Breaking News

শেষ বিকেলের রোদ । পর্ব -০৪



নিজের রুমে এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জিনাত। কেন এমনটা হচ্ছে? সবকিছু কি অন্যরকম হতে পারতো না? বালিশ ভিজিয়ে ভিজিয়ে কাঁদছে, কিন্তু কেউই ওর মনের অবস্থা জানে না। এটা তো আর সিনেমা নয় যে কান্না করবে আর মনের মানুষ রুমাল দিয়ে চোখ মুছে দিবে। এটা জীবন, এখানে বাস্তবতা বোঝার ও মেনে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়।
হঠাৎ জিনাতের মনে পড়ল মুগ্ধের বলা কথাগুলো। যদি আলিয়ার জানতে পারে এই ভয়ে তাড়াহুড়ো করে চোখমুখ মুছে রুম থেকে বেরিয়ে আলিয়ারের রুমে যায়। দরজায় নক করে বলল,
“আলি, একটা কথা ছিল।”
“হুম, বল।”
“তোর ফোনটা একটু দিবি?”
“উঠে যেতে পারবো না, এসে নিয়ে যা।”
জিনাত ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভিতরে গেল। খাটের কাছে গিয়ে ফোন নিতে নিলেই আলিয়ার ওর হাত ধরে ফেলে। জিনাত শিউরে উঠে। আলিয়ার শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
“ফোন নিয়ে কি করবি তা আগে বল।”
জিনাত আমতাআমতা করে বলল,
“আমার ফোনের ব্যালেন্স নেই, তাই কল করা যাচ্ছে না। এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলা লাগবে।”
আলিয়ার মাথা নেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, তোর নাম্বারে বিকাশ করে দিচ্ছি।”
জিনাত ওকে বাধা দিয়ে বলে,
“তুই ঘুমা। আমি পাঁচমিনিটেই ফোন রেখে যাবো।”
বলেই ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে দৌঁড় লাগায় জিনাত।
আলিয়ার কিড়মিড়িয়ে নিজে নিজেই বলে,
“আমি জানি আম্মু তোকে আমার জাসুসি করতে পাঠিয়েছে। আমি কাউকে পছন্দ করি কিনা তাই জানতে চাচ্ছিস। কিন্তু সে যে অপরিচিতা।”
আলিয়ার শুয়ে পড়ে। চিন্তায় ঘুরছে অচেনা সেই মেয়ের চেহারা, চোখের সাথে তার মুখ। শ্যামলা গায়ের রং হলেও তার মুখের গড়নটা অন্যরকম। শ্যামলা একটা মেয়েও সুন্দরী হতে পারে, শুধু সাদা হলেই সুন্দরী হবে তা তো নয়।
মেয়েটার সাথে কিভাবে দেখা করা যাবে। সেদিনের পর থেকে প্রায়শই জিনাতকে ভার্সিটিতে নিয়ে যায় আলিয়ার। কই মেয়েটার তো দেখা মেলে না। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে আলিয়ার।
এদিকে জিনাত মুগ্ধের নাম্বারটা নিজের ফোনে ‘প্যারা’ দিয়ে সেভ করে নেয়। মুখে বিড়বিড় করে বলে,
“প্যারা মানে সত্যিই প্যারা।”
তারপর আবারো আলিয়ারের রুমে যায়। আলিয়ার ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওকে আর ডিস্টার্ব না করে ফোনটা ওর মাথার কাছে রেখে চলে আসে।
নিজের রুমে এসে মুগ্ধকে কল করে। মুগ্ধ রিসিভ করে বলে,
“পিচ্চি?”
“প্যারা।”
মুগ্ধ চমকে উঠে। নিজের সম্পূর্ণ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করে জিনাত ঠিক কাকে প্যারা বলল। জিনাত একটা হাত তুলে বলে,
“মিসড দেয়ার কথা আর আমি কল দিয়েছি। আমার ফোনে টাকা কম, ১০০ টাকা রিচার্জ করুন।”
“দেবো না।”
“তো রিসিভ করেছেন কেন?”
“তাতে কি ১০০ টাকা খরচ হয়েছে?”
“হ্যাঁ, আমি কতটা রিক্স নিয়েছি জানেন?”
“না, তবে জানতে চাই। সবটা জানতে চাই, তোমাকে জানতে চাই।”
মুগ্ধের নেশাক্ত কন্ঠটা বুঝতে অসুবিধা হয় না জিনাতের। চোখবন্ধ করে অনুভব করতে থাকে সেই কন্ঠের নেশা। ওর মনের কোণায় কোথায় যেন বেজে উঠে সুখের সুর।
মুগ্ধ আবারো বলল,
“তোমার সম্পর্কে জানতে চাই, তোমার পছন্দ, তোমার ভালো লাগা, তোমার অপছন্দ, তোমার মন্দলাগা আর…”
মুগ্ধ থেমে গেলে জিনাত বলে,
“আর?”
“তোমার ভালোবাসা।”
চমকে উঠল জিনাত। ভালোবাসার কথা মনে হতেই আলিয়ারের কথা মনের কোণে উঁকি দিলো। কলটাও কেটে দিলো সে। আবারো জিনাতের চোখে পানি, এ পানি কি শেষ হওয়ার নয়?
হঠাৎ কল কেটে যাওয়ায় মোটেও বিব্রত হয়না মুগ্ধ। যেভাবে ও কথা বলছিলো তা ভেবে নিজেরই হাসি পায়। কিছুটা রাগও হয় নিজের উপর। কিন্তু সে সফল, জিনাতের মনে দাগ কাটার জন্য সফল। কিন্তু সত্যিই কি জিনাতের মনে দাগ কাটতে পেরেছে? জিনাত কি ভাববে ওকে নিয়ে?
পরেরদিন,
আজও জিনাতকে নিয়ে ভার্সিটিতে যায় আলিয়ার। বাইক থামিয়ে বলে,
“জিন, যা ভাগ।”
জিনাত নেমে কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
“একদম জিন বলবি না।”
“পেত্নী, যা শু শু।”
আলিয়ারের দিকে তেড়ে এসে বলল,
“আমি কি হাঁস নাকি মুরগি, হুম?”
আলিয়ারের চোখ পড়ে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে থাকা তুবার দিকে। নীল থ্রিপিজ পড়া তুবাকে দেখে প্রায় অজ্ঞান হওয়ার জোগান হয়েছে আলিয়ারের। যাকে আমরা স্টাইল সংযুক্ত করে বলি ক্রাশ খাওয়া।
আলিয়ারের উত্তর না পেয়ে রেগে ভিতরে চলে যায় জিনাত। তুবা নিজের ব্যাগ থেকে একটা ললিপপ বের করে মুখে দেয়ার সময় আলিয়ারের দিকে চোখ যায়। মুচকি হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“হাই, মি.”
আলিয়ার চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“হাই, হাই।”
“আমাকে মনে আছে?”
“ভুলিনি তো।”
তুবা মুচকি হাসে। যথাসম্ভব ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“আপনার নামটা?”
এতো মেঘ না চাইতেই জল। আলিয়ারও এমন কিছুরই তক্কে ছিল। বাইক থেকে নেমে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আলিয়ার।”
“আলিয়ার, আলিয়ার।”
তুবার দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“কোনো সমস্যা?”
“না মানে নামটা একটু মেয়েলি।”
আলিয়ার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বলে,
“What?”
“Don’t mind. It’s true.”
আলিয়ার রেগে গেছে। এমন স্মার্ট নামটাকে মেয়েলি বানিয়ে দিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“আপনার নাম কি?”
“বলতে বাধ্য নই।”
তুবা ললিপপ চুষতে চুষতে ভার্সিটিতে ঢুকে যায়। আলিয়ার বেক্কলের চরম এবং চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে গেছে। দুইবার এই মেয়ে ওকে অপমান করেছে। রাগটা বেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তুবার বাচ্চামোর কথা মনে হওয়ায় হেসে দেয় আলিয়ার। এতোবড় মেয়ে এখনো ললিপপ খায়।
আলিয়ার বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দেয়। মেয়েটার সাথে প্রতিদিন দেখা হলে মন্দ হবে না। একদিন না একদিন তো নামটা জানতে পারবেই, নিজেকে এই বলেই সান্ত্বনা দেয় আলিয়ার।
————————-
ক্লাস শেষে কেন্টিনে গেছে তুবা, স্নিগ্ধা ও সুপ্তি। আইসক্রিম খাচ্ছে আর গল্প করছে ওরা।
তুবা ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“আজ আমি একটা বেকুবের গল্প বলবো।”
“বেকুবের গল্প কোথা থেকে শিখলি?”(সুপ্তি)
তুবা ওর সামনে হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে বলে,
“কোথা থেকে শুনলাম সেটা বড় কথা না, বড় কথা হলো বেকুবটা কি কি বেকুবি করেছে? মানে আমি বেকুবটাকে কিভাবে খাটিয়েছি?”
“কিভাবে কিভাবে?”(স্নিগ্ধা)
তুবা নিজের আইসক্রিমটা সুপ্তির হাতে দিয়ে বলল,
“ভাইয়ার অফিসে গিয়েছিলাম একদিন, বের হয়ে দেখি ঝুম বৃষ্টি। ব্যস, আমি ভিজতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর মনে হলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো গাড়িতে উঠলাম। সেদিন ওই বেকুবটাকে প্রথম দেখেছিলাম। হয়তো ওই অফিসের চাকরি করে। গাড়ির চাকার ধারে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, একদম গোসল করে গেছিল।”
তিনজনে জোরে জোরে হাসতে থাকে।
তুবা আবারো বলল,
“আমি অসুস্থ হয়ে তার পরেরদিন ভার্সিটিতে আসিনি, মনে আছে তোদের?”
“হুম”(স্নিগ্ধা)
“সেদিন আসলে আমি ভার্সিটিতে এসেছিলাম। শরীর খারাপ ছিল তাই মাথা ঘুরিয়ে পড়লাম বেকুবটার উপরে। ওই বেকুবটা আমার মাথায় পানি দিলো, আবার আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলো। যদিও আমি আমার বাসার ঠিকানা দেইনি,(বেশ ভাব নিয়ে) ভুল দিয়েছিলাম। বেচারা সেখানেই পৌঁছে দিয়েছে।”
“তবে তো সে তোর উপকারই করেছে।”(সুপ্তি)
“তা বলতে পারিস তুই, কিন্তু দেখ অচেনা মেয়েকে বাইকে উঠানো রিক্স। যা দিনকাল পড়েছে, এমন তো হয় যে একটা মেয়ে অসুস্থতার অভিনয় করে বাইকে উঠে কিন্তু পরে পকেট মেরে দেয়।”
স্নিগ্ধা হেসে বলে,
“তুই তো আর পকেট মার না।”
স্নিগ্ধার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,
“ছাগল, তা তো আর ছেলেটা জানে না।”
সুপ্তি খুব উৎসাহ নিয়ে বলল,
“আর কি কি হলো?”
“আজ সকালেই দেখা হয়েছিল।”
“আজকে সকালে?”(স্নিগ্ধা)
“হুম, তার নাম জিজ্ঞাস করলাম।”
সুপ্তি চোখ মেরে বলে,
“কি নাম বলল?”
“আলিয়ার।”
দুইজনেই হেসে কুটিকুটি। স্নিগ্ধা হাসি থামিয়ে বলল,
“আলিয়া ভাট।”
দুজনকে দুটো থাপ্পড় দিলো তুবা। তারপর সুপ্তির কাছ থেকে নিজের আইসক্রিমটা নিয়ে বলল,
“বয়ড়াগুলা, বললাম আলিয়ার।”
“স্মার্ট নেইম।”
লাফিয়ে উঠল সুপ্তি।
তুবা ওকে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে বলে,
“লুচ্চামি করবি না, একদম লুচ্চামি করবি না। আমি ওটাকে আরো খাটাতে চাই। আজকে আমার নাম জিজ্ঞাস করেছিল, বলি নাই।”
স্নিগ্ধা নিশ্বাস ফেলে বলে,
“হাপিয়ে গেছি। তা কিভাবে খাটাবি?”
“ওই ছেলের নাম্বার জোগাড় করে এনে দিবি।”
সুপ্তি চেঁচিয়ে উঠে,
“কিভাবে?”
তুবা আইসক্রিমে মুখ দিয়ে বুঝতে পারে তা গলে একাকার। ওটাকে একটানে ভিতরে চালান করে কাপটা ফেলে এসে বলল,
“Anyhow.”
সুপ্তি ও স্নিগ্ধা একে অপরের দিকে তাকায়। এই প্রথম তুবা কোনো ছেলের পিছনে পড়েছে। এর আগে সুপ্তি এমন করতো আর তুবা বাধা দিতো। কিন্তু এবারে তুবার জেদ উঠেছে। এই মেয়ে যে এবারে কি করবে কে জানে?
বিকালে,
বারান্দায় বসে আছে জিনাত। বিকেলটা আজ খুব সুন্দর লাগছে ওর কাছে। শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ আর আকাশের ভেসে বেড়ানো মেঘ, অসাধারণ এক পরিবেশ। মেঘের সাথে জিনাতের হিংসে, মেঘ উড়তে পারে ও কেন পারে না?
এমন এক বিকেলেই আলিয়ারকে নিজের মনের কথা বলেছিল জিনাত। ওর বয়সটা তখন ১৫ কি ১৬ হবে আর আলিয়ারের ১৯।
তখন জিনাত পড়ে ক্লাস নাইনে। উড়ুউড়ু বয়স, মাত্রই মাধ্যমিকে উঠেছে। ডানা মেলে ক্যারিয়ারের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে চলে গেল আলিয়ারের আবেগে ভেসে। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হওয়ার দরুন ওকে খুব ভালো লাগতো জিনাতের। শুধুই ভালো লাগা। কথাটা জানালো তার এক বান্ধুবীকে, সেই বান্ধুবীর কথা অনুযায়ী এটা নাকি ভালোবাসা? হায়রে, আবেগের বয়স বলে কথা।
“তোকে আমি ভালোবাসি, আলি।”
ছাদে বসে বই পড়ছিল আলিয়ার। এমন কথায় চমকে পিছনে ফিরে জিনাতকে আবিষ্কার করে।
মুচকি হেসে আলিয়ার বলেছিল,
“আমিও তোকে ভালোবাসি, ছোটবোনটা।”
জেদি জিনাত রেগে বলে উঠেছিল,
“ছোটবোন না, আমি তোকে বিয়ে করতে চাই। তুই আমাকে বিয়ে করবি?”
আলিয়ারের মাথা কাজ করছিলো না। কি বলবে সে? জিনাত তো ছোট বাচ্চা মেয়ে, তার মাথায় এই কথা কি করে আসবে। না, আবেগে ভাসিয়ে ওর জীবনটা শেষ করে দেয়া যাবে না।
আলিয়ার ওর দুহাত নিজের মুঠোয় ধরে বলেছিল,
“আমার ছোট্ট বোনটার মাথায় এসব কথা কে ঢুকিয়েছে? এসব আবেগ আর আবেগ দিয়ে কখনোই জীবন চলতে পারে না। এসব ভুলে পড়াশুনায় মন দাও।”
সেদিনের মতো চুপ থাকে জিনাত। কিন্তু কিছুদিন পর আবারো আলিয়ারকে বলে ভালোবাসি। আলিয়ারেরও একই উত্তর।
একদিন একা বাসায় সুইসাইড করারও চেষ্টা করেছিল জিনাত। আলিয়ার বাঁচিয়েছে, ডানগালে আলিয়ারের চড়টার কথা কোনোদিনও হয়তো ভুলতে পারবে না জিনাত।
এসব ভেবেই জিনাতের চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। নিজের অজান্তেই হাতটা ডানগালে চলে যায় ওর।
চলবে..

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com