চলন বিল । চলন বিলের মানুষের জীবন যাত্রা


চলন বিল: প্রকৃতির কোলে লালিত এক জীবনকাহিনী

বাংলাদেশ নদী, খাল, বিল আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ। এই দেশের বুকে ছোট-বড় অসংখ্য বিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যেগুলো এদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। চলন বিল বাংলাদেশের বৃহত্তম বিল ও অন্যতম সমৃদ্ধ জলাভূমি, যা নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। এটি বিভিন্ন ছোট ছোট বিলের সমষ্টি এবং আত্রাই, বড়াল, যমুনা নদীর মতো নদী ও খাল দ্বারা সংযুক্ত। এই বিলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র, যেখানে অনেক জলজ প্রাণী ও সরীসৃপ বাস করে এবং এটি মৎস্য চাষের জন্যও পরিচিত। শুধু আকারেই নয়, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং এখানকার মানুষের অনন্য জীবনযাত্রা এটিকে করে তুলেছে অসাধারণ।

ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

চলনবিল প্রাথমিকভাবে নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। এটি মূলত একটি গঠিত অঞ্চল যেখানে বেশ কয়েকটি ছোট বিল মিলে একটি বিশাল জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। বর্ষাকালে এটি এক বিরাট অভ্যন্তরীণ সমুদ্রে পরিণত হয়, যার আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার থেকে ১,০০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। তবে শুষ্ক মৌসুমে এর জলাবদ্ধ এলাকা পানি সুকিয়ে জমিগুলো চাষ যোগ্য হয়ে আসে,  দ্রুত চাষযোগ্য উর্বর জমিতে কৃষক ফসল ফলাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। সেখানে, সরিষা , মাসকালাই, রসুন, পিয়াজ সহ প্রায় সকল প্রকারের ফসলই ফলিয়ে থাকে কৃষকগন।

এই ‘চলন’ বা পরিবর্তনশীল প্রকৃতিই এর নামের উৎস। বর্ষায় ধানক্ষেত, মাছের ভেদি, গ্রামের রাস্তা সবকিছু পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। অন্যদিকে, শীতকালে যখন পানি শুকিয়ে যায়, তখন সেখানে জন্ম নেয় নানা রকমের শাকসবজি, ধান ও অন্যান্য ফসল। এই ঋতুভিত্তিক রূপান্তর চলনবিলের মানুষের জীবনযাত্রাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, তাদের তৈরি করেছে অভিযোজনক্ষম ও সংগ্রামী।

এক নজরে চলন বিল

চলন বিল শুধু একটি জলাভূমি নয়, এটি একটি প্রাণবন্ত বাস্তুতন্ত্র। বর্ষাকালে এই বিলের আয়তন প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়, যা দেখতে এক বিশাল অভ্যন্তরীণ সমুদ্র-এর মতো মনে হয়। শুকনো মৌসুমে এই পানি কমে গিয়ে জেগে ওঠে উর্বর মাটি, যা পরিণত হয় সবুজ শস্যভাণ্ডারে। এই বিলটি মূলত আত্রাই, গুড়, বড়ালসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি ধারণ করে এবং বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি অসংখ্য মাছ, পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল, যা এখানকার জীববৈচিত্র্যকে করেছে সমৃদ্ধ।

চলন বিলের মানুষের জীবনযাত্রা: প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম ও সহাবস্থান

চলন বিলের মানুষের জীবন পুরোপুরিই প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলে। তাদের জীবনযাত্রা দেখলে বোঝা যায়, কীভাবে মানুষ প্রকৃতির সাথে আত্মীয়তা গড়ে তুলে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেয়।

অবস্থান ও বিস্তৃতি

  • চলন বিল উত্তরবঙ্গের নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ১৩টি উপজেলায় বিস্তৃত।
  • এর আয়তন মৌসুমভেদে পরিবর্তিত হয়—বর্ষাকালে প্রায় ৮৬০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত জলমগ্ন থাকে, শুকনো মৌসুমে অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে যায়।

জলে ভাসমান জীবন: বর্ষাকালে চলন বিলের গ্রামগুলো দেখতে প্রায় দ্বীপে মত হয়। ঘরবাড়ি একটু  উপর উঁচু করে বানানো হয়। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। স্কুলে যাওয়া, বাজার করা, ডাক্তারের কাছে যাওয়া - সবকিছুই নৌকার উপর নির্ভরশীল। শিশুরাও নৌকা চালাতে শেখে, এটি তাদের বেঁচে থাকার একটি মৌলিক দক্ষতা।

প্রকৃতি ও গঠন

  • এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল।
  • বিল বলতে স্থানীয়ভাবে মৌসুমি হ্রদ বা জলাশয়কে বোঝানো হয়।
  • বর্ষাকালে আশেপাশের নদ-নদী যেমন আত্রাই, বড়াল, করতোয়া প্রভৃতি নদী থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে বিলটিকে ভরে তোলে।
  • শুষ্ক মৌসুমে বিল শুকিয়ে চাষাবাদযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত হয়।

মাছধরা: প্রধান জীবিকা চলন বিলের মানুষদের প্রধান পেশা মাছধরা। বিলে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। জেলেরা তাদের নৌকা ও জাল নিয়ে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা মাছ ধরতে বের হয়। এই মাছ স্থানীয় মেটানোর পাশাপাশি দেশের করা হয়, যা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখে। অনেক পরিবার মাছ শিকার, সংরক্ষণ ও বিক্রির সাথে জড়িত।

মৎস্য সম্পদ

  • একসময় চলন বিল ছিল বাংলাদেশের মাছের ভাণ্ডার।
  • এখানে প্রায় ১০০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত।
  • এখনো ইলিশ, শোল, গজার, কই, টাকি, টেংরা, পুটি, বোয়ালসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরা হয়।
  • তবে অতিরিক্ত মাছ ধরা, কীটনাশক ও পরিবেশ দূষণের কারণে মাছের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

কৃষিকাজ: শুকনো মৌসুমের সোনালি ফসল বর্ষা শেষে যখন বিলের পানি কমে যায়, তখন জেগে ওঠা উর্বর জমিতে কৃষি মৌসুমে ধান, গম, সরিষা, ডাল বিভিন্ন ফসল চাষ করেন। এই জমি এতটাই উর্বর যে, বিনা  রাসায়নিক সারেই বাম্পার ফসল হয়। শুকনো মৌসুমে চলন বিলের দিগন্তজুড়ে সোনালি ধানের মাঠের দৃশ্য সৃষ্টি করে।

কৃষি

  • শুকনো মৌসুমে চলন বিলের জমিতে প্রচুর ধান, পাট, গম, ভুট্টা এবং বিভিন্ন সবজি চাষ হয়।
  • এখানে উৎপাদিত ধান উত্তরবঙ্গসহ দেশের খাদ্যচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গবাদিপশু পালন ও হাঁস-মুরগি: বিলের অনেক পরিবার মুরগি, পতিহাঁস এবং রাজহাঁস পালনে নিয়োজিত থাকে। এই হাঁস - মুরগি সহজেই প্রাকৃতিক পরিবেশে লালিত-পালিত হয়। এছাড়াও, অনেক মানুষ কচুরিপানা এবং অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে এবং হস্তশিল্প যেমন- মাদুর, ব্যাগ, ঝুড়ি তৈরি করে যা তাদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস হয়ে ওঠে।

পাখি ও জীববৈচিত্র্য

  • একসময় এটি ছিল অভয়ারণ্যের মতো পাখির স্বর্গরাজ্য।
  • শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি এখানে আসত। যেমন: বক, চখাচখি, সরালি, পাতি রাজহাঁস, পানকৌড়ি ইত্যাদি।
  • এখনো পাখি আসে, তবে শিকার ও পরিবেশ নষ্টের কারণে সংখ্যা কমে গেছে।
  • এছাড়া বিলের চারপাশে বিভিন্ন সরীসৃপ, উভচর ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্যও রয়েছে।

চলনবিলের মানুষের সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন: প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক চলনবিলের মানুষের সংস্কৃতি ও লোককাহিনী-কে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের গান, কবিতা এবং লোককাহিনী প্রায়শই জল, নৌকা এবং মাছ ধরা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়।'ভাটিয়ালি' ও 'মুর্শিদী' গান এ অঞ্চলের মানুষের খুব প্রিয়।

তাদের ঘরবাড়িও অনন্য: বন্যার জল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক বাড়ি মাটির টিলা বা উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর তৈরি করা হয়। বর্ষার তীব্র সময়, যখন ঘরে জল প্রবেশ করে, তখন জীবন অভিযোজিত হয় - রান্না, ঘুম এবং অন্যান্য কাজ বাড়ির ভিতরে উঁচু প্ল্যাটফর্মে করা হয়। দেখাতে বাড়ীটা অনেকটা দীপের মত।

যোগাযোগ ও পর্যটন

  • চলন বিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।
  • বর্ষায় নৌকাভ্রমণ অত্যন্ত জনপ্রিয়।
  • এখানে মাছ ধরা, গ্রামের মেলা, নৌকাবাইচ ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ।
  • সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকরা বিল দেখতে ভিড় জমায়, বিশেষত বর্ষার মৌসুমে।

বিপদ, চ্যালেঞ্জ ও সংগ্রাম

চলনবিলের মানুষের জীবন সংগ্রামে ভরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন আকস্মিক বন্যা বা আকস্মিক বন্যা ফসল এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে পারে। স্থায়ী রাস্তাঘাট এবং অবকাঠামোর অভাব স্বাস্থ্যসেবা এবং মাধ্যমিক শিক্ষার অ্যাক্সেসকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। বর্ষাকালে শিশুরা প্রায়শই স্কুলে যেতে পারে না। বিশুদ্ধ পানীয় জলেরও অভাব রয়েছে, কারণ বন্যার জল বেশিরভাগ পুকুর এবং কূপকে দূষিত করে।

অধিকন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিপাতের ধরণ এবং ঋতুর তীব্রতার পরিবর্তন ঐতিহ্যবাহী কৃষি ও মাছ ধরার ক্যালেন্ডারকে ব্যাহত করে, জীবনকে আরও অনিশ্চিত করে তোলে।

তাদের জীবনযাত্রা সংগ্রামের বর্ষাকালে, তীব্র বন্যা প্রায়শই ঘরবাড়ি, ফসল এবং অবকাঠামোর ক্ষতি করে। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় জলাবদ্ধতার কারণে শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। উপরন্তু, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অবৈধ মাছ ধরার পদ্ধতির ব্যবহার বিলের জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।

পরিশেষে বলা যায় চলন বিল শুধু একটি ভৌগলিক অবস্থান নয়। এটি একটি সংস্কৃতি এবং একটি জীবনধারা-প্রতিকৃতি এখানকার মানুষ প্রকৃতির সাথে তাদের সংগ্রাম এবং সহাবস্থান - অবিশ্বাস্য স্থিতিস্থাপকতা, কঠোর পরিশ্রম এবং অভিযোজন-প্রমাণের মাধ্যমে - তাদের জীবনকে দিয়েছে - যদিও চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ।

চলনবিল মানব চেতনার স্থিতিস্থাপকতার একটি প্রমাণ। এটি এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ কেবল বেঁচে থাকেনি বরং একটি দাবিদার কিন্তু উদার প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে উন্নতি করতে শিখেছে। তাদের জীবন হল ধ্রুবক অভিযোজনের একটি চক্র - নির্মাণ, ভাঙা এবং পুনর্নির্মাণ। যদিও রাস্তা নির্মাণ (যেমন, বোরাল সেতু) এবং আধুনিক কৃষি প্রকল্পের মতো উন্নয়নমূলক উদ্যোগগুলি পরিবর্তন আনছে, চলনবিলের জীবনের সারাংশ জলের ভাটা এবং প্রবাহের সাথে আবদ্ধ। এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অনন্য এবং অমূল্য অংশ, এমন একটি স্থান যা স্থিতিস্থাপকতা এবং সহাবস্থানের অমূল্য পাঠ শেখায়। সংগ্রাহী জীবনধারা দেশের রেস্ট অংশের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url