আদমের আগে পৃথিবীতে কি ছিল

উল্লেখিত সূরা হিজরের ২৭নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, আমাদের আদম (আ.)-এর আগে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর বুকে জ্বিনজাতি সৃষ্টিকরেছেন। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তারা এ পৃথিবী ভোগ-দখল করেছে এবং তাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু যখন তারা পৃথিবীর বুকে মারাত্মক ফিৎনা ফাসাদ সৃষ্টি করলো তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাদেরকে পৃথিবীর সরল জমিন থেকে হটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ জিবরাইল আমীনকে একদল ফেরেশতাসহ জ্বিনজাতিকে সরল জমিন থেকে তাড়াবার জন্য পৃথিবীতে পাঠালেন। ফেরেশতারা মহান আল্লাহর হুকুমে জ্বিনজাতিকে মেরে পিটিয়ে পৃথিবীর সরল জমিন থেকে হাটিয়ে পাহাড়ে জংগলে ও দ্বীপে নির্বাসিত করলেন। 

এরপর জিবরাইল আমিন পৃথিবী ঘুরে দেখছেন যে, সরল জমিন সাফ হল কিনা কেউ কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন জ্বিনের একটি ছোট বাচ্চা জমিনে পড়ে রয়েছে।জিবরাইল আমিন নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে কোলে তুললেন এবং তাকে তার মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করলেন। জ্বিনেরা যে পাহাড়ে দ্বীপে লুকিয়েছে, জিবরাইল আমীন গিয়ে সেখানে তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন দেখ, এ বাচ্চাটি কার? 

তেমরা একে নিয়ে যাও" কেউ সাড়া দিল না বরং পালাতে লাগল। তারা মনে মনে ভাবল জিবরাইল আমিন হয়তো আমাদেরকে আরও শাস্তি দিতে এসেছেন। জিবরাইল বহু চেষ্টা করেও বাচ্চাটিকে ফেরত দিতে ব্যর্থ হলেন। এখন এ নিষ্পাপ বাচ্চাটি তাঁর পক্ষে ফেলে দেয়াও সম্ভব নয়। কেননা সে ছিল নিষ্পাপ শিশু। শেষ পর্যন্ত জিব্রাইল আমিন বাচ্চাসহ মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন এবং রিপোর্ট করলেন যে, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে কাজে পাঠিয়েছিলেন তা পালন করেছি। 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- হে জিব্রাইল! তোমার বোগলে ওটা কি?
তখন জিবরাইল আমিন বলেন এ বাচ্চাটিকে তার মা-বাবা ফেলে চলে গেছে আমি তাকে তুলে ছিলাম তার মা-বাবার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। বাচ্চাটিকে আমি তার মা-বাবার কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। মহান আল্লাহ বলেন- জিবরাইল ঐ বাচ্চার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তুমি জান না ও মারাত্মক চীজ, ওকে তুমি সাবধানে সাত তবক জমিনের নিচে রাখ এবং লালন-পালনের ব্যবস্থা কর। আল্লাহর হুকুমে জিবরাইল আমিন তাই করলেন। এক হাজার বৎসর ইবাদাত করার পর মহান আল্লাহ জিবরাইল আমিনকে বললেন ওকে এক তবক উপরে বসবাসের অনুমতি দাও। এমনিভাবে চৌদ্দ হাজার বছর ইবাদত করার পর মহান আল্লাহ্ এ আজাজিলকে তাঁর আরশের নিচে স্থান দিলেন। এখন সে আল্লাহর আরশের নিচে বসে ইবাদাত করছে। তার ইবাদাতের সময়কাল যখন দুইলক্ষ চল্লিশ হাজার বৎসর পার হয়েছে তখন মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের  ডেকে বললেন-

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلبِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا
وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَالَا تَعْلَمُونَ

“স্মরণকর সেই সময়ের কথা যখন তোমার রব ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, 
নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলিফা বানাতে চাই” । [বাকারা-৩০)

খলিফা শব্দের অর্থ প্রতিনিধি (viceroy)। ১৮৫৭ সালে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-এর পতনের পর ভারতের প্রথম viceroy ছিলেন লর্ডকেনিং। ১৮৫৭ সালে মোগল সাম্রাজের পতনের পর ভারত সরাসরি বৃটিশের অধীনে চলে গেল এবং বৃটিশ সম্রাজ্ঞী মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পক্ষ থেকে ভারত শাসনের দায়িত্বভার যার উপর ন্যাস্ত হল তিনি হলেন লর্ডকেনিং প্রথম viceroy বা খলিফা। 

মহান আল্লাহ মহাবিশ্বের মালিক, তার পক্ষথেকে পৃথিবী শাসনের দায়িত্ব অর্পিত হবে আদম (আ.)-এর উপর। তাই প্রস্তাব করা হল পৃথিবীর বুকে আমি “খলিফা” বানাতে চাই। ফেরেশতারা বললেন- আপনি কি এমন এক জাতি সৃষ্টি করবেন যারা পৃথিবীর বুকে অনাসৃষ্টির সম্পাদনা করবে? অথচ আমরা আপনার প্রসংশা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তখন মহান 
আল্লাহ বললেন-
قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ.

নিশ্চয়ই আমি যা জানি তোমরা তা জাননা। (সূরা বাকারা : ৩০) 
এখানে জানার বিষয় যে, ফেরেশতাদের কোন কোন বিষয় অজানা ছিল, যার ফলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বললেন “আমি যা জানি তোমরা তা জান না”। ফেরেশতাদের ধারণা ছিল আদম সৃষ্টি করা হবে আল্লাহ তায়ালার প্রসংশা ও পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য। তাই তারা বলেছিলেন “হে আল্লাহ!আপনি কি পৃথিবীর বুকে এমন এক সৃষ্টির আবির্ভাব ঘটাবেন যারা পৃথিবীর বুকে মারামারি রক্তপাত করবে? অথচ আমরাইত আপনার প্রসংশা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি” কিন্তু আদম সৃষ্টিকরার মূল উদ্দেশ্যে ছিল পৃথিবীর বুকে খিলাফাতের দায়িত্ব পালন করা। 

আল্লাহ তায়ালা প্রস্তাবনাতেই বলে দিয়েছেন “নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীর বুকে খলিফা প্রেরণ করবো; তাই মানব জাতির সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হচ্ছে খিলাফাতের দায়িত্ব পালন করা আর এই খিলাফাতের অপর নাম বাদশাহী, রাজ্য শাসন, দেশ শাসন। ধরুন একটি ষ্টীমারইঞ্জিন অথবা একটি রেলইঞ্জিন শত সহস্র যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরী হয়েছে। ইঞ্জিনটি স্টার্ট করলে পরিমানমত তৈল মবিল পানি ব্যয় সাপেক্ষে ইঞ্জিনটি চালু হয় ও গিয়ারে পাওয়ার ট্রান্সফার করলে চাকা ঘুরতে শুরু করে এবং গাড়ী বা ষ্টীমার চলতে শুরু করলে উদ্দেশ্যে সফল হয়। 

তেমনি একজন মানুষ যখন নামাজ আদায় করে, জিকির করে, শরীয়াতের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে তখন সিরাতুল মুস্তাকীমে চলার পথে একটি মানুষের দেহের ইঞ্জিন চালু হয়। তারপর মানবরূপী এ ইঞ্জিনটির পাওয়ার ট্রান্সফার করতে হবে খেলাফাতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে। মানুষ যদি প্রচলিত ইবাদাত বন্দেগী আদায় করার পর খিলাফাত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তার শক্তি বিনিয়োগ না করে তবে তার উদাহরণ হবে ঐ ইঞ্জিনের মত যা স্টার্ট করে প্রয়োজনীয় তৈল মবিল ব্যয়
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url