পাবনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের বিদ্যুুৎ ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত

পাবনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: বাংলাদেশের শক্তি ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে ২.৪ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যা বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যার প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালে কার্যক্রম শুরু করবে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন-এর সহযোগিতায় নির্মিত হয়।

বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পারমাণবিক শক্তিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে। পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে নির্মিত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা দেশের প্রথম পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প। এই কেন্দ্রটি বাংলাদেশের শক্তি খাতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সহায়তা করবে।


রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থান

বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ২'শ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার অন্তর্গত পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে নির্মিত হয় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রকল্পটি পদ্মা নদীর উপরে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে অবস্থিত।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা

১৯৬১ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬২ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদীর পার্শ্ববর্তী রূপপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের যথার্থতা যাচাই করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৬৮ সালের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেষ্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক উপ-কেন্দ্র ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজ আংশিক সম্পন্ন করা হয়। ১৯৬৯ সালে ২০০ মেগা-ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৭৭-১৯৮৬ সালে "মেসার্স সোফরাটম" কর্তৃক একটি সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন চালানো হয় ও এর মাধ্যমে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন যৌক্তিক বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। পরে একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১২৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৮৭ সালে জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডের দুইটি কোম্পানি কর্তৃক দ্বিতীয়বার সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন করা হয়। এ অধ্যয়নে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রেক্ষাপট

২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি) এবং রাশিয়ার রোসাটম কোম্পানিকে। ২০২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০২৫ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিট চালু করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

এই প্রকল্পে দুটি ইউনিট থাকবে, যার প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ১,২০০ মেগাওয়াট। মোট ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে এই কেন্দ্র, যা জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে এবং দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার সর্বাধুনিক ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তৃতীয় প্রজন্মের পারমাণবিক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি অত্যন্ত নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব। এতে রয়েছে নানাবিধ স্বয়ংক্রিয় সুরক্ষা ব্যবস্থা, যেমন:

  • প্যাসিভ সেফটি সিস্টেম – বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিয়্যাক্টর শীতল হবে।
  • ডাবল কনটেইনমেন্ট স্ট্রাকচার – কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তেজস্ক্রিয়তা বাইরে ছড়াতে পারবে না।
  • ভূমিকম্প প্রতিরোধী ডিজাইন – ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও কেন্দ্রটি নিরাপদ থাকবে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA) এবং বাংলাদেশের পরমাণু নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত তদারকি করছে।

অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার, যা রাশিয়ার সহায়তায় অর্থায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এই প্রকল্প দেশের জ্বালানি খাতের ব্যয় কমাবে, কারণ পারমাণবিক শক্তি জ্বালানি তেল বা গ্যাসের তুলনায় সস্তা এবং স্থিতিশীল।

পরিবেশের দিক থেকে পারমাণবিক শক্তি কার্বন নিঃসরণ কমায়, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক। তবে, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি চ্যালেঞ্জ, যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।


স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া ও সুবিধা

এই প্রকল্পের কারণে ঈশ্বরদী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয়রা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়াও, রাস্তাঘাট, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন হয়েছে।

তবে কিছু মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত, যা সরকার ও বিশেষজ্ঞরা নানাভাবে সচেতনতা তৈরি করে দূর করতে কাজ করছেন।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় একটি মাইলফলক। এটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রকল্প একটি টেকসই ও নিরাপদ শক্তির উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই কেন্দ্র চালু হলে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর কাতারে নাম লেখাবে এবং টেকসই উন্নয়নের দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url