Breaking News

শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -১৬



একমাস পর,
মুগ্ধ একটা বিশেষ মিটিং শেষে বেরিয়ে আসে। এখনো সে অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করছে। অনেক চেষ্টা করেও এখনো এখানে স্থায়ী হতে পারেনি। তবুও সে চেষ্টা করেই যাচ্ছে, হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র মুগ্ধ নয়। শুধু জিনাতকেই ছেড়ে দিয়েছে বাকি সবকিছু অর্জন করে নিয়েছে।
বাসার দিকে যাচ্ছে সে। যতদিন এখানে থাকবে ততদিন এক বৃদ্ধার বাসায় পেনগেস্ট হিসেবে থাকবে সে। ভদ্রমহিলা, মিসেস উইলার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলেও উনার স্বামী বাংলাদেশি। কিছুদিন হলো ইন্তেকাল করেছেন, নিঃসন্তান ছিল তাই বাসায় পেনগেস্ট রাখতে পছন্দ করেন।
মুগ্ধ বাসায় পৌঁছে বেল বাজায়। মিসেস উইলার দরজা খুললে মুগ্ধ হাসিমুখে বলল,
“Good afternoon, aunty?”
“Good afternoon. how was the whole day?” (শুভ বিকাল, সারাদিন কেমন গেল?)
মুগ্ধ ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
“Great, aunty.”
“Okay, go room and freshen up.” (ওকে, রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও)
“Of course.”
মুগ্ধ নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগটা রেখে ফোন বের করে দেখে শুভ কল দিয়েছিল। মুগ্ধ ভয়েজ ম্যাসেজ দেয়,
“মাত্রই বাসায় ফিরলাম, একটু পরে কল দিবো।”
মুগ্ধ ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মিসেস উইলার রুমে নাস্তা দিয়ে গেছে। মুগ্ধ মুচকি হাসে। এই ঘটনা নতুন নয় প্রতিদিন মুগ্ধের খাবারের সময়, নাস্তার সময়ের নিখুঁত হিসাব রাখেন মিসেস উইলার।
মুগ্ধ নাস্তা খেতে বসে শুভর নাম্বারে কল দেয় শুভ রিসিভ করে,
“ভাইয়া, কেমন আছো?”
“হ্যাঁ, ভালো আছি। আম্মু কোথায়?”
“এইতো এখানেই আছে।”
“দে আম্মুকে।”
শুভ ফোনটা মায়ের কাছে দিয়ে বলে,
“আম্মু, ভাইয়া কথা বলবে।”
মুগ্ধের মা হাসিমুখে ফোনটা নেয়।
মুগ্ধ বলে,
“আসসালামু আলাইকুম, আম্মু।”
“ওয়ালাইকুম সালাম, কেমন আছিস?”
“ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?”
মুগ্ধের মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি আর কোথায় ভালো থাকলাম? পাশের ফ্ল্যাটের আরমানের বিয়ে কালকে।”
মুগ্ধ খুশি হয়ে বলে,
“বাহ, ভালই তো আরমান ভাই বিয়ে করে ফেলছে।”
এবারের রেগেমেগে উঠে মুগ্ধের মা,
“হ্যাঁ, ভালো তো হবেই। আরমান ভাই বিয়ে করছে, তাই না? আর তুমি কি করছো?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁদোকাঁদো ভাব করে মুগ্ধের মা বলল,
“আল্লাহ আমাকে মেয়ে দেয়নি, ভেবেছিলাম ছেলেদের বিয়ে করিয়ে বাসায় বউ আনবো। বউকে আমার মেয়ে করে রাখবো। সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো কই? এক ছেলে তো ছোট, আরেকজন চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করেছে।”
মুগ্ধ জানে এসব বলে ওর মা ওর মন গলাতে চাচ্ছে। অবশ্যই সব মায়েদের স্বপ্ন থাকে ছেলেদের বিয়ে করাবে, ঘরে পুত্রবধূ আসবে, নাতি-নাতনি হবে। এ তো আর অপরাধ নয়। মুগ্ধ কিছুই বলে না, চুপচাপ মায়ের কথা শুনতে থাকে। মায়ের এমন কাঁদোকাঁদো কন্ঠে ওর বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। তবুও কথা বাড়াতে চাচ্ছে না সে। তারও যে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।
বিকেলে,
তুবার জোরাজুরিতে লাঞ্চের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে হয় আলিয়ারের। তুবাকে ভার্সিটির সামনে থেকে রিসিভ করে যায় রেস্টুরেন্টে, সেখানে দুপুরের খাবার খায় ওরা।
তারপর আবার ওকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করতে হয়। আজও আলিয়ারের কোমরের পেছনের দিকে ব্যথা হচ্ছে, আজ শুধু বামদিকে নয় ডান দিকেও করছে। তবুও তুবার জন্য এটুকু কষ্ট সহ্য করছে সে।
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে এসেছে ওরা। এ সময় এখানে কোন ভিড় নেই বললেই চলে। দুএকজন মানুষকে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়৷ দূরে ফেরিঘাটে একটু ভীড় আছে, যানবাহনের চাপও দেখা যাচ্ছে।
আলিয়ার একহাতে তুবাকে ধরে রেখেছে। নদীর পাড়ে বালিতে হাটার সময় একেবারে নদীর কাছ দিয়ে হাঁটছে তুবা, যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে আর নদীতে স্রোতও অনেক। তাই ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে আলিয়ার।
আলিয়ার বলে,
“সাঁতার জানো?”
তুবা ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো করে বলে,
“ভাইয়া অনেক চেষ্টা করেছে শেখানোর কিন্তু আমার ভয় করে।”
আলিয়ার জোরে হেসে বলল,
“এত বড় মেয়ে পানিতে নামতে ভয় লাগে?”
“আরে পানিতে নামতে ভয় লাগে কে বলল? আমার তো সাঁতারে ভয় লাগে।”
আলিয়ার এবারে আরো জোরে হাসতে থাকে। হাসি থামিয়ে বলে,
“সাঁতারে কিসের ভয়?”
“কেন নিচে যদি মাছ এসে টেনে নিয়ে যায়?”
আলিয়ার আবারও হাসে,
“বেড়াল মাছকে ভয় পায়? এই প্রথম এমন কথা শুনলাম আর এমন বেড়ালও প্রথম দেখলাম।”
তুবা গাল ফুলিয়ে বলে,
“আবার বেড়াল?”
“তুমিতো বেড়ালই।”
মুখ টিপে হাসে আলিয়ার। তুবা অন্যদিকে তাকায়, রাগ করেছে সে৷ এখন আলিয়ারকেই ওর রাগ ভাঙাতে হবে।
হঠাৎ আলিয়ার হাটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। তুবা চমকে উঠে বলে,
“কি হয়েছে, আলি?”
আলিয়ার উত্তর দেয় না। তুবা আলিয়ারের সামনে বসে বসে পড়ে, ওর চোখেমুখে ভয় দেখে আলিয়ার।
আলিয়ার জোরপূর্বক মুচকি হেসে বলল,
“মুখটাকে এরকম বানিয়ে রেখেছ কেন?”
তুবা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলে,
“আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”
আলিয়ার মাথা নাড়ে,
“না তো।”
“মিথ্যা কেন বলছেন?”
“আমি মিথ্যা বলছিনা, তুবা? আসলে আমার পা ব্যথা করছে।”
তুবা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলে,
“আপনার পা ব্যথা করছে? এখানে হেঁটে? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? পাগল আপনি, আলিয়ার?”
আলিয়ার ফিক করে হেসে দেয়। তারপর বলে,
“গাড়িতে পানির বোতল আছে, একটু দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসো।”
“আপনি এখানে থাকবেন?”
“আমি এখানেই থাকছি, তুমি যাও।”
তুবা চলে যায়, গাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে পানির বোতল নিয়ে আবার আলিয়ারের কাছে ফিরে আসে। আলিয়ার পুরো এক বোতল পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলে। ব্যথাটা একটু একটু করে কমছে মনে হচ্ছে। না, এভাবে আর সহ্য করা যাবে না। কিছুদিন পর ডাক্তার দেখাবে, এমন সিদ্ধান্ত নেয় আলিয়ার।
কিছুক্ষণ পর আলিয়ার দাঁড়িয়ে বলে,
“চলো।”
তুবা নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। আলিয়ার ওর হাত টেনে একদম কাছে নিয়ে আসে। ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
“নদী প্রেমিকের, নদী প্রেমিকা। মানিয়েছে খুব।”
তুবা মুচকি হাসে। তারপর বলে,
“এখানে নৌকাতে ভ্রমণ করা যাবে না?”
আলিয়ার হেসে দেয়,
“পানিগুলো দেখছো? অনেক স্বচ্ছ না?”
তুবা কপাল কুঁচকে তাকায়। আলিয়ার এখনো বাঁকা হাসছে, তুবা গাল ফুলিয়ে নেয়। আলিয়ার গাল টেনে বলে,
“পুরো টমেটো লাগছে।”
তুবা আলিয়ারের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে। আলিয়ারও চুপচাপ আছে৷ তুবা বলল,
“একসাথে থাকতে পারবো সারাজীবন? ছেড়ে যাবেন না তো? কেউ আসবে না তো আমাদের মাঝে?”
শেষের কথাটা শুনে আলিয়ারের ভিতরটা ধুঁক করে উঠে। কেউ আসবে কি, অলরেডি এসে বসে আছে। জিনাত যদি তুবার সম্পর্কে জানতে পারে তো অবশ্যই চেষ্টা করবে সম্পর্কটা নষ্ট করার জন্য।
তুবা বলল,
“চুপ যে?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“করা উচিত হয়নি?”
আলিয়ার সামনের দিকে তাকিয়েই নিজের একহাত দিয়ে তুবার ঠোঁটে স্পর্শ করে। তুবা চোখ বন্ধ করে নেয়। আলিয়ার বলল,
“খুব শীঘ্রই তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব যাবে, এই ভয়গুলো আর করা লাগবে না।”
তুবা মাথাতুলে আলিয়ারের দিকে তাকায়। খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছে ওর। আলিয়ার মুচকি হেসে ওর কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দেয়।
২ ঘন্টা পর,
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তুবা বাসায় পৌঁছে, ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ঢোক গিলে। আজকে ভার্সিটি থেকে ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে।
কলিং বেল না টিপে দরজায় নক করে। তিনচারবার নক করলেও কেউ দরজা খুলে না। হয়তো কেউই শুনেনি। তুবা একটা ঢোক গিলে বেল টিপে।
কিছুক্ষণ পর অনু এসে দরজা খুলে দেয়। তুবা দেখে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“তোমার ভাইয়া বাসায় এসে পড়েছে। তুমি বাসায় না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?”
তুবা আশেপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আলিয়ারের সাথে ঘুরতে গেছিলাম।”
“বাসায় তো একবার জানাবে নাকি? অন্তত আমাকে তো জানাতে পারতে?”
“আরে মনে ছিল না।”
“আচ্ছা, এখন ভিতরে আসো।”
তুবা পা টিপে টিপে বাসায় ঢুকলে তাজিম নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলে,
“তুবা।”
তুবা চমকে উঠে একটা ঢোক গিলে। তাজিম এগিয়ে এসে বলল,
“কি রে, সারাদিন কোথায় ছিলি?”
তুবা একবার অনুর দিকে তাকায়। অনু এগিয়ে এসে বলে,
“তাজিম..”
হাতের ইশারায় অনুকে চুপ থাকতে বলে তাজিম। অনু একটা ঢোক গিলে মাথানিচু করে দাঁড়ায়। মহসিন ও তওবা নিজেদের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তুবা একবার ওদের দিকে তাকায়।
তাজিম তুবার সামনে এসে বলল,
“কি হলো? কথা বলছিস না কেন?”
তুবা আমতা আমতা করে বলে,
“ভাইয়া, আ.. আসলে ওই আ.. আমার এক ফ্রেন্ড পার্টি দিয়েছিল, সেখানে গিয়েছিলাম।”
তাজিম ওর ডান গালে এক চড় বসিয়ে দেয়। ধমক দিয়ে বলে,
“কথাটা তো জানানো যেত নাকি? বাসায় না জানিয়ে দিয়ে গেলে সবাই চিন্তা করবে কিনা, তা একবার ভেবে দেখেছো?”
অনু ভয়ে ভয়ে বলে,
“আহা, তাজিম মেয়েটা মাত্র বাসায় এসেছে। ফ্রেশ হতে দাও, তারপর কথা বলো। আর এত বকাঝকা না করলেও তো হয়, ও তো বড় হয়েছে না?”
তাজিম অনুর ওর দিকে তাকিয়ে ওকে জোরে ধমক দিয়ে বলে,
“তুমি কোন কথা বলবে না। তোমার আদরে আদরে ওর এই অবস্থা হয়েছে।”
আবার তুবাকে বলে,
“সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্টি করো তোমরা? কোনো ভালো মেয়ে সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকে?”
তওবা বলল,
“তাজিম থাক বাবা আর বকাঝকা করো না।”
তাজিম মাকে বলে,
“এখন থেকেই বকাঝকা না দিলে ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। যদিও ওকে আরো আগে থেকেই শাসন করার দরকার ছিল।”
তুবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
“লাস্ট বারের মত সাবধান করছি। এরকমটা যদি আবার হয়, তবে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবো। শুধু বিয়ে না আমি যে ছেলে পছন্দ করব, তার সাথেই বিয়ে হবে।”
তুবা কান্না করে দেয়। ভাইয়ের কাছ থেকে এরকম বকা আগে কখনো খায়নি সে। মাথানিচু করে কাঁদতে থাকলে তাজিম ধমক দিয়ে বলে,
“একদম কান্নাকাটি করবি না, চুপচাপ নিজের ঘরে যা। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে খাবার গিলে যা। এছাড়া আর কিই না করতে পারবি?”
তাজিম রুমে চলে যায়। তুবা ফ্লোরে বসে পড়ে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। অনু ওকে ধরে বলে,
“চলো, রুমে চলো।”
তুবা অনুর হাত ঝারি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। অনুও ওর পিছুপিছু যায়, কিন্তু অনু রুমে ঢুকার আগেই দরজা বন্ধ করে দেয় তুবা।
অনু নক করে বলে,
“তুবা।”
তুবা ধমক দিয়ে উঠে,
“আমাকে একা থাকতে দাও।”
অন্যদিকে,
আলিয়ারও বাসায় পৌঁছে গেছে। নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসলে ইব্রাহিম বলে,
“অফিসে ছিলে না কেন?”
আলিয়ার একবার আহমেদের দিকে তাকায়। বুঝতে বাকি থাকে না এটা আহমেদই ওর বাবাকে জানিয়েছে। কারণ ইব্রাহিম এখন আর অফিসে যায় না।
আলিয়ার বাবার পাশে গিয়ে বসে বলল,
“প্রতিদিন একই কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই একটু নদীর পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। এটা কি আমার দোষ বাবা?”
ইব্রাহিম টিভি দেখতে দেখতেই বলে,
“হুম, ঠিক আছে।”
আলিয়ার বুঝতে পারে জিনাতের ঘটনাটা নিয়ে এখনো ইব্রাহিম রেগে আছে। আলিয়ার মাথানিচু করে বড় নিশ্বাস ফেলে উঠে রুমে চলে যায়। আছিয়া ছাড়া বাকি সকলের আচরণ পালটে গেছে। মানে উনাদের ইচ্ছা মেনে নিয়ে যাকে ভালোবাসে না বরং বোন ভাবে তাকে বিয়ে করে নিলে খুব খুশি হতো সবাই। হায়রে দুনিয়া!
আলিয়ারের ফোনে কল করে তুবা। আলিয়ার রিসিভ করলেই তুবা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। আলিয়ার ঘাবড়ে গিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
“তুবা, আমার বেড়াল, আমার টুইটি বার্ড কি হয়েছে?”
তুবা কান্না করেই যাচ্ছে। আলিয়ার আবারো বলে,
“সদ্য জন্মানো নবজাতকের মতো কাঁদছো কেন, বেড়াল?”
তুবার কান্না তবুও থামছে না। বেশি বড় কোনো সমস্যাই হয়তো হয়েছে। আলিয়ার এবারে সাধারণ ভাবেই বলে,
“কি হয়েছে, তুবা?”
তুবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটু আগের পুরো ঘটনা খুলে বলে। আলিয়ার মুচকি হেসে বলল,
“যাক, ভাইয়ের কাছে বোন এবারে বড় হয়েছে।”
তুবা একবার নাক টেনে বলে,
“মানে?”
“মানে, বিয়ের কথা যখন উঠেছেই তো আমিও বাসায় জানাই, আম্মু-আব্বুকে নিয়ে চলে যাবো তোমাদের বাসায়।”
তুবা কিছুটা লজ্জা পায়। মুচকি হাসছে সে। আলিয়ার আবারো বলে,
“চারটা সিট বুকিং করেছি, একটাতে আমি থাকবো আর তিনটাতে কে কে থাকবে?”
তুবা অবাক হয়ে বলে,
“কিসের সিট?”
“আগে বলো তুমি যাবে?”
“অবশ্যই, আপনি নিয়ে গেলে ভীনগ্রহে যেতেও প্রস্তুত।”
“আর বাকি দুইটাতে?”
“ভাইয়া আর ভাবি।”
আলিয়ার জোরে হেসে বলল,
“পাবনা মেন্টাল হসপিটালে চারটা সিট বুকিং করেছি। তোমার ভাই-ভাবিকে নিয়ে চলে এসো।”
তুবা রেগে বলে,
“কি? আপনি সত্যি পাগল।”
“তোমার জন্য।”
“কিন্তু আমি তো কালো। আমার জন্য পাগল হয়ে কি লাভ?”
আলিয়ার গান গেয়ে উঠে,
“কালো কালো করিস না লো ও গোয়ালের ঝি
বিধাতা তোমায় কালো করেছে তুমি করবে কি?”
তুবা মুচকি হেসে বলে,
“এখানে তুমির জায়গায় আমি হওয়ার কথা।”
“আমি তো তোমাকে উদ্দেশ্য করলাম।”
তুবার মনটাকে খুশি করার জন্যই এতোক্ষণ এতো তোড়জোড় করলো আলিয়ার। পাবনার গল্প বা গানের দুই লাইন কেবলই ওর মনকে অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য।
অন্যদিকে,
জিনাত প্রত্যাশার সাথে ফোনে কথা বলছে এক্সামের কিছু বিষয় নিয়ে। নোট, স্যারদের সাজেশন এসব নিয়েই কথা বলছে ওরা।
কাজের কথা শেষ হলে প্রত্যাশা বলল,
“জিনু।”
“হুম, বল। আর কিছু লাগবে?”
“না, আসলে বলছিলাম কি..”
“আমতাআমতা করছিস কেন?”
“তুই কি আর বিয়ে করবি না? সারাজীবন কি একা থাকা যায়? শুধু স্মৃতি নিয়ে কি বাঁচা যায়?”
জিনাত চুপ করে আছে। প্রত্যাশা বলে,
“কিরে উত্তর দিলি না? দেখ দোষ সম্পূর্ণ আমার, আমি আন্টিকে না জানালে এতোটা হতো না। যদিও এতে আলিয়ার ভাইয়েরও ভুল আছে।”
জিনাত হঠাৎ বলে উঠে,
“না, আলিয়ারের কোনো দোষ নেই। ও যা করেছে ঠিক করেছে। আমরা ওকে না জানিয়ে সারাজীবনের সিদ্ধান্ত একদিনেই নিয়ে নিয়েছি।”
জিনাত একটু থেমে বলল,
“হ্যাঁ, যখন ওকে ভালোবেসেছি, তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। ভালোবাসার বিস্তৃতি তো অনেক, ভালোবাসার অর্থ তো অনেক সমৃদ্ধ, ভালোবাসার মানুষের স্থান তো মনের গভীরে। আমি এটাতে খুব সংক্ষিপ্ত করে ভেবেছিলাম। হয়তো ভেবেছিলাম যে একটু ভালো করে কথা বলে সেই আমাকে ভালোবাসে। এটা তো ঠিক না।”
প্রত্যাশা কনফিউজড হয়ে বলে,
“তুই কি বোঝাতে চাইছিস?”
“যদি আমি সত্যিই আলিয়ারকে ভালোবাসতাম তাহলে তো ওকে জোর করে, না জানিয়ে বিয়ে করতে চাইতাম না। আমি তো ওকে ঠিকমতো ভালোই বাসতে পারিনি, হয়তো ভালোই বাসিনি।”
প্রত্যাশা বলে,
“তুই কি পিচ্চি মেয়ে যে এসব বুঝবি না?”
জিনাত চুপ হয়ে যায়। এই ‘পিচ্চি’ ডাকটা অনেকদিন পর শুনলো ও। কিন্তু কোনো একজনের মতো মায়াভরা কন্ঠে, নেশাভরা কন্ঠে হয়নি। সেই একজনের কথাই হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল ওর। খুব ইচ্ছা করছে মুগ্ধের মুখ থেকে পিচ্চি ডাক শুনার জন্য। কোনোদিন কি সেই সৌভাগ্য হবে?
প্রত্যাশা বলল,
“কিরে কথা বল।”
“পরে কথা বলি দোস্ত, এখন ভালো লাগছে না।”
“ঠিক আছে।”
জিনাত কল কেটে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। দোটানায় আছে মুগ্ধকে কল দিবে কি দিবে না? মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মন বলছে কল দে, মস্তিষ্ক বলছে প্যারা তোকে জালাচ্ছে না তুই কেন জালাবি। এই যুদ্ধে জয়ী হয় মন। জিনাত মুগ্ধকে কল দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখায়। কি করে কল লাগবে? নাম্বারটা আরো আগেই পাল্টেছে মুগ্ধ, ফোনও নতুন নিয়েছে।
জিনাত কয়েকবার কল দিয়ে একই উত্তর পায়,
“আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে এ মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
জিনাত হতাশ হয়ে পড়ে। আবার নিজের উপর রাগও উঠে। কেন যে ওই ডাকটা ওর মন শুনতে চাচ্ছে তার কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না জিনাত। রাগে নিজেই নিজের হাতে আচড় দিতে থাকে।
.
.
চলবে……

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com