চোখের সমস্যার জন্য শীর্ষ ১০টি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ


চোখের সমস্যার জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধ: একটি প্রাকৃতিক বিকল্প চিকিৎসা

চোখ আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চোখের সামান্য সমস্যাও জীবনের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার, দূষণ, অনিদ্রা এবং পুষ্টির অভাব ইত্যাদি কারণে চোখের নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে—যেমন চোখ লাল হওয়া, চুলকানি, জল পড়া, ঝাপসা দেখা, চোখ শুকিয়ে যাওয়া বা মাথাব্যথাসহ চোখে ব্যথা হওয়া। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে অনেকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার আশ্রয় নেন, কারণ এটি প্রাকৃতিক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা: কিভাবে কাজ করে?

হোমিওপ্যাথি মূলত রোগীর সামগ্রিক লক্ষণ ও মানসিক অবস্থার ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচন করে। অর্থাৎ একই চোখের সমস্যা হলেও দুইজন ভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ প্রযোজ্য হতে পারে। তবে কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো চোখের নির্দিষ্ট সমস্যায় সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয় এবং ভালো ফল দেয়।

Euphrasia -

তীব্র(Acute) শ্লেষ্মা(catarrhal) নেত্রপ্রদাহ ।
চোখ ঘন ঘন পানি আসে এবং চোখ মিটমিট করার প্রবণতা থাকে ।
চোখ থেকে জ্বালাকর স্রাব বের হয়, যাতে চোখের পাতার প্রান্তে ক্ষত হয়ে যায়।
কর্নিয়ার অস্বচ্ছতার সাথে জ্বালাকর ঘন স্রাব নিঃস্বরণ হয়।
কর্নিয়ায় ফুস্কুড়ি বা স্ফুটক হয়।
বাতজনিত কারণে চোখের আইরিস প্রদাহসহ আংশিকভাবে চোখের পাতা প্যারালাইসিস (ptosis) এর ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে ভাল একটি অষুধ।
প্রায় সবসময়ই চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরতেই থাকে।
চোখের পাতা ফোলাসহ জ্বলা থাকে, যা খোলা বাতাসে ভাল অনুভব করে।
সন্ধ্যায়, গৃহমধ্যে , আলো, উষ্ণতায় বৃদ্ধি।
মুক্ত বাতাস , কফি পানে, অন্ধকারে হ্রাস পায়।
নেত্রপ্রদাহ সঙ্গে যুক্ত এলার্জিক রাইনাইটিস এর ক্ষেত্রে চোখ ও নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরাকে এলিয়াম সেপা (Allium cepa) সঙ্গে তুলনা করা যায়।

Ambrosia

এলার্জিজনিত চোখের সমস্যা।
চোখের পাতায় অসহনীয় চুলকানি।
চোখে হালকা ব্যথা এবং জ্বলাসহ পানি ঝরতে পারে এবং নাক থেকে রক্ত আসতে পারে।
প্রায় সবসময় চোখের সমস্যার সঙ্গে বুকে সাঁইসাঁই শব্দসহ কাশি থাকে।
স্যাবাডিলা (Sabadilla), আরন্ডো (Arundo) সঙ্গে তুলনা করা যায়।

Ruta

চোখ টনটনানিসহ মাথাব্যথা।
চোখে ব্যথাসহ লালচে গরম পানি আসে।
বিশেষ করে সূক্ষ্ম মুদ্রণ সেলাই বা পড়ার সাথে সম্পৃক্ত।
দৃষ্টিশক্তির সামঞ্জস্যের সমস্যা।
মাথা ব্যাথা সঙ্গে চোখ শ্রান্তি।
চোখের যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত অত্যধিক দুর্বলতা (lassitude)।
চোখের উপর থেতলানো মত এবং চাপ অনুভূতি।
নেট্রাম মিউর (Natrum mur), আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম (Argentum nitricum) এর সঙ্গে তুলনীয়।

Pulsatilla

পালসেটিলা চোখের যন্ত্রণার জন্য হোমিওপ্যাথিতে সবচেয়ে অমূল্য একটি ওষুধ।
চোখ থেকে অহেজাকর, ঘন, হলদে এবং সবুজাভ স্রাব নিঃস্বরণে এটিকে মনে রাখা উচিত।
চুলকানি এবং জ্বালা অনুভুতি এর সঙ্গে যুক্ত।
পৌনঃপুনিক অঞ্জনীতে ওষুধ সেবনকালীন অবশ্যই Pulsatilla এর একটি ডোজ প্রয়োজন।
চোখের উপর পাতায় প্রদাহিত শক্ত গুটি থাকতে পারে।
তীব্র নেত্রপ্রদাহের সাথে হজমজনিত সমস্যা থাকে।
লক্ষণ সর্বদাই পরিবর্তনশীল, সেটা রোগজ হোক আর মানসিক হোক।
স্কন্ধ এর শিরা বৃহদাকার।
সব সমস্যা উষ্ণ রুমে খারাপ এবং খোলা বাতাসে ভাল।

Spigelia

চোখে স্নায়ুবিক যন্ত্রনা।
চেপে ধরা মত ব্যথা যা এদেরকে ঘুরিয়ে ফেলে।
চরম আলোকাতঙ্ক থাকে।
গাঁটের ফোলা ও ব্যথাসহ চোখের প্রদাহ।
চোখের মধ্যে গভীরে এবং চোখের চারপাশে ব্যাথা অনুভব অর্থাৎ চোখের বলে চাপ দেওয়া মত অসহ্য যন্ত্রনা।
চোখের কোটরের অনুপাতে চোখ খুব বড় মনে হয়।
স্পর্শে অত্যন্ত সংবেদনশীল, মাথার চারপাশে শক্ত বন্ধনী দেওয়া আছে মনে হয়।
স্পর্শ, উত্তেজনা, গোলমাল বা কোলাহলপুর্ণ পরিবেশে এবং সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বৃদ্ধি।
মাথা উচু করে শুয়ে থাকলে ভাল অনুভব করে।

Apis mellifica

জ্বালাযুক্ত ও চুলকানিসহ ফোলা এবং নিচের পাতায় শোথ ( উপরের পাতায়- কেলি কার্ব)।
চোখ উজ্জ্বল লাল ফোলা থাকে।
অঞ্জনীর পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করে।
অক্ষিগোলকে ব্যথাসহ পাতলা তরল নিঃস্বরণ হয়।
শোথ থাকে কিন্তু পিপাসাহীন ( শোথ কিন্তু পিপাসা থাকে-এপোসাইনাম, এসেটিক এসিড)।
প্রস্রাবে সমস্যার সাথে চোখের সমস্যা থাকে।
তাপ , স্পর্শ , চাপ, ডান দিকে বৃদ্ধি।
ঠান্ডা পানিতে ধোওয়া , মুক্ত বায়ুতে হ্রাস।

Merc Sol

উপদংশ (Syphilis) রোগী চোখের সমস্যা।
চোখের পাতা মোটা , লাল, ফোলা।
প্রচুর জ্বলন্ত হেজাকর স্রাব নিঃস্বরণ।
অগ্নি ইত্যাদি একদৃষ্টি মরেছে পরে আরম্ভ চোখের সমস্যা।
আইরিস প্রদাহসহ ঘন হেজাকর নিঃস্বরণ হয়।
অত্যন্ত গন্ধযুক্ত চোখের স্রাব নিঃস্বরণ।
চোখে এবং এর চারপাশে ফুড়া হয় যা থেকে হলুদ পূঁজ বের হয়।
রাতে, ভেজা স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, উষ্ণতায় বৃদ্ধি।

(৮) Silica -

দিনের আলো চোখে ধারালো( Sharp) ব্যথা উৎপন্ন করে।
চোখ বন্ধ বা চাপ প্রয়োগ করলে স্পর্শানুভুতি আরোও বেড়ে যায়।
চোখের অগ্র অংশে পূঁজ তৈরী হয়, আইরিশ প্রদাহ।
পড়ার সময় দৃষ্টি বিভ্রান্তের জন্য- সাজানো অক্ষরগুলো দৌড়াচ্ছে মনে হয়।
চোখের পানিবাহিত (Lachrymal) নালী আক্রান্ত হয়।
হোমিওপ্যাথিকভাবে নির্দেশিত হলে এটি কর্নিয়ার অস্বচ্ছতার পরিষ্কার করে।
অফিসে কর্মীদের মধ্যে চোখের ছানি।
অমাবস্যা , ঠান্ডা বৃদ্ধি।
উষ্ণতায় হ্রাস পায়।

(৯) Hepar sulph -

কর্নিয়ার ক্ষত।
পূঁজযুক্ত চোখের সমস্যা , আইরিস প্রদাহসহ অগ্র স্তরে বা কক্ষে পূঁজ।
নেত্রপ্রদাহ(Conjunctivitis) সঙ্গে পূঁজপুর্ণ নিঃস্বরণ।
চোখের পাতা এবং কঞ্জাংটিভাতে লাল এবং প্রদাহ হয়।
অক্ষিগোলকে ব্যথা।
চোখের অক্ষিকোটর (eyeballs) ক্ষতবদ বেদনা (Soreness)।
বস্তুসমূহ লাল এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত প্রদর্শিত হয়।
দৃষ্টিক্ষেত্র অর্ধ-হ্রাস পায়।
ব্যথা এবং পূঁজসহ অঞ্জনী।
ঠান্ডা, স্পর্শ, ঠান্ডা আবহাওয়ায় বৃদ্ধি।
উষ্ণতা , মাথা আবৃত রাখলে হ্রাস পায়।

(১০) Agaricus -

চোখের সামনে ফুল্কি উড়ার সঙ্গে দ্বিত্ব দৃষ্টি।
চোখের পাতা এবং অক্ষিগোলক এর ঝাঁকুনি ( Twitching)।
স্নায়ুতন্ত্রের বেদনাসহ (Neuralgic) চোখের যন্ত্রনা।
পড়ার সময় অক্ষরগুলো নড়াচড়া করে, সাঁতার কাটছে বলে মনে হয়।
চোখের পাতার ভিতর প্রান্ত লালচে ও প্রদাহ, জ্বালাকর ব্যথা, প্রান্ত শক্ত গুটির মত।
চোখের যন্ত্রণা মাথাঘূর্নণ এবং বরফতুল্য ঠান্ডা মাথার সঙ্গে যুক্ত।
খোলা ঠান্ডা বাতাসে বৃদ্ধি।

ব্যবহারের উপায় ও গুরুত্ব

  • ডায়াগনসিস: প্রথমেই চোখের সমস্যার প্রকৃতি নির্ণয় করুন—উদাহরণস্বরূপ, লাল ভাব, জ্বালা, photophobia, জল পড়া, ঝাপসা দেখা ইত্যাদি।

  • পটেন্সি: রূপান্তরিত লক্ষণ অনুযায়ী ৬C–৩০C সাধারনভাবে ব্যবহৃত হয়; গুরুতর ক্ষেত্রে ২০০C বা বেশি পটেন্সি প্রয়োগ করতে হতে পারে।

  • ডোজ: সাধারণত দিনে ২–৩ বার ২–৩টি পিললেট পানি ছাড়া (খালি মুখে) দিন। লক্ষণ না কমলে অথবা বেশি খারাপ হলে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।

  • যথাযথ ব্যবধান: প্রতিবার ডোজ নেওয়ার আগে অন্তত ১৫–৩০ মিনিট খানেক পানি বা খাবার না খেয়ে খালি সময় বজায় রাখুন।

সতর্কতা ও ব্রিফ বিশ্লেষণ

  • এই ঔষধগুলো চোখের ন্যূনতম—মামুলি সংক্রমণ, ক্লান্তি, অ্যালার্জি অথবা দীর্ঘ স্ক্রীন ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট সমস্যায় সহায়ক।
  • তবে চোখের পেছনের সমস্যা (যেমন: গ্লুকোমা, চোখে ভাসা অন্ধকার, স্থায়ী ঝাপসা দেখা, চোখে আঘাত)–এর ক্ষেত্রে অবশ্যই চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
  • লক্ষণ না কমলে বা অগ্রগতি না ঘটলে নিজে ডোজ না বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট হোমিওপ্যাথি/চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ব্যক্তিবিশেষের জন্য সাজেশন

  • যদি আপনি সারাদিন কম্পিউটার/স্মার্টফোনে কাজ করেন, তবে Ruta graveolens বা Phosphorus আপনাকে চোখের ক্লান্তি নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে।
  • যদি চোখে জল পড়া বা আল্টার্জি থাকে, তাহলে Euphrasia, Pulsatilla বা Belladonna খুব কার্যকর।
  • যদি চোখে সংক্রমণ বা ফোলা থাকে, তবে Hepar sulph বা Silicea প্রাথমিক প্রয়োগে কাজে লাগে।

হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, যথাযথ লক্ষণভিত্তিক ব্যবহারে চোখের অনেক সাধারণ সমস্যা সহজেই লাঘব করতে পারে। উপরের ১০টি ঔষধ হলো চোখের ক্লান্তি, সংক্রমণ, photophobia, অ্যালার্জি ও দীর্ঘক্ষণ স্ক্রীন ব্যবহারজনিত সমস্যা নিরাময়ে সবচেয়ে সাধারণ ও কার্যকর উপায়। তবে কোনো অবস্থাতেই নিজে নিজে নৈতিকতা সঠিক না হলে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার, ডোজ বাড়ানো বা গুরুতর লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

পোস্টটা নবীন ডাক্তারদের জন্য লিখিত। সুতরাং হোমিওপ্যাথি অর্গানন অব মেডিসিন সম্পর্কে যাদের জ্ঞান নেই তাঁরা নাম জেনেই নিজে নিজে সেবন করতে যাবেন না। এতে হিতে বিপরীত হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url