ইন্ধুবালা । পর্ব - ০১
নিজের হাতে নিজের নিষ্পাপ স্ত্রী'কে খুন করেছিস ।কি ভেবেছিস? এমনি ছেড়ে দিব তোকে।উমহু মোটেও না।কঠিনতম শাস্তি পাবি তুই।তোকে ফাঁসির দঁড়িতে ঝুলিয়ে ছাড়ব জানোয়ার।"
এক নাগালে কথাগুলি বলে দম ছাড়লেন এএসাই অফিসার তানভির।তার জিবনে বহু আসামি নিজ চক্ষু সামনে দেখেছে ও মেরেছে।অথচ এই ব্যাটার মতন ঘাড়ত্যাড়া একগুয়েমি জেদি বদজাত আসামি এখন পর্যন্ত একটাও দেখেনি সে।এত মার খাওয়ার পরও লোকটা একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি।এটা কি আশ্চর্যতম ঘটনা নয়!এখন পর্যন্ত জানা যায়নি লোকটা কেন তার স্ত্রী'কে নিজ হাতে হত্যা করেছে?সেটা শীর্ঘ'ই সে জেনে ছাড়বে।
হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল কনস্টেবল সায়েদ।বললেন, "স্যার এসপি স্যার এসেছেন।"
কপালে ঘাম মুছে আড় চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ঝুলন্ত আসামিকে দেখে তানভির প্রস্হান ত্যাগ করল।তড়িঘড়ি করে কনস্টেবল সবুজকে ডাকলেন।বললেন,এখুনি যেন দু'কাপ চা দিয়ে যায়।
মিনিট দুই পরে এসপি রনজয় ভিতরে প্রবেশ করলেন।
তাকে দেখে এএসাই সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
হাতের ইশারায় এসপি তাকে বসতে বললেন ।
ততক্ষণে কনস্টেবল চা নিয়ে এসেছেন।চায়ের কাপ দু'আঙুলের সাহায্যে ধরলেন তিনি।
চুমুক বসালেন চায়ের কাঁপে।চা কেমন হয়েছে জানতে চাইলেন কনস্টেবল।
অথচ এসপি রণজয় নিরুত্তর, নির্বাক।
মুখবয়ের কোন পরিবর্তন দেখা গেলো না।পাশে চায়ের কাপ নৈঃশব্দ্য রাখলেন।বললেন,
তোমরা চা'য়ে বুঝি চিনি কম খাও।
এসপির কথায় কি ছিল তাচ্ছিল্যতা না কি ঠাট্টা ঠিক বুঝল না আধবুড়ো কনস্টেবলটি।
তবে সেটা তারভির স্পষ্ট ঠিকই বুঝল।
আমতা আমতা করল কনস্টেবল। হাতের ইশারায় এএসাই তানভির তাকে যেতে বললেন।
অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে তানভির বললেন,
স্যরি স্যার।আপনি চা'য়ে চিনি কম খান। তিনি হয়ত জানতেন না।
একজন বুয়া নিয়োগ দেন তানভির।
জি স্যার।
নতুন কেসটার ব্যপারে কতটুকু জানতে পেরেছেন?
মাথা নিচু করে এএসাই তানভির উওর দিলেন,
এখন পর্যন্ত কিছু'ই জানতে পারিনি।ব্যাটা মুখ'ই খুলছে না।
মেজাজ দ্বিগুন চওড়া হল রনজয়ের।আগে'ই মেজাজ তার আকাশচুম্বী ছিল।সকালটা তার কেটেছে খুব'ই জগন্য ও বাজে ভাবে।বউয়ের সাথে তুখর ঝগড়া হয়েছে।তার মাঝে মধ্যে মনে হয়, বর্তমান সমাজে অধিকাংশ পুরুষ'ই নারী দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। হয়ত, লাজ লজ্জার কারনে পুরুষ এ কথা মুখে শিকার করে না।
তার ভাবনায় ব্যঘাত ঘটিয়ে এএসাই তানভির বলল,
"স্যার জিবনে বহুত আসামি ধরছি।নিজ হাতে মেরেছিও।
কিন্তু এই আসামি প্রলয় জমিদারের মতন একজন আসামিও দেখিনি।
এই ব্যাটা'কে যখন ঝুলিয়ে লাঠি চালান করছি তখনও ব্যাটার মুখে রহস্যময় অদ্ভুত হাসি।
শরিরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ব্যাটা'কে পিটিয়েছি।
অথচ,একবারও 'আহ কিংবা উহ' শব্দ পর্যন্ত করল না ।বিষয়টি চিন্তার নয় কি?"
রনজয় সরু চোখে তাকালেন একবার কারাগারে থাকা আসামির দিকে।
এখনও ঝুলে আছে জমিদার প্রলয়। চক্ষু দু'টি আধবোঝা।
দুর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই লোকটি ঘুমুচ্ছে কিনা।হয়ত না হয়ত হ্যাঁ।
রনজয় দৃষ্টি ঘুরিয়ে তানভিরকে বলল,
"চলুন আসামির কাছে।"
"স্যার সে আধও কিছু বলবে কিনা সন্দেহ। ''
সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল রনজয়।ভাবশীলভাবে জিজ্ঞেস করল।
--আমার মনে হচ্ছে আসামির প্রতি আপনার কনফিডেন্স বেশি।
এর পেছনে আবার আপনার হাত নেই তো।
থতমত খেয়ে বসল এএসাই তানভির ।
--কি বলছেন স্যার?আমার মতন মানুষ তার সাথে হাত মিলাবে এটাও সম্ভব।
--অসম্ভব বলতে কিছু'ই নেই।আসুন।
তড়িঘড়ি করে চোখে চশমা পড়ল এএসাই।
মনে মনে ভাবল,সে শুনেছে নতুন এসপি একটু চটপটে।বেশ ধূর্তমানও।
এখন মনে হচ্ছে তার শোনায় ভুল নয়।
লোকটা সত্যিই চতুর ও বুদ্ধিমান। তার মতন লোককে কিনা গোল খাইয়ে ছাড়ল।
চেয়ারে আয়েশি ভক্তিতে বসল রনজয়।এএসাই মুখটা পাংশুটে করে দাঁড়াল।
রনজয় ডাকল,
জমিদার প্রলয়.....জমিদার প্রলয়।শুনছেন।
এসপি রনজয়ের কথা শুনে জমিদার প্রলয় নিভু নিভু দৃষ্টিতে চাইলেন।
এএসাই আর এসপি'কে দেখে রহস্যময় পৈশাচিক হাসি দিলেন।
তানভির ক্ষিপ্ত হয়ে জ্বলে উঠল।বললেন,
"দেখলেন স্যার,বলছিলাম লোকটা একটা পাগল,উম্মাত।ওনাকে মানসিক হসপিটালের পাঠিয়ে দিন।"
সাটআপ তানভির।এই মুহূর্তে আপনার মুখ বন্ধ না করলে আমি আপনাকে আগে মানসিক হসপিটালে পাঠাব।
মুহূর্তে মুখটা চুপসে গেল তানভিরের। দু'জন কনস্টেবলকে ডেকে প্রলয়'কে নামানো হল।সমস্ত শরিরে মারের দাগ। ফর্সা শরিরে লাঠির আঘাতগুলি কালচে হয়ে গিয়েছে। ক্ষিপ্ত চোখে রণজয় একবার এএসাই তানভিরের দিকে তাকাল।বলল,
এভাবে কেউ কাউকে মারে।
তানভির আনতা আনতা করল।
রনজয় বলল,
যান গরম পানি আর স্যাবলন নিয়ে আসুন।
কেন স্যার?
আপনার গায়ে ঢালব তো তাই।
চোখ বড়বড় করে তাকাল তানভির। মুহূর্তে মুখটা ভিতু করে নিল সে।
রনজয় বলল,
"জলদি করুন।যেভাবে আসামিকে মেরেছেন।মরে গেলে আপনার জন্য আমরাও ফাঁসবো।"
"এত সহজে মরবে না স্যার।শয়তানটার কৈ মাছের পরাণ।"
চোখ রাঙাল এসপি রনজয়।
দৃষ্টি নত করে ঢোক গিলল তানভির। বলল,
"যাচ্ছি স্যার।"
মিনিট দশেক পর গরম পানি আনা হল।গরম পানিতে স্যাবলন দিয়ে তুলা ভিজিয়ে প্রলয়ের শরিরের রক্ত মুছে দেওয়া হল।তাতে মলম লাগিয়ে দিল রনজয়।
গরম গরম খাবার নিয়ে আসতে বললেন, একজন কনস্টেবল'কে।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত কথা বলতে না পাড়ায় মুখটা নিশপিশ করছে এএসাই তানভিরের।সে বলে'ই ফেলল।
"স্যার আপনি তো আসামিকে জামাই আদর করছেন।এভাবে আসামির সেবা করা আমাদের আইনের বিরুদ্ধে। "
"শুনুন মিঃ তানভির। কোন কিছু পেতে হলে কোন কিছু দিতে হয়।এই লোকটার সেবা করার বিনিময়ে লোকটার কাছ থেকে আমার কিছু চাই।তাকে সুস্হ না করলে তার কাছ থেকে জানবে কি করে সে তার স্ত্রীকে কেন খুন করল? "
-তা ঠিক।
--তাই কোন কিছু না বুঝে আন্দাজি ঢিল ছুড়বেন না।লোকটার এখন বিশ্রাম নেক।সন্ধ্যার পর তার জিজ্ঞাসাবাদ চলবে।ঠিক সন্ধ্যা ছ'টার মধ্যে উপস্থিত থাকবেন।
--জি স্যার।
সন্ধ্যা ছ'টা।মাথার ওপর একটি কম পাওয়ারের বাল্ব দৃশ্যমান ।এসপি রনজয় ও তানভির কারাগারের ভিতরে ঢুকল।তানভির চেয়ার টেনে দিল এসপি রনজয়কে বসতে।
রনজয় নৈঃশব্দ্য বসলেন।জমিদার প্রলয়ের দিকে শকুনের ন্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।ভদ্রতাসরূপ বললেন,
"তা কি অবস্থা জমিদার সাহেবের?আপনাকে এই অবস্থায় দেখব আশা করিনি জমিদার প্রলয়।
নিঃশব্দে হাসল প্রলয়।এসপির কন্ঠে তাচ্ছিল্যতা প্রকাশ পেয়েছে সে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারল।
হাসিটা অদ্ভুত ঠেকল রনজয়ের কাছে।আবাদত অগ্রাহ্য করল ব্যাপারটি।
চেয়ার এগিয়ে জমিদার প্রলয়ের মুখোমুখি বসলেন তিনি।বললেন,
"জমিদার প্রলয় আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছি।যা যা জিজ্ঞেস করবো তাই তাই উওর দিবেন।"
নিরুত্তর প্রলয়।
বিরক্ত লাগল এসপির।রনজয় পুণরায় বলল,
"দেখুন প্রলয়,উপরমহল থেকে আপনার জন্য আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।আপনি যদি সত্যিটা খুলে বলেন তাহলে আপনার জন্য সাহায্য করতে পারি।নয়ত,মিথ্যে খুনের দ্বায়ে আপনার ফাঁসি হবে।"
এতক্ষণে টনক নড়ল জমিদার প্রলয়ের।আশ্চর্য হয়ে তাকাল সে।দৃষ্টি নিভু নিভু।মুখে আশ্চর্যতা।
গম্ভীর ভাড়ি কন্ঠে বললেন,
"আমি বালাকে নিজ হাতে হত্যা করেছি এসপি রনজয়।সেটা সকলে দেখেছে।তাহলে মিথ্যে হলো কি করে?"
"দেখুন চোখের দেখা অনেক সময় মিথ্যা হয়।তাই মিথ্যে অন্ততপক্ষে আমার সাথে বলতে আসবেন না।এর আগে আপনার মতন বহু আসামি ধরেছি।আমার ধারনা অনুযায়ী, আপনার চোখ বলছে এক কথা মুখ বলছে অন্য কথা।কোনোটার সাথে কোনটার মিল খুঁজে পাচ্ছি না।"
"বন্ধ করুন এসব এসপি রনজয়।বলেছি তো এই আমি নিজ হাতে আমার ইন্ধুবালাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছি।।তার পরেও কেন বিশ্বাস করছেন না।?"
হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলল এসপি।
"আপনার কেস আদালতে উঠলে আপনার ফাঁসি হবে জানেন তো সে কথা।"
" অন্তত এই যন্ত্রণার থেকে রেহা'ই পাব।এই যন্ত্রণা চেয়ে মৃত্যু আমার জন্য শ্রেয়।"
"আমার বড্ড অবাক লাগছে।এ কেমন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আপনি মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন।আমার জানামতে, ইন্ধুবালা'কে আপনি নিজের জিবনের থেকেও বেশি ভালোবাসতেন।তাহলে তাকে হত্যা করলেন কেন?
"মাথা নিচু করে কথা বলুন এসপি রনজয় । কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন ভুলে যাবেন না।জেলে বন্ধি আছি বলে ক্ষমতার বড়া'ই দেখাবেন না।এ রকম একশটা ক্ষমতা জমিদার প্রলয় পকেটে নিয়ে ঘুরে।সেচ্ছায় ধরা দিয়েছি বলে তুচ্ছ মনে করবেন না।আর হ্যাঁ কি বললেন জানি ইন্ধুবালা।তাকে মেডাম বলে সম্বধর করলে বেশি খুশি হবো এসপি রণজয় ।"
প্রলয়ের কথা শুনে এসপি রনজয়ের মুখে অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটল।ভাবল,বাঘ তাহলে ধরা দিয়েছে।এবার সুযোগ বুঝে জাল ফেলা যাক।
"আচ্ছা স্যরি।বলুন মেডাম বালা'কে কেন খুন করলেন?সে তো আপনার প্রাণভোমরা ছিল। "
"সেটা আপনার কাছে বলতে আমি বাধ্য নই।"
"এটা আপনার জমিদারশালা নয় জমিদার সাহেব।এটা জেলখানা। এখানে আপনার কোন শাসন চলবে না ।তাই যা বলার দ্রুত বলুন।নয়ত,আমার অন্যপন্থা অবলম্বন করবো।"
"ভয় দেখাচ্ছেন অফিসার। তাও জমিদার প্রলয়কে। বাহ!আপনার বুকের পাঠা আছে বলতে হয়।"
"আপনি আমাদের কথা শুনবেন না আগে'ই জানতাম।বেশি সময় নয় খুব করে হলেও দু'টো দিন অপেক্ষা করুন। হসপিটাল থেকে রির্পোট আসলে'ই জানা যাবে কে হত্যা করেছে?অযথা তখন আপনাকে বিরক্ত করতে হবে না আসি।"
টনক নড়ল জমিদার প্রলয়ের। গম্ভীরচিত্তে ভেসে এল।
"দাঁড়ান আফিসার।"
উল্টো মুখে মেকি হাসল রনজয়।
"বলুন কি জানতে চান?"
"আমি আপনার আর আপনার সহধর্মিণীর সম্পর্কে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সব জানতে চাই।"
জমিদার প্রলয় চোখ দু'টি আলতো করে বুঝে নিল।চোখের সামনে ভেসে উঠল সহজ সরল নিষ্পাপ ভুবনমোহিনী সুন্দরী একটি নারীর প্রতিমূর্তি।মনে মনে সে আওড়াল,
"বালা,সে আমার বালা।আমার ইন্ধুবালা,আমার প্রাণভোমরা।"
চলমান...
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com