Breaking News

গল্পঃ ভাঙ্গা হৃদয় । পর্ব ০১


পানিতে ডুবে যখন আমার সাড়ে দেড় বছরের ছেলেটা
মারা যায়।সেদিনকার পর থেকেই আমার স্ত্রী মনে এক
প্রকার রাগ পোষণ করেই বাপের বাড়ি চলে যায়।তার
মতে , সন্তানের মৃত্যুর জন্য আমিই সর্বোচ্চ দ্বায়ী
যেখানে সন্তান মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পূর্বেই আমি
পুকুর পাড়ে শক্ত খুটির সাহায্যে বেড়া দিয়ে ছিলাম।
তারপরও জানিনা আমার ওটুকু নিষ্পাপ সন্তান কি
করেই বা এরূপ মজবুত বেড়াকে উপেক্ষা করে
পুকুরের পানিতে এভাবে তলিয়ে যেতে পারে?সন্তানের
দাফন-কাফন এর পর যখন বুকে জামায়িত শত শত
ব্যথা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম ,তখন মা-বাবা পরিবার
এবং আরও অনেক লোক সম্মুখের সামনেই আমার
স্ত্রী আমাকে কোষে থাপ্পর দিয়ে বলেছিলো, এতো বার
বলার পরেও আমি নাকী অলসতার বশীকরণে পুকুর
পাড়ের বেড়া গুলো ঠিক ঠাক ভাবে বাঁধতে পারিনি।
অথচ সন্তান মারা যাওয়ার দুই ঘন্টা পূর্বেও আমি
পুকুর পাড়ের বেড়া গুলো ভালো করে চেক করে এসেছিলাম।
কারণ বিকেল হলেই আমার ছেলেটা এক
একাই কাউকে না বলে নিরবে সবার চোখকে নির্দ্বিধায়
ফাঁকি দিয়ে পুকুরের পাড়টাতেই বেশি সম্ভবত আসতে
পছন্দ করে। আজ সাত মাস অতিক্রম হওয়ার পরেও
আমার স্ত্রীর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।
.
মূলত সেদিন স্ত্রীর সাথে আমার ঝগড়া এবং কথা
কাটা-কাটি কে কেন্দ্র করেই রাগে , দুঃখে , অভিমানে
আমিও আর তাকে ফিরিয়ে আনতে কখনো শশুর
বাড়ির পথে গমন করিনি। কিন্তু আজ বাবা , মায়ের
কড়া নির্দেশের সম্মুখে মাথানত শিকার করে, আমার
স্ত্রী মিহিকা কে ফিরিয়ে আনতে শুশুর বাড়ি এসে
জানতে পারলাম আমার স্ত্রীর অনত্রে কোথাও বিয়ে
ঠিক হয়ে গেছে। যা সম্পূর্ণ আমাদের থেকে গোপন
রাখা হয়েছে। চাল-বাজা চিবিয়ে চিবিয়ে আমার সালা
যখন আমাকে বিনাকারণে অপমান করছিলো তখন
আচমকা মিহিকা এসে ডিভোর্স পেপার হাতে ধরিয়ে
দিয়ে দূর দূর করে পশুর মতো আচরণ করে তাড়িয়ে দেয় আমায়।
স্বয়ং প্রিয় মানুষটিই যখন তার জন্য ক্রয়
করে আনা কালো শাড়িটা পায়ের তলায় পিষে ধিক্কার
জানিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, তোর এই ফুটপাতের
শাড়ী আমার জুতারও যোগ্য না শাহরিয়ার? তখনো
আমি অতটাও কষ্ট পাইনি।যখন বিষাক্ত তীরের তীব্র
আঘাতে আহত হয়ে মাথা নিচু করে ফিরে যাচ্ছিলাম,
তখন আমার ভালোবাসার মানুষ মিহিকা,তার পায়ের
জুতা আমার দিকে ছুড়ে মেরে বলল , ছোটলোক
তোর জন্যই আমি, আমার সন্তান কে হারিয়েছি।বুক
শূন্যের বেদনায় আজ প্রতিটি মুহূর্তে ক্ষণে ক্ষণে মরছি।
.
জাস্ট তোর মতো এক জারজ ছেলেকে যেন আমার
চোখের দৃষ্টির সন্নিকটে আর না দেখি?
সেই মুহূর্তে হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণে বুকের ভেতরটা যেন
আমার রক্তে রঞ্জিত হয়ে ভেসে যাচ্ছিলো।জলন্ত দহনে
পুড়ে প্রতিনিয়ত কালো ছাই হয়ে যাচ্ছিলাম।কয়েক
ফোটা তীব্র ব্যথার অশ্রু মুছে আমি সেখান থেকে
বোবার মতো বাকরুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছিলাম নিজের
বাড়িতে। কখনো ভাবতে বলতে কল্পনারও শত বাহিরে অবস্থিত ছিলো , ভালোবাসার মানুষটি শেষ পর্যন্ত
এভাবে তীব্র আঘাতে মৃত্যুর নিকটবর্তী স্থানে পৌছে
দিবে আমায়। নিমিষেই হৃদয়টা ভেঙে খন্ড খন্ড গুড়ি
গুড়িতে রুপ নিয়ে কষ্টের ঝড় বয়ে উঠছিলো আমার
এই নরম মনে। বাবা-মা উভয়ই সবটা শোনার পর
বৃথাই আমাকে শান্তনা প্রধান করার চেষ্টা করছেন
যেখানে আঘাতের বশীকরণে আসক্ত হয়ে শান্ত
হওয়ার কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।অতএব
মিহিকার বিয়ের সাত দিন পর যখন কষ্টের জলন্ত
তীব্র আগুনে পুড়ে পুড়ে পুকুর পারের আঙ্গিনায় মন
মরা হয়ে বসে রয়েছিলাম তখন হঠাৎ পাশের বাড়ির
ভাবী এসে উপস্থিত হয়ে চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো
করে আমাকে ইঙ্গিত করে বলল , আমি তার
একাকিত্বের মূখ্য সুযোগ নিয়ে শাড়ীর আঁচল ধরে টান
দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার উস্কানি মূলক ঘৃণাপূর্ণ
কথা এবং প্রস্তাব দিয়েছি। তখন মুখের ভাষা যেন
আমার কোনো এক অরণ্য গভীর বনে গিয়ে পথভ্রান্ত
হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো।সম্পূর্ণ বোবা মানুষ দের মতো
আচরণ করছিলাম আমি। অথচ আমার সন্তান মারা
যাওয়ার পর থেকেই যখন আমি একাকী বসে
থাকতাম তখন এই রৌহিকা ভাবীই স্বয়ং এরূপ জঘন্য
ঘৃণাপূর্ণ প্রস্তাব আমাকে দিতেন। উত্তেজিত করার
বৃথাই নিখুত চেষ্ঠা চালাতেন তিনি।যাতে অমত প্রকাশ
করলে ক্ষুব্ধ হয়ে অনেক কথাই শুনিয়ে যেতেন আমায়
কিন্তু কখনো ভাবিনি রৌহিকা ভাবী শেষ পর্যন্ত আরও
.
নিম্ন স্তরে নেমে এভাবে লোক জড়ো করে সবাইকে
মিথ্যের বশীকরণের শিকার করে তুলবে।চিৎকার করে
অনেক কথাই বলেছিলাম আমি, কিন্তু তারা আমার
মুখের কোনো কন্ঠ স্বরকেই গ্রহন করেনি তাই তো
সবাই রৌহিকা ভাবীর কথা গুলোকেই সত্য বলে
আক্ষায়িত করে সমাজের গন্যমান্য ব্যক্তিরা মিলে
আমায় মারধর করে যার ফল সরূপ আজ দু-দিন ধরে
আমি হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি! জীবনটা কতই
না কষ্টের।অদ্ভুত সব ঘটনা না জানি কেনো শুধু এই
আমার সাথেই হচ্ছে! চোখের দৃষ্টি গোচরের সম্মুখেই
মুখ চেপে দাঁড়িয়ে চোখের পানি জরাচ্ছেন মা। মুহুর্তটা
কতই তীব্র ব্যথার একজন সন্তানের নিকট । মাথায়
হাল্কা ভাবে স্পর্শ করে হাত বুলিয়ে বাবা বললেন,
-আমি জানি বাবা তুই এমনটা করতে পারিস না?
বাবা-মা হয়ে যথেষ্ট ভরসা এবং বিশ্বাস তোর উপর
আমাদের রয়েছে।
.
বাবার এরূপ কন্ঠ স্বরে কিছুটা তৃপ্তি পেলাম মনে।
ভেবে ছিলাম তারাও আমায় পরিশেষে অবিশ্বাসের
পাত্র করে তুলবে কিন্তু না, আমি বেঠিক! ভুল ভেবে
ছিলাম। অশ্রুসিক্ত নয়নে জবাবে আমি বাবাকে
বললাম,
-সরি বাবা শুধু মাত্র এই আমার মতো অপয়া ছেলের
জন্যই না জানি তোমাদের কতই না অপমান মুখ বুঝে
নিরবে চোখের অশ্রুতে নয়ন ভিজিয়ে সয্য করতে
হয়েছে।
-নারে বাবা এমনটা বলিস না ? আল্লাহ যা করেন
নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেন।
অতঃপর সুস্থ হওয়ার পরপরই আমি ঢাকা চলে আসি
কারণ গ্রামের সুনাম-ধন্য ক্ষমতা-শালী ব্যক্তিরা গ্রামের
মাটি আমার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।যথেষ্ট দক্ষ
ও শিক্ষিত, হওয়ার পরেও এতদিন বেকার হয়ে গ্রামে
ছোট-খাটো কাজ করে পেট চালাতাম কারণ একটাই
চাকরিতে ঘুষ দেওয়ার মতো অর্থ তো আমাদের নেই।
কিন্তু আজ বাবা নিজের আয়ের ছোট্ট জমি – খানা
কাউকে না বলে বিক্রয় করে আমায় চাকরির জন্য
দশ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছেন ।
.
এর আগেও বহু বার জমি বিক্রয় করার এরূপ চেষ্ঠা করেছিলেন বাবা কিন্ত
আমি থাকাতে আর পারেনি । কত-শত বার নিষেধ
করেছিলাম বাবাকে তবুও বাবা শুনেনি আমার কথা।
কিন্তু ভাগ্যের কি করুণ নির্মম নিষ্ঠুর অবিচার!এতো
কিছুর পরেও সব শেষ হয়ে গেলো। দশ লক্ষ টাকা ঘুষ
দিয়ে চাকরি ফাইনাল করার এক’মাস পর আমায়
মিথ্যা অভিযোগে,মিথ্যা যুক্তির ভিত্তিতে চাকরি থেকে
গাঢ় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। চাইলেও আর
টাকা গুলো ফেরত পায়নি। পেয়েছি শুধু অপমান আর
লাঞ্চনা।আজ চারদিন হলো কম টাকায় বাসি রুটি
খেয়ে বেঁচে রয়েছি কোনো মতে। ব্যাপারটা এখনো
জানাইনি বাবাকে। কি করেই বা এরূপ কথা বলবো
আমি? না জানি শুনলে কতই না কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠবে
বাবার নিকট। একটু আগেও বাবা ফোন দিয়েছিলেন,
বাড়িতে দু-দিন ধরে চাল নেই,তোর মা অসুস্থ।মাস তো
হলো বাবা,বেতন কি পেয়েছিস?
.
ফোনে বলা বাবার এরূপ কন্ঠস্বর এখনো যেন আমার
কান নামক যন্ত্র দিয়ে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।বাবার কথার
আড়ালে ব্যথা গুলোকে অনুভব উপলব্ধি করতে পাচ্ছি
তীব্র ব্যথা-যন্ত্রণার আর্তনাদে চোখের জল গড়িয়ে টপ
টপ করে পড়ছে আমার । গত কালও বাড়িওয়ালা
টাকার জন্য উচু গলায় কথা শুনিয়েছেন,আপনি কিন্তু
ডিসিপ্লিন নষ্ট করছেন? মাস হওয়ার পরেও এখনো
বাসা ভাড়া দিচ্ছেন না ? এভাবেই চললে তো হবে না
মিস্টার শাহরিয়ার? সেই মুহূর্তে বহু বাঁধাকে উপেক্ষা
করে কোনো মতে এড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি । কিন্ত
আর কদিন ! কি করবো আমি ? কিছুই মাথার গহীনে
প্রবেশ করছে না আমার। আজ এই বিপদে সাহায্য
করার মতো তেমন কেউই আর অবশিষ্ট নেই আমার।
সবি ঝাপসা,ঘোলাটে লাগছে আমার নিকট।পারছি না
আর এ ব্যথা বুকে বয়ে চলতে, এভাবে কষ্টের দহনে
ক্ষণে ক্ষণে তীব্র জলন্ত আগুনে পুড়তে। হে আল্লাহ
আমি তো কোনো পাথর নই তবু কেনো এতো কষ্ট
যন্ত্রণা বেদনা প্রতিটি পর্যায়ে,ধাপে,ক্ষণে ক্ষণে আমার
জীবনে। সন্ধার পর বাধ্য হয়ে টাকার চাহিদার কাছে
পরাজিত হয়ে একটা সাধারণ রেস্টুরেন্টে দিন মুজুরির
কাজ করার পর রাত সাড়ে বারোটায় ভাড়া বাসায়
ফিরছিলাম, তখন হঠাৎ বাবার ফোন পেয়ে রীতিমতো
অনায়াসে চমকে উঠলাম।
.
এতো রাতে বাবা কেনো ফোন দিয়েছে?কোনো বিপদের সম্মুখে নেই তো তারা!
অতএব ফোন রিসিব করে বললাম, কি হয়েছে বাবা?
এতো রাতে ফোন দেওয়ার কি কারণ? তোমরা সবাই
সহিসালামতে আছো তো? উত্তরে বাবা কান্নায় ভেঙে
থেমে থেমে বলল, যৌতুকের জন্য শশুর বাড়িতে
তোর বড় বোনকে প্রচুর টর্চার নির্যাতন করা হয় যার
ফল সরূপ হাসপাতালের চৌকাঠে পৌছানোর আগেই
তোর অন্তঃসত্ত্বা বোন সর্বশান্ত হয়ে যায়। ও আর বেঁচে
নেই রে বাবা, অনত্র ভূবণে পারি জমিয়েছে । যেথায়
আর কেউ তাকে টর্চার নির্যাতন করতে পারবে না।
বাবার এরূপ হৃদয়ভিত্তিক কথা শুনা মাত্রই হাত থেকে
ফোনটা রাস্তায় পড়ে যায় । ব্যথা যন্ত্রণার আর্তনাদে
মুহূর্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।অতএব দ্রুত তার
সাথেই কাউন্টারে গিয়ে অনেক রিকোয়েস্ট করার পর
অতঃপর কম টাকায় টিকিট ক্রয় করে বাসে উঠে
নিজের প্রাক্তন স্ত্রী মিহিকাকে দেখে গলার স্বর যেন
আমার মুহূর্তেই থমকে গেলো । সে হয়তো আমায়
দেখেছে নতুবা না দেখার অভিনয় করছে।অতএব বার
বার হিমশিম খেয়ে নিজেকে সংযোত রেখে নিজের
সিটে গিয়ে বসে পড়লাম।ঠিক আমার সামনের সিটেই
মিহিকা এবং সম্ভবত তার বর্তমান স্বামী বসে রয়েছে।
হঠাৎ অনেকটা আমাকে শুনিয়েই মিহিকা তার
বর্তমান স্বামীকে বলল, তুমি জানো মেহরাব আমার
আগের স্বামী না খুবই গরীব ও গাইয়া প্রকৃতির ছিলো।
ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু অতটা
ভালোবাসার যোগ্য ও মোটেও ছিলো না।
.
এসব শুনেও না শোনার মতো অভিনয়ে বসে রয়েছি
আমি । এই মুহূর্তে বোনের কথা ছাড়া মাথায় আর
কিছুই আসছে না।খুবই কষ্ট হচ্ছে নিজের বড় বোনের
জন্য। এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই সব
সৃতি গুলো।নিজে না খেয়ে যে বোন আমায় খাবার
খাইয়ে দিতো না জানি কি করেই বা আমি সেই বোনের
কবরে মাটি দিবো?কষ্টে,দহনে,যন্ত্রণায় চোখের অশ্রুতে
সেলাই করা শার্ট-টা ভিজে একাকার। খুব কষ্ট হচ্ছে
বুকের ভেতরটা অজানা সব ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে।জানি
না কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তবে মাঝ রাতে কারও
তীব্র হাতের প্রহারে আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়। চোখ মেলে
তাকিয়ে সামনেই মিহিকা এবং তার বর্তমান স্বামীকে
রাগান্বিত চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ খানিকটা
বিভ্রান্তির শিকার হলাম আমি। অতঃপর অবাক করে
দিয়ে আমার কলার চেপে ধরে মিহিকার বর্তমান স্বামী
বলল, হেই ইডিয়ট!আমার স্ত্রী মিহিকার কোমরে হাত
দিয়ে অসভ্যতা করে এখন ঘুমানার অভিনয় করা
হচ্ছে ছোটলোকের বাচ্চা?
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com