Breaking News

ছোটগল্প "দাগ"



প্রথমবার আমার স্বামী যখন আমার গায়ে হাত তুলে তখন আমি আমার মাকে ফোন করে বলেছিলাম,

“ মা, আজ তামিম আমায় চড় মেরেছে। রান্নাঘরে রান্না করছিলাম তাই দরজা টোকার আওয়াজ শুনতে পাই নি।পরে যখন দরজা খুললাম তখন তামিম আমায় রাগে চড় মেরেছে। দরজা খুলতে দেরি হয়েছিলো বলে ”
আমার কথাশুনে আমার মা জবাব দিয়েছিলো,
-- "মেরেছে তো কি হয়েছে? একটু মানিয়ে নিতে শিখ। জামাই সারাদিন বাহিরে কাজ করে বাসায় এসেছে আর তুই সময়মতো দরজা খুলিস নি বিধায় রাগে একটা চড় মেরেছে।এ আর এমন কি? যাই হোক তুই কেমন আছিস? ”

আমি শুকনো মুখে উত্তর দিলাম,
-- “ হুম ভালো আছি। ”
দ্বিতীয়বার যখন মার খেয়েছি তখন বাবাকে ফোন করে বললাম,
-- “ বাবা, আজ তামিম আমার গায়ে হাত তুলেছে। ও বলেছিলো সকাল ৬টায় ওকে ডেকে দিতে। কিন্তু আমি সময় মতো ওকে ডাকতে পারি নি বলে ও আজ আমার চুলের মুঠি ধরেছিলো। ”
বাবা তখন বললো,

-- “ স্বামী একটা কাজ দিয়েছে সেটা ঠিক মতো করতে পারিস না? তোর মা হলে তো সারারাত জেগে থেকে হলেও আমায় সকাল ৬টায় ডেকে দিতো। শোন, বিয়ের পর স্বামী একটু বউকে শাসন করবে এটাই স্বাভাবিক। স্বামীর কাজ গুলো একটু মন দিয়ে করার চেষ্টা কর আর একটু মানিয়ে নিতে শিখ। তা তুই কেমন আছিস? ”
আমি হেসে জবাব দিলাম,
-- “ খুব ভালো আছি... ”

বেলকনিতে হাঁটাহাঁটি করছিলাম দেখে আমার স্বামী বাসায় এসে আমার সাথে কতক্ষণ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বললো,
-- “ আমি সারাদিন বাসায় থাকি না আর তুমি বেলকনিতে গিয়ে মহল্লার ছেলেদের সাথে টাংকি মারো? আমি বাসায় ঢোকার সময় দেখেছি তুমি বেলকনিতে পায়চারি করছো আর মহল্লার দুইটা ছেলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখে শিস মারছে অথচ তুমি তারপরেও বেলকনিতেই দাঁড়িয়ে ছিলে ”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
-- “ আমি খেয়াল করি নি। ”
আমার স্বামী তখন রেগে বললো
-- “ তোমার তো সেদিকে খেয়াল থাকবেই না। ছেলেরা তোমায় দেখে শিস বাজালে তোমার তো ভালোই লাগে। নষ্ট মেয়ে কোথাকার... ”

এইকথা বলে আমার স্বামী আমাকে ধাক্কা মেরে চলে গেলো।আমি তখন ভাবলাম আমার কষ্টটা তো আমার মা বাবা বোঝে না।হয়তো বড় ভাই বুঝবে।ভাইয়াকে যখন ফোন দিলাম।ভাইয়া ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভাবীর কান্নার আওয়াজ শুনি।ভাইয়া তখন ভাবীকে চিৎকার করে বলছে,
– “ ঐ একদম কান্নার আওয়াজ যেন না হয়।আর যদি কখনো দেখেছি বাসার বাহিরে যেতে তাহলে পা ভেঙে রেখে দিবো বলে দিলাম। ”

আমি তখন সাথে সাথে ফোনটা রেখে দিলাম।যার কাছে বিচার দিতে ফোন দিয়েছিলাম সেই তো অন্য বাড়ির মেয়েকে বাহিরে যাওয়ার অপরাধে পা ভেঙে বাসায় ফেলে রাখতে চাইছে।
আসলে মেয়ে মানুষের জন্মই হয়তো হয়েছে মার খেয়ে মানিয়ে নিতে শিখার জন্য...
অনেকদিন পর আমার বাবা মা আমায় দেখতে আসলো।মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-- “ কিরে তামান্না,তোর কপালে দাগ কিসের? ”

আমি হেসে উত্তর দিলাম,
-- “ কিছু না মা, বাথরুমে পড়ে গিয়ে কপাল ফেটে গিয়েছিলো।এটা সেটারি দাগ। ”
বাবা মা আমাদের বাসায় দুইদিন থেকেছিলো।যেদিন চলে যাবে সেদিন আমি দারজার সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় দেওয়ার সময় মাকে বলেছিলাম,
-- “ মা আমি মানিয়ে নিতে শিখে গেছি।এই যে কপালের দাগটা দেখছো সেটা বাথরুমে পড়ে গিয়ে হয় নি।তোমাদের জামাই ভালোবেসে ফুলদানি নিয়ে আঘাত করে বানিয়ে দিয়েছে।অথচ দেখলে আমি কত সুন্দর মানিয়ে নিয়েছি। ”
মা কেঁদে দিয়ে বললো,
-- “ তুই এই কথা আমায় আগে বলিসনি কেনো? ”
আমি হেসে বললাম,
-- “ বললে কি হতো মা?সেই তো বলতে মানিয়ে নিতে।আর দিন শেষে দোষটা হতো আমার। মা তোমাদের জামাই বাহিরে কাজ করে,আমি কি সারাদিন ঘরে বসে থাকি? আমিও তো বাসায় কাজ করি। অথচ তোমার চোখে জামাইয়ের পরিশ্রমটাই ভাসলো নিজের মেয়ের পরিশ্রমটা ভাসলো না। ”
বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,

“ বাবা আমি এলার্ম-ঘড়ি না যে ঠিক টাইমে বেজে উঠবো।আমি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ।
সারাদিন পরিশ্রম শেষে যখন বিছানায় শরীর রাখি তখন আমারও দুচোখ বেয়ে ঘুম আসে।
তুমি আমার ঘুমিয়ে থাকাটাকে অন্যায় মনে করলে
অথচ তোমার মেয়ের জামাই যে তোমার মেয়ের চুলের মুঠি ধরলো সেটা তুমি অন্যায় মনে করো নি। ”
বাবা মা আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলো।
কিন্তু আমি তাদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়েছি।
মেয়ে মানুষ তো তাই মানিয়ে নিতে শিখে গেছি...

<>সমাপ্ত<>

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com