য হাসলাম। তারপর বললাম,
“না। এটা অভাব নয়,ক্ষনিকের আফসোস! আমার ভাই যদি আমাকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিত তাহলে এই মুহূর্তটা আমার সামনে আসতোই না। ভাইয়ের প্রতি আক্ষেপ,আক্রোশও বলতে পারেন।”
“তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো,যে বাবার আদর-ভালোবাসায় বড় হয়েছে শুধু তারাই বাবার অভাববোধ করে? অন্যরা করে না?”
“আমার জানা নেই। তবে আমাকে দিয়ে উদাহরন দিলে তাই।”
তিনি ভ্রূ কুটিয়ে নিলেন। তার যে এই উত্তরটাও পছন্দ হয়নি খুব বুঝতে পারলাম। আমার আবারও মায়া হলো। এই মানুষটাকে সন্তুষ্ট করতে ইচ্ছে হলো। কিন্ত উপায় কী? তার মনমতো একটা উত্তরও যে আমার কাছে নেই। আমার মন খারাপ হলো। মন ভার হলো! তিনি কী বুঝলেন কে জানেন। সহসা বললেন,
“শুয়ে পড়ো। রাত অনেক হয়েছে। একটু পর ফযরের আযান পড়বে।”
তিনি লাইট বন্ধ করে দিলেন। অন্ধকারে আমি বুঝতে পারলাম,তিনি আমার পাশেই শুয়েছেন। ছটফট করছেন। এপাশওপাশ করছেন। আমি শূন্যে তাকালাম। অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে বললাম,
“আমার আম্মু প্রায়ই বলতেন,আমার ভাইয়ের মাঝেই আমার বাবার বসবাস। একি সাথে সে দুটো দায়িত্ব পালন করবে। বাবার মতো ভালোবাসবে আবার ভাইয়ের মতো। কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমি ভাইয়ার মধ্যে কখনোই বাবাকে খুঁজিনি। সবসময় চেয়েছি ভাইয়ার মতোই ভালোবাসুক,আদর করুক,শাসন করুক,রাগ করুক। কিন্তু! হঠাৎই কেমন জানি আমার ভাইয়াটা হারিয়ে গেল।
আমি অভাববোধ করতে শুরু করলাম। বাবার নয়,ভাইয়ার অভাববোধ! আমার কী মনে হয় জানেন? একজনের মতো আরেকজন নয়,নিজের সম্পর্কটাকেই পরিপূর্ণভাবে একাগ্রচিত্তে পালন করা উচিত। এতেই সামনের মানুষটির দুঃখ লাঘব হবে। উপরন্তু অন্য অভাবটাও পূরণ হয়ে যাবে। মানুষ ভালোবাসা চায়,শক্ত ও নিরাপদ আশ্রয় চায় সেটা যে কারো দ্বারা হতে পারে। বাবা,মা,ভাই,বোন,স্বামী!” উনার নড়াচড়া থেমে গেল। আমি আবারও তার চলনভঙ্গি এমন কি তার ভেতর/বাহির সবকিছু অনুভব করতে পারছি। অন্ধকারেও যে উনি আমার দিকেই চেয়ে আছেন বুঝতে পারছি। আমি পূর্বের কথার সাথেই জোড়া দিয়ে শেষ করলাম,
“তবে কেউ কারো মতো না। সম্পর্কের নামগুলো যেমন আলাদা হয় ভালোবাসার ধরনও আলাদা। কিন্তু সেটা সাধারনের চক্ষুতে। খুব গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে শেষে গিয়ে সব এক জায়গায় মিলেছে!”
আমি প্রগাঢ় নিশ্বাস ছাড়লাম। চোখ বন্ধ করে নিলাম। মনের কোনো এক কোণে নতুন অভাববোধের সৃষ্টি হচ্ছে। সেটা কী? আগে তো ছিল না। আমার ভাবনা পথেই উনি জিজ্ঞেস করে বসলেন,
“তাহলে তোমার কাছে বাবা মানে কী?” আমি চোখ বন্ধ করেই উত্তর দিলাম,
“আমার কাছে বাবা মানে দুই বর্ণের শব্দ। যেখানে আদর,ভালোবাসা,রাগ,অভিমান,কষ্ট,দুঃখ,সুখ,অসুখের কোনো ছিটেফোঁটা নেই!”
তার দিক থেকে আর কোনো প্রশ্ন আসল না। নীরব থেকে আরো নীরবতা ঢেকে নিল আমাকে। চোখের কোণে জলের উপস্থিতি টের পেলাম। অন্তরকণ্ঠকে অনুমতি দিলাম একবার ‘আম্মু’ বলে ডাকতে। না একবার নয়,অসংখ্য বার!
ভোরের নরম আলো চোখ ছুঁয়ে দিতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরে দেখি উনি নেই। আমি শাড়ি পাল্টাতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ি। ঠান্ডা পানির দীর্ঘ গোসল সেরে বের হতে দেখি,আমার শ্বাশুড়ি বিছানায় বসে আছেন। তার চোখে,মুখে চিন্তার ভাঁজ! আমাকে দেখেই যেন অনুশোচনায় ফেটে পড়লেন। অপরাধীমতো বললেন,
“শাহেদ চলে গিয়েছে।”
আমি প্রশ্নচক্ষুতে তাকালাম। নামটির সাথে আমি পরিচিত নই। তিনি বুঝলেন। বললেন,
“তোমার স্বামীর নাম শাহেদ। আমার ভুল ছেলেটার অনিচ্ছাতে বিয়েটা দেওয়া উচিত হয়নি। আমি ভেবেছিলাম বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। শাহেদের বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা এতোটাই ভেঙে পড়েছিল যে,এ বাড়িতে আসায় বন্ধ করে দিয়েছে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। আবার শুনেছি চাকরিও নিয়েছে। ওর বাবা কি কম রেখে গিয়েছে? কী দরকার এত কষ্ট করার? আমার কথা কে শোনে? কিছু বললেই বলে,বাবার চলে যাওয়াটা আমি মানতে পারিনা,আম্মু। যেখানে বাবার স্পর্শ আছে, সেখানে গেলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। তুমি আমার কাছে চলে এসো। তারমতো নাহলেও আমার মতো তোমাকে সুখে রাখার চেষ্টা করব। কিন্তু ছেলেকে কী করে বুঝাই? স্বামীর স্মৃতিতেও স্ত্রী সুখ খুঁজে নেই। কল্পনায় তার উপস্থিতি অনুভব করে! সেই স্মৃতি ছেড়ে,সুখ ছেড়ে যাওয়া যে আমারও মৃত্যু সমতুল্য!”
তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। তারপর বললেন,
“অনেক দিন ধরেই বিয়ে করানোর চেষ্টা করছিলাম। রাজি হচ্ছিল না কিছুতেই। শেষে তোমার ছবি দেখিয়ে যখন বললাম,তোর মতো এই মেয়েটিরও বাবা নেই। বড় দুঃখী! শুরুতে একটু না না করলেও শেষে রাজি হয়। মত যাতে পাল্টে না যায় তাই অল্প সময়েই বিয়ে পড়িয়ে তোমাকে নিয়ে আসি। আমি ভেবেছিলাম,এবার বুঝি ছেলে মায়ের কোলে ফিরল! কিন্তু কোথায় কী? বিয়ের বয়স একদিন পার হওয়ার আগেই বাড়ি ছাড়ল। আমাকে ক্ষমা করে দিও বউমা!”
তিনি চলে যেতেই আমি ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ি। দরজার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করি,
“দরজাওয়ালা রুম,সেই রুমের কর্তৃত্ব,সংসার সব পেয়েছি,আম্মু। কিন্তু মাথার উপর শক্ত হাত,আর কপালে সুখ দুটোর একটাও নেই। তোমার পোড়াকপালি মেয়ের দুঃখটা দু-চোখ ভরে দেখতে পারবে তো?”
চোখ দিয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়! থামবার জো নেই। তখনি চোখ পড়ে বিছানার পাশের টেবিলটায়। একটি ছোট কাগজের উপর কাঁচের গ্লাস চাপা দেওয়া। আমি ডান হাতে চোখ বুঝলাম,নাক মুছলাম। তারপর কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম,
আমি তোমার দুই বর্ণের শব্দ বাবার মতো হতে চাই না। শুধু স্বামী হতে চাই। সেজন্যই চলে আসা। আমার অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে খুব শীঘ্রই ফিরব। অপেক্ষা করবে তো?
পুনশ্চঃ আমরা অল্প কী বেশি সময় কাটিয়েছি তো? আমাদের এই অল্প কী বেশি দূরত্ব তোমার মনে মিস শব্দটা জেগে উঠবে না? আমার কিন্তু উঠবে। খুব বেশি! শাহেদ
#সমাপ্ত

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com