কুরবানীর ইদের চাঁদ ওঠার পর প্রতিটি মুসলমানের করনীয় কি
‘উযহিয়্যাহ’ কুরবানীর দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ-যোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেঁড়াকে বলা হয়। উক্ত শব্দটি ‘যুহা’ শব্দ থেকে গৃহীত যার অর্থ পূর্বাহ্ন। যেহেতু কুরবানী যবেহ করার উত্তম বা আফযল সময় হল ১০ই যুলহজ্জের (ঈদের দিনের) পূর্বাহ্নকাল। তাই ঐ সামঞ্জস্যের জন্য তাকে ‘উযহিয়্যাহ’ বলা হয়েছে। যাকে ‘যাহিয়্যাহ’ বা ‘আযহাহ’ও বলা হয়। আর ‘আযহাহ’ এর বহুবচন ‘আযহা’। যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে ঈদের নাম হয়েছে ‘ঈদুল আযহা’। বলা বাহুল্য, ঈদুযযোহা কথাটি ঠিক নয়।
কুরবানি কি?
কোন কোন হাদিসে এসেছে - কুরবানি শব্দটি ‘কুরবুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত। অর্থ হলো- নৈকট্য লাভ করা, প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।
কুরবানীর ইদের চাঁদ ওঠার পর মুসলমানের করণীয়
ইসলাম ধর্মে দুইটি প্রধান ঈদের মধ্যে একটি হলো ঈদুল আযহা, যাকে কুরবানীর ঈদ বলা হয়। হিজরী বর্ষপঞ্জির দ্বাদশ মাস, যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে এই ঈদ উদযাপিত হয়। চাঁদ দেখা গেলে ঈদের দিন নির্ধারিত হয়। কুরবানীর ঈদ শুধু আনন্দের দিন নয়, এটি আত্মত্যাগ, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী এবং তাকওয়ার চর্চার দিন। তাই ঈদুল আযহার চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে একজন মুসলমানের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় নির্ধারিত হয়ে যায়। নিচে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
তাকবির বলা শুরু করা
চাঁদ দেখা যাওয়ার সাথে সাথেই তাকবিরে তাশরীক বলা শুরু করতে হয়। এটি হলো:
"Allahu Akbar, Allahu Akbar, La ilaha illallahu Wallahu Akbar, Allahu Akbar wa Lillahil Hamd."
তাকবির বলা শুরু হয় ৯ই যিলহজ্জ ফজরের নামাজ থেকে শুরু করে ১৩ই যিলহজ্জ আসরের নামাজ পর্যন্ত। পুরুষদের জন্য জোরে বলা এবং নারীদের জন্য নিচু স্বরে বলা মুস্তাহাব।
কুরবানীর প্রস্তুতি গ্রহণ
চাঁদ উঠার পরপরই কুরবানীর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান মুসলমানের দায়িত্ব। প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে:
- কুরবানীর পশু কেনা ও ভালোভাবে দেখভাল করা।
- কুরবানীর নিয়ম ও সুন্নাতসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা।
- নিজের এবং পরিবারের পক্ষ থেকে কারা কুরবানী দেবেন, তা নির্ধারণ করা।
- কুরবানীর দিন ও সময় ঠিক করা।
চুল ও নখ না কাটা (যারা কুরবানী দিবে)
নবী করিম (সা.) বলেছেন:
"যখন তোমরা যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখো এবং তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, তাহলে যেন সে তার চুল ও নখ না কাটে।" (সহীহ মুসলিম)
চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে কুরবানীর পশু জবাই পর্যন্ত এই নিয়ম মানা মুস্তাহাব।
ইবাদত ও নেক আমলে মনোনিবেশ
যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন বিশেষ বরকতময়। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে এই দশ দিনেই নেক আমল সবচেয়ে প্রিয়। তাই চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে নিচের ইবাদতগুলো করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ:
- বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা।
- রোজা রাখা (বিশেষ করে ৯ই যিলহজ্জ, অর্থাৎ আরাফার দিন)
- দোয়া, জিকির, তাসবিহ ও তাওবা করা।
- গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করা।
ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ার নিয়ম ও নিয়ত
نَوَيْتُ أنْ أصَلِّي للهِ تَعَالىَ رَكْعَتَيْنِ صَلَاةِ الْعِيْدِ الْفِطْرِ مَعَ سِتِّ التَكْبِيْرَاتِ وَاجِبُ اللهِ تَعَالَى اِقْتَضَيْتُ بِهَذَا الْاِمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ اللهُ اَكْبَرْ
উচ্চারণ: 'নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা রাকাআতাইন সালাতিল ইদিল ফিতরি মাআ সিত্তাতিত তাকবিরাতি ওয়াঝিবুল্লাহি তাআলা ইকতাদাইতু বিহাজাল ইমামি মুতাওয়াঝঝিহান ইলা ঝিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি 'আল্লাহু আকবার'।'
ঈদের নামাজ পড়ার নিয়ম-
- ইমামের সঙ্গে তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে উভয় হাত বাঁধা।
- তাকবিরে তাহরিমার পর ছানা পড়া- 'সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়াতাআলা যাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।
- এরপর অতিরিক্ত ৩ তাকবির দেয়া।
- এক তাকবির থেকে আরেক তাকবিরের মধ্যে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় বিরত থাকা।
- প্রথম ও দ্বিতীয় তাকবিরে উভয় হাত উঠিয়ে তা ছেড়ে দেয়া।
- তৃতীয় তাকবির দিয়ে উভয় হাত তাকবিরে তাহরিমার মতো বেঁধে নিতে হয়।
- আউজুবিল্লাহ-বিসমিল্লাহ পড়া
- সুরা ফাতেহা পড়া
- সুরা মিলানো। এরপর নিয়মিত নামাজের মতো রুকু ও সেজদার মাধ্যমে প্রথম রাকাত শেষ করা।
দ্বিতীয় রাকাত-
- বিসমিল্লাহ পড়া
- সুরা ফাতেহা পড়া
- সুরা মেলানো।
- সুরা মিলানোর পর অতিরিক্ত ৩ তাকবির দেয়া।
- প্রথম ও দ্বিতীয় তাকবিরে উভয় হাত উঠিয়ে তা ছেড়ে দেয়া।
- তৃতীয় তাকবির দিয়ে উভয় হাত তাকবিরে তাহরিমার মতো বেঁধে নিতে হয়।
- এরপর রুকুর তাকবির দিয়ে রুকুতে যাওয়া।
- সেজদা আদায় করে-
- বৈঠকে বসা; তাশাহহুদ, দরুদ, দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা।
- নামাজের সালাম ফেরানোর পর তাকবির পড়া-
- নামাজের পর ইমাম সাহেবের দুটি খুতবা দেয়া।
ঈদের নামাজ ও খুতবা শোনা
১০ই যিলহজ্জ ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব (অনেক মত অনুযায়ী) এবং খুতবা শোনা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সুন্নাত হলো:
- গোসল করা
- সুন্দর ও পরিষ্কার পোশাক পরা
- সুগন্ধি ব্যবহার করা
- তাকবির বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া
- ঈদের নামাজ আদায়ের পর পশু কুরবানী করা
কুরবানীর সঠিক নিয়ম মেনে পালন
- বয়স ও স্বাস্থ্য অনুসারে উপযুক্ত পশু কুরবানী করা।
- কিবলামুখী করে ‘বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করা।
- পশুকে কষ্ট না দিয়ে দয়া ও যত্নসহকারে কুরবানী করা।
- গোশত তিন ভাগে ভাগ করা: আত্মীয়, গরীব ও নিজের জন্য।
সামাজিক দায়বদ্ধতা ও শেয়ারিং
ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া একজন মুসলমানের দায়িত্ব। যারা গরীব বা কুরবানী করতে অক্ষম, তাদেরকে গোশত ও ঈদের আনন্দে শরিক করা গুরুত্বপূর্ণ। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, দরিদ্র—সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে খাওয়াতে ঈদের প্রকৃত আনন্দ নিহিত।
কুরবানীর ঈদের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই একজন মুসলমানের ওপর নৈতিক ও ধর্মীয় নানা দায়িত্ব এসে পড়ে। এই সময়টুকু শুধুমাত্র আনন্দ বা ছুটি কাটানোর জন্য নয়, বরং আত্মত্যাগ, তাকওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য সুযোগ। তাই আমাদের উচিত, এ সময়টিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, সুন্নত ও বিধান মেনে চলা এবং কুরবানীর প্রকৃত শিক্ষাকে জীবনে ধারণ করা।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে। হজরত জায়দ ইবনে আকরাম বলেন, সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম (সা.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করেন, কুরবানি কী? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কুরবানি হলো তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত।’এতে আমাদের সওয়াব কী? নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কুরবানির পশুর প্রত্যেকটি পশমের বদলায় একটি করে সওয়াব রয়েছে। ভেড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ভেড়ার প্রত্যেকটি পশমের বদলায়ও একটি করে সওয়াব রয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ্জ- ৩৭)