Breaking News

কুয়াশার মতো । পর্ব - ০৪



সাজ্জাদের অবস্থা বেশি ভালো না ভাবি, পুলিশ হাসপাতালেই তাকে পাহারা দিচ্ছে। আপনি আজ এখনই ঢাকায় আসেন, আর যা হবার তা তো হয়ে গেছে, আসার সময় নিজেকে শক্ত রাখবেন। "
" সজীব ভাই আপনি কি অফিসে? "
" হ্যাঁ ভাবি, কিছুক্ষণ আগে এসেছি। "
" আমার বাসায় মা আর সুমনার এখন অবস্থা কি রকম? নিশ্চয়ই কান্না করে সবাই? "
" তা তো করবেই ভাবি, আমি সকালে গেছিলাম আপনাদের বাসায়। তখন সেখানে অনেক মানুষ উপস্থিত ছিল, আপনার মা বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছে। চিৎকার দিয়ে শুধু আপনাকে বকাবকি করে, আপনি নাকি সবকিছুর জন্য দায়ী। "
" মা এখন কোথায়? "
" তাকে বাসায় পাঠানো হয়েছে আর আপনাদের সেই ফ্ল্যাট পুলিশ লক করে দিয়েছে। বিভিন্ন তদন্ত করার জন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে। "
ফেরদৌসের বাসায় তার মা-বাবা যখন আমার মুখে শুনলেন তখন সবাই হা হয়ে গেল। সকলের কাছে যেন অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা বর্ননা করেছি আমি তাই তারা নির্বাক।
আমি দ্রুত বের হবার প্রস্তুতি নিলাম, চোখ দিয়ে সেই তখন থেকে পানি বের হওয়া শুরু করেছে আর এখনো অনবরত চলেছে।
ফেরদৌস বললো " আপু আমিও আপনার সঙ্গে যাবো। "
" কেন? "
" আপনি যেতে পারবেন না, পথে যদি নতুন কোন বিপদ হয় তাহলে তো সমস্যা হবে। "
" আমার কিছু হবে না, তুমি বাড়িতে এসেছো তাই আমার জন্য এখন যেতে হবে না। "
" আপনাকে দিয়ে আমি আবার আসবো। "
অনেক চেষ্টা করেও একা বের হতে পারিনি, তাই ফেরদৌসকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলাম। একটু পড়ে পড়ে বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠবে বুঝতে পারিনি। সেদিন রাতে যদি বুঝতাম বাবার সঙ্গে আর কোনদিন দেখা হবে না। তাহলে এতটা খারাপ ব্যবহার করতাম না হয়তো, নিজেকে খুব অসহায় লাগে।
ঢাকায় পৌঁছে সরাসরি হাসপাতালে গেলাম। সজীব ভাই হাসপাতালের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, তিনি কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। আমি তার সঙ্গে উপরে উঠলাম, ফেরদৌস আমার সঙ্গেই আছে।
সাজ্জাদ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে, তার সঙ্গে দেখা করে কোনো লাভ নেই। তাই বাহিরে এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা জন্য বসে আছি, ভেবেছিলাম বাসার কাউকে হয়তো পাওয়া যাবে। বাসে করে আসার সময় সুমনার নাম্বারে কল দিছিলাম কিন্তু রিসিভ করে নাই।
" সজীব ভাই বললো, অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে আর মাথার মধ্যে রক্ত জমেছে। একবার একটু জ্ঞান ফিরেছিল তারপর থেকে আবার অজ্ঞান হয়ে আছে। "
" বললাম, পুলিশ কীভাবে খবর পেল? "
" ফজরের নামাজ পড়ার জন্য আপনাদের ফ্ল্যাট এর উপরতলার একটা লোক মসজিদে যাচ্ছেন। তিনি সিঁড়ির চৌকিতে রক্তের দাগ দেখতে পান, তারপর বাড়িওয়ালাকে ডাকেন। দরজা খোলা ছিল তারা ভিতরে প্রবেশ করে দেখেন আপনার বাবা ছুরি পেটে বিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আর কাছেই সাজ্জাদ রক্তাক্ত মাথা নিয়ে শুয়ে আছে, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ডাকা হলো। পুলিশ এসে চেক করে সাজ্জাদকে জীবিত ধারণা করে, আপনার বাবা মারা গেছে সেটা সেখানেই বোঝা গেছে। "
" আমি কি আমার বাসায় যেতে পারবো? "
" জানি না ভাবি, দারোগা সাহেব এলে তার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। "
" বাবার লাশ কোথায়? "
" পোস্টমর্টেম শেষ হয়ে গেছে, আপনার কাকারা এসেছেন তারা হয়তো লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। "
" আমি এখনই যেতে চাই, এখানে তো সাজ্জাদের সঙ্গে ডাক্তার নার্স আছে। বাবাকে শেষ দেখা তো দেখতে হবে, খুব কষ্ট লাগছে সজীব ভাই। "
" ভাবি একটা কথা। "
" জ্বি বলেন। "
" আপনাকে সাজ্জাদ যে চেকবই দিয়েছিল সেটা কি আপনার কাছে আছে? আমি কিন্তু জানতাম আপনার কাছে চেকবই আছে কিন্তু সকাল বেলা পুলিশ তল্লাশি করার সময় পাওয়া গেল না। "
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম " বলেন কি? আমি তো সেটা আমাদের বেডরুমে বালিশের তলায় রেখে দিছিলাম। "
" পুলিশ তো ভালো করে তল্লাশি করেছে তাহলে পেল না কেন? যদিও আমি চেকবইয়ের কথা কিছু বলিনি কিন্তু মনে মনে ছিল। কারণ আপনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন না সেটা ধারণা ছিল। "
" তাহলে চেকবই কে নিয়েছে? "
" তা তো জানি না ভাবি, আচ্ছা এটা পুলিশের কাছে বললেই ভালো হবে। খুনের সঙ্গে টাকার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। "
" কিন্তু চেক বইয়ের কথা আপনি আমি সাজ্জাদ ছাড়া আর কেউ কি জানে? "
" জানার কথা নয়। "
" পুলিশ এগুলো বের করতে পারবে, আগে চলুন আপনার বাবার লাশ দেখবেন। "
সজীব ভাইয়ের মুখটা হঠাৎ করে কেমন পরিবর্তন মনে হলো, নিজে একটু বিব্রত হয়ে গেছে।
|
|
হাসপাতাল থেকে বের হবো এমন সময় পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওসি সাহেব বললেন,
" কোথায় যাচ্ছেন, শাকিলা মেডাম? "
" আমি বাবার লাশ দেখতে যাবো। "
" আপনার বাবার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে চলে গেছে, আপনাকে এখন আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। "
" আশ্চর্য হয়ে বললাম, মানে কি? "
" সজীব ভাই বললো, কিন্তু কেন অফিসার? "
" তার বাবার হত্যার দায়ে সাজ্জাদের সঙ্গে সঙ্গে তার নামেও মামলা করা হয়েছে। তার মা নিজেই মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, সুতরাং আপনার স্বামী যেহেতু অসুস্থ সেহেতু আপাতত আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। "
পাগল হয়েছেন আপনারা? আমার মা এখন শোকের আবহে কতকিছু বলবে আর তাই বলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবেন?
কিছু করার নেই, মামলায় আপনার নাম।
আর সাজ্জাদ খুন করেছে সেকথা কীভাবে বলেন আপনারা?
যে নিজেই আহত হয়ে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে, তাকেও সন্দেহ?
দেখুন আপনার স্বামী অভিনয় করছে,
তিনি মনে হয় ভাবতে পারেননি রডের আঘাত বেশি জোরে লেগে যাবে।
শশুরকে হত্যা করে নিজে হালকা অসুস্থ হবার জন্য একা একা আঘাত করেছেন।
কিসের ভিত্তিতে বলছেন?
" সন্দেহের ভিত্তিতে, আমরা সবসময় সন্দেহ থেকে আসামির সনাক্ত করা শুরু করি। তারপর সেই তালিকা থেকেই খুনি বেরিয়ে আসে। "
পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে, বাবার লাশের সঙ্গে শেষ দেখা করতে না পেরে, মুমূর্ষু স্বামীকে হাসপাতালে রেখে আমি জেলে চলে এসেছি। সজীব ভাই প্রতিদিন দেখা করতে এসেছে কিন্তু আমার মা কিংবা বোন কেউ আসেনি। তারা নাকি এখনো গ্রামের বাড়িতে, এদিকে সাজ্জাদ এখনো কথা বলতে পারে না। আমি চারদেয়ালে বন্দি হয়ে সারাদিন সারারাত কান্না করে শুধু চোখে পানি বিসর্জন করা ছাড়া কিছু করতে পারি না। আল্লাহ কে বারবার বলছি, বাবাকে তো কেড়ে নিয়েছে, এবার আমার স্বামীকে যেন না নেয়।

সাজ্জাদ সুস্থ হলেও আরেক বিপদ, পুলিশ তখন তাকেও ধরে নিয়ে আসবে জেলে। মাঝে মাঝে আমারও কেমন সন্দেহ হয়, সত্যি সত্যি কি সাজ্জাদ আমার বাবাকে খুন করেছে?
সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয়, সেদিন রাতে আমি যদি এভাবে অপমান না করতাম। কিংবা সকাল বেলা বাসা থেকে বের না হতাম তবে কাহিনি এমন হতো না।
ফেরদৌস দিনের মধ্যে দুবার দেখা করতে আসে আমার সঙ্গে, গতকাল বললো একজন গোয়েন্দা তার পরিচিত আছে। আমি তাকে বলেছিলাম যে তাহলে কথা বলে নিয়ে আসো। সবকিছু চোখের সামনে কুয়াশার মতো মনে হয়, কুয়াশা যেমন অন্ধকার করে রাখে কিন্তু ছোঁয়া যায় না। তেমনি আমার সামনে মাত্র কয়েকদিনের ঘটিত জটিলতা কুয়াশার মতো লাগে।
শাকিলার নিজের মুখের বর্ননা শেষ৷
হালকা অন্ধকার ঘরে বসে বসে এতক্ষণ ধরে সবকিছু শুনছিলেন সাজু ভাই। প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লেগেছে শাকিলার মুখের বর্ননা শুনতে। সেদিন রাতে সাজ্জাদের সেই ড্রইং রুমে বসে থাকা হতে শুরু করে জেলে আসা পর্যন্ত সকল ঘটনা বলে হাঁপ ছেড়েছে শাকিলা।

" সাজু বললো, আপনার কষ্টের কথাগুলো বলে আরও কষ্ট পেয়েছেন বুঝতে পারছি। আমার কিছু তদন্তের জন্য সম্পুর্ণ ঘটনা জানার দরকার ছিল তাই জেনে নিলাম। কিন্তু আপনার বলা ঘটনার মধ্যে থেকে আমার বেশ কিছু প্রশ্ন আছে। "
" জ্বি করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে যেভাবেই হোক আমার বাবার আসল খুনি বের করতে হবে। আমি আমার স্বামীকে সন্দেহ করতে চাই না, কিন্তু আমার বাবার আসল খুনি ধরা পড়ুক সেটাই কামনা করি। "
" প্রথম প্রশ্ন, আপনি বলেছেন আপনার বাসায় বেলকনিতে চেয়ার ও চায়ের কাপ কেউ মনে হয় রান্না ঘরে রেখেছে। এটা কি সত্যি? "

" জ্বি, আমি অবাক খুব। "
" পুলিশের কাছে আপনার যে ব্যাগ জমা আছে সেখানে আপনার বাসার চাবি পাওয়া গেছে। সেখানে আছে দুটো চাবি, সচারাচর একটা তালা ব্যবহারে তিনটা চাবি থাকে। "
" আমাদের ও তিনটা চাবি ছিল। "
" তাহলে আরেকটি চাবি কোথায়? "
" আমি তো জানি না, সাজ্জাদ যখন চাবি রেখে গেছে তখন তো তিনটে চাবি ছিল। "
" বুঝতে পারছি, আমি সেটা বের করে নেবো বা চেষ্টা করবো। দ্বিতীয় প্রশ্ন, ফেরদৌসের মা-বাবার কোন ঘটনা আপনি আমাকে বলেননি, আর সে তার বোনের কোনো কাহিনি কি বলেছিল? "
" জ্বি বলেছিল। "
" আচ্ছা সেটাও ফেরদৌসের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবো। আপনার স্বামী চেকবই দিয়েছিল সেখানে মোট কত টাকা ছিল? "

" সবমিলিয়ে ২০ লাখ টাকা হতে পারে, আসলে ততটা পরিষ্কার মনে নেই। "
" তৃতীয় প্রশ্ন, আপনার বিয়ের আগে থেকে পছন্দ করে, খুব বেশি পছন্দ করে এমন কেউ আছে? "
" হ্যাঁ, সানোয়ার হোসেন, আমার বন্ধু। "
" সজীব সাহেবকে আপনার কেমন মনে হয়? তিনিও যে আপনাকে মনে মনে পছন্দ করে সেটা কখনো বুঝতে পেরেছেন আপনি? "
" কোই না তো, কি বলেন? "
" আচ্ছা বাদ দেন, আপনি সাবধানে থাকবেন আর দরকার হলে আবার আসবো। "
" আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করবেন, আর তাকে বোঝাবেন সাজু ভাই। "
" জ্বি অবশ্যই। "

ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে থানা থেকে বের হয়ে গেল সাজু, ফেরদৌস ও সাজ্জাদের বন্ধু সজীব সাহেব। ফেরদৌসকে সামনে হাঁটতে বলে সাজু একা একা সজীব সাহেবকে বললো,
" আপনার কাউকে সন্দেহ হয়? "
" না সাজু ভাই, ব্যক্তিগত ঝামেলা নিয়ে সাজ্জাদ কোনদিন কিছু বলে নাই। "
" আপনি আর সাজ্জাদ সাহেব দুজন মিলে যে অনলাইনে ছোট একটা বিজনেস করেন, সেটা কেমন চলছে এখন? সাজ্জাদ অসুস্থ, এদিকে এই পুলিশের ঝামেলা, সময় দিতে পারছেন তো? "
" আপনি কীভাবে জানেন?

" আমিও আপনাদের ক্ষুদ্র ক্রেতা, সেখানে আমি আপনাদের দুই বন্ধুর এক লাইভ ভিডিও দেখেছি। "
" ওহ্ আচ্ছা, চলছে মোটামুটি। "
" মাঝে মাঝে আমরা সিনেমার মধ্যে দেখি, দুই বন্ধু একসঙ্গে ব্যবসা করে। হঠাৎ করে দুজনের মধ্যে একজনের মনের মধ্যে শয়তান বাসা বাঁধে এবং অপর বন্ধুকে সরানোর পরিকল্পনা করে। এমন কোন সিনেমা দেখেছেন? "

" জ্বি... জ্বি..! "
" এমন করছেন কেন? না দেখলে তো কোনো অপরাধ নেই তাই না? "
" দেখা হয়নি তেমন, মনে নেই? "
" শাকিলাকে আগে থেকে চিনতেন? "
" কোই না তো! বিয়ের সময় প্রথম দেখা। "
" আমি খুব দ্রুত কিছু তথ্য বের করেছি, সাজ্জাদ শাকিলা ও আপনার ব্যাপারে।
বাকিদের সবকিছু আস্তে আস্তে বের করবো, তবে আমার স্বল্প সময়ে বের করা তথ্য অনুযায়ী আপনি শাকিলাকে আগে থেকে চিনতেন। "
" কে বলেছে আপনাকে? "

" এ বিষয়ে আগামী পরশু আপনার সঙ্গে কথা হবে আমার, আজকে আমি যাই। "
" আপনি কি আমাকে সন্দেহ করেন? "
" কি জানি ভাই, তথ্য অনুযায়ী যাকে যেটা বলা দরকার সেটাই বলি, তাতে যদি সন্দেহের তালিকা মনে হয় তাহলে তাই। "
" আমি সাজ্জাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। "
" আমি ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছি, আপনাকে আর হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। "

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com