গরুর মাংসে যেসকল পুষ্টিগুন রয়েছে । গরুর মাংস সংরক্ষন পদ্ধতি । অতিরিক্ত মাংস খেলে যে সমস্যা হতে পারে
বাঙ্গালি জাতীর / মুসলমানদের প্রিয় খাবার হচ্ছে গরুর গোস্ত/মাংস। গরুর গোস্ত/মাংস স্বাদের দিক থেকে সেরা। যত প্রকার পশুর পাখির গোস্ত/মাংস রয়েছে সকল গোস্ত/মাংসের সেরা গরুর গোস্ত/মাংস। মাংস প্রিয়দের গরুর মাংস ছাড়া যেন চলেই না। আসছে মুসলমানদের প্রিয় কুরবানীর ইঈ এই ঈদে প্রায় মানুষ ই কুরবানী দিবে গরু। আর এই গরুর গোস্ত ভুনা করে, রান্ন করে, কালাভুনা করে, কষা রান্না সহ নানান প্রকার আইটেম তৈরি করে গরুর গোস্ত খাবে মাসলমানরা।
গরুর গোস্ত একটি খুবই জনপ্রিয় খাদ্য উৎস, যা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে প্রচলিত। এটি প্রধানত প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি১২, আয়রন এবং জিংকের উৎস হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও, গরুর গোস্তে ভিটামিন ডি এবং সিলেনিয়াম ও ফলাফলশীল ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গরুর গোস্তে প্রোটিন মূলত শরীরের পুঁজি গড়ে তুলে দেয়। এটি শিশুদের গঠনশীল অবস্থা বৃদ্ধি করে এবং পুরুষ ও মহিলা উভয়ের প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে। তাছাড়া, গোস্তে ভিটামিন বি১২ অন্তত ১০০ গ্রামের প্রতি মিলিগ্রামের পরিমাণ থাকে, যা হেমোগ্লোবিন প্রস্তুতি ও স্নায়ুতন্ত্র সুধারে সহায়ক।
গরুর গোস্তে আয়রন ও জিংক পরিমাণগুলি উচ্চ থাকার জন্য মাংসখাদ্য প্রাচুর্যে পুরুষদের জন্য উপকারী হয়ে উঠে। জিংক সুস্থ প্রজনন ক্ষমতা ও ইমিউন সিস্টেম কে সক্ষম করে।
এছাড়াও, গরুর গোস্ত ফলাফলশীল ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং সিলেনিয়াম প্রস্তুতি কে সহায়তা করে, যা হৃদরোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এই তাত্ত্বিক সংক্রান্ত তথ্যের সাথে, গরুর গোস্ত ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাবার হিসেবে পরিচিত এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের খাদ্যসংস্কৃতিতে নিশ্চিতভাবে অনুসরণ করা হয়।
গরুর মাংসে যেসকল পুষ্টিগুন রয়েছে
আমরা অনেকেই মনে করি গরুর মাংস খেলে বুঝি কেবল ক্ষতিই হয়। তবে পুষ্টিবিদরা বলছেন, এই তথ্য সঠিক নয়। বরং গরুর মাংসে এমন সব উপকারী উপাদান একসাথে মেলে, যা অন্যান্য খাবারে সাধারণত একসঙ্গে পাওয়া যায় না। ডাক্তার তাসনিম জারা একটি ভিডিও বার্তায় বলেন, গরুর মাংসে অতি উচ্চমানের প্রোটিন মেলে। এই প্রোটিন আমাদের চুল, ত্বক মাংস পেশী, হরমোনসহ অনেক কিছু গঠনে সাহায্য করে। মাংসে থাকা ভিটামিন বি১২ আমাদের মস্তিষ্ককে ভালো রাখে। এতে থাকা আয়রন আমাদের রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। রয়েছে জিঙ্ক, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
একই তথ্য জানালেন ফরাজি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক লিমিটেডের পুষ্টিবিদ নাহিদা আহমেদ। তিনি জানান, গরুর মাংস প্রোটিন, ভিটামিন (বি১, বি৩, বি৬ ও বি১২), জিংক, সেলেনিয়াম, ফসফরাস ও আয়রনের দারুণ উৎস। এই পুষ্টি উপাদানগুলোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতাও অনেক। সাধারণত কোনও সুস্থ ব্যক্তি সপ্তাহে দুই দিন লাল মাংস খেলে তা তেমন কোনও জটিলতা তৈরি করে না। তবে ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জটিলতাসহ অন্য রোগ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাংস খেতে হবে।
ঈদের আনন্দ নষ্ট হতে পারে ১০ ভুলে
- মাংস রান্নায় দৃশ্যমান জমানো চর্বি বাদ দিয়ে রান্না করতে হবে এবং কম তেলে রান্না করতে হবে।
- গরুর মাংসে উচ্চমানের প্রোটিন আছে। তাই দিনে ৭০ গ্রামের বেশি প্রোটিন বা সপ্তাহে ৫০০ গ্রামের বেশি খাওয়া উচিত প্রতিদিনের প্রোটিনের চাহিদা শুধু মাংস দিয়েই পূরণ করা যাবে না।
- যে দিন গরুর মাংস বেশি খাওয়া হবে, সেদিন অন্যান্য প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
- গরুর মাংসে অ্যানাফিল্যাক্সিস নামে যৌগ আছে যেটি অনেকের ক্ষেত্রে অ্যালার্জির সৃষ্টি করতে পারে। তাই অল্প পরিমাণে খাওয়া উচিত।
- গরুর মাংস খাওয়ার পরপরই দুধ বা দুধের তৈরি খাবার খাওয়া উচিত নয়। এতে হজমের গণ্ডগোল অথবা গ্যাস্ট্রিকের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- যাদের থ্যালাসেমিয়া বা হেমাক্রোমাটোসিস নামে রক্তরোগ আছে, তাদের গরুর মাংস খাওয়া উচিত নয় কারণ, গরুর মাংসে যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন আছে।
- অতিরিক্ত রেড মিট খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যাও দেখা যায় । কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে দূরে থাকতে চাইলে প্রচুর পরিমাণে পানি ও পানিজাতীয় খাবার খেতে হবে।
- স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে গরুর মাংস ভালো করে সেদ্ধ করে খেতে হবে। কারণ, লাল মাংসে টিনিয়া সোলিয়াম নামে একধরনের বিশেষ কৃমিজাতীয় পরজীবি থাকে। ভালোভাবে সেদ্ধ না হলে কৃমিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
- যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, তারা অবশ্যই চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ ব্যতীত না খাওয়াই উত্তম।
- মাংস খাওয়ার সময় সঙ্গে সালাদ রাখুন। এছাড়া ক্যাপসিকাম, বাঁধাকপি, মাশরুম বা পছন্দের সবজি দিয়ে মাংস রান্না করা যেতে পারে। এতে কম পরিমাণ মাংস খাওয়া হবে।
গরুর মাংস সেদ্ধ করার সহজ উপায়-
- গরুর মাংস সেদ্ধ করার জন্য কাঁচা পেঁপের জুড়ি নেই। মাংস তাড়াতাড়ি সিদ্ধ করতে কয়েক ফোঁটা পেঁপের আঠা বা কয়েক টুকরো কাঁচা পেঁপে দিতে পারেন। দেখবেন খুব সহজেই সেদ্ধ হবে গরুর মাংস।
- গরুর মাংস রান্না করার সময় ১০ মিনিট পর সামান্য চিনি দিতে পারেন। চিনি দিলে মাংস তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়।
- ঢাকনা দিয়ে চাপ দিয়ে ঢেকে দিন।
- মাংস দ্রুত সেদ্ধ কারার জন্য একটি সুপারি দিয়ে দিতে পারেন। সুপারি দিলে মাংস তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়।
- মাংস রান্নার সময় পাত্রে একটা তামার পয়সা ফেলে দিলে মাংস তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। বাবুর্চিরা মাংস তাড়াতাড়ি সেদ্ধ করার জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
- রান্নার মাঝামাঝি সময়ে লবণ দিন।
গরুর মাংস সংরক্ষন পদ্ধতি
অনেকে বাজার থেকে বেশি পরিমাণে গরুর মাংস কিনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করেন। এ ছাড়া কোরবানির ঈদ এলে এই চিত্র আরও বেশি দেখা যায়। কিন্তু ফ্রিজে কত দিন পর্যন্ত মাংস রাখা নিরাপদ এবং স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ঠিক থাকে, তা হয়তো অনেকের জানা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন জানাচ্ছে, কাঁচা ও রান্না করা গরুর মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। এই সময়ের মধ্যে খেলে মাংসের স্বাদ ও গুণগত মান ভালো থাকে।গরুর কাঁচা মাংসের সংরক্ষণকাল
- রোস্ট বা বড় টুকরা: চার মাস থেকে সর্বোচ্চ ১২ মাস পর্যন্ত ফ্রিজারে রাখা যায়।
- স্টেক: ৬ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।
- কিমা: কাঁচা কিমা ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে খাওয়া ভালো।
- রান্না করা গরুর মাংস
- রান্না করা গরুর মাংস ফ্রিজে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। এরপর খাওয়া গেলেও স্বাদ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
- ফ্রিজে বেশি দিন রাখলে মাংস নষ্ট না হলেও স্বাদ এবং গুণগত মান কমে যেতে পারে।
- মাংস সংরক্ষণের আগে ভালোভাবে মোড়ানো বা এয়ার-টাইট প্যাকেটে রাখা উচিত, যাতে বরফ জমে না যায়।
- খাওয়া কিংবা রান্নার আগে ভালোভাবে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনতে হবে।
অতিরিক্ত গরুর গোস্ত/মাংস খেলে যে সকল সমস্যা হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও কোলন ক্যানসার: অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে বেড়ে যায় কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ঝুঁকি। আর এই কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পরবর্তীতে শরীরে আরও অনেক রোগ বাসা বাধে। যারা প্রায় প্রতিদিনই খাবার পাতে গরুর মাংস রাখে তাদের কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। দিনের পর দিন মাংস খেলে ফুসফুস ক্যানসার, খাদ্যনালীর ক্যানসার, লিভার ক্যানসার, মলাশয় ক্যানসার ও অগ্ন্যাশয় ক্যানসারও হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ: গরুর মাংসে থাকে অতিরিক্ত সোডিয়াম যা শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এই উপাদানটি উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে এবং বাড়ায়। তাই অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। যা পরবর্তীতে বাড়াবে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি। গবেষণা অনুযায়ী, যারা নিয়মিত লাল মাংস খান তাদের মধ্যে ধূমপান, মদ্যপানের মতো নানা অভ্যাস গড়ে ওঠে। যা ধীরে ধীরে হৃদরোগ ও ক্যানসারের কারণ হয়।
কিডনি রোগের ঝুঁকি: অতিরিক্ত মাংস খেলে এর মাত্রাতিরিক্ত প্রোটিন কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রাও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ায় এটি।
ডায়াবেটিস হতে পারে: ১ মিলিয়ন মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালায় হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এতে দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ৫০ গ্রাম বা এর চেয়ে বেশি মাংস খান, তাদের হার্টের অসুখ হওয়ার ঝুঁকি থাকে অন্যদের তুলনায় ৪২ শতাংশ এবং ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে ১৯ শতাংশ। ৪০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে বেশি মাংস খেলে হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়ে ৩ গুণ।
ওজন বাড়তে পারে: পশুর ওজন বাড়াতে এবং পশুকে রোগমুক্ত রাখতে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও হরমোনাল ওষুধ খাওয়ানো হয়। মাংস খাওয়ার মাধ্যমে এসব উপাদান মানবদেহে প্রবেশ করলে মারাত্মক ক্ষতি করে। অল্প বয়সে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস বা স্পার্মের সংখ্যা কমে যেতে পারে এই কারণে। পাশাপাশি ব্রেইনের কার্যক্ষমতা হ্রাস, স্মৃতিশক্তি হ্রাসসহ শরীরের ওজন বাড়তে পারে।