Breaking News

ভালোবাসার গন্তব্য কোথায়?

: ভালোবাসার ভাষা বদলে গেছে। আগের দিনের ভালোবাসা আর এখনকার ভালোবাসা, মিলবে?
: প্রেম কি নয়টা-পাঁচটার চাকরি, নিয়মমাফিক অফিস যাওয়ার মতো! চাকরিতে কর্মক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা থাকে, কিছু নিয়মকানুন, বিশ্বাস ও পরিচর্যার ব্যাপার-স্যাপার থাকে। প্রেমেও তো তাই।
: ধরা যাক, একজোড়া ছেলেমেয়ের ভেতরে সম্পর্ক গড়ে উঠল। এরপর? ছুমন্তর ছু…ল্যাঠা চুকে গেল? ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল?’ ভালোবাসার গন্তব্য কোথায়?
লাল রঙে দিনপঞ্জিতে জ্বলজ্বল করছে ‘ভালোবাসা দিবস’। এমন দিনে কেউ যদি ওপরের কথাগুলোয় চোখ বুলিয়ে আমার পিণ্ডি চটকানোর উদ্যোগ নেন, বাধা দেওয়ার জো থাকবে না। উপরন্তু তাঁরা বলতেই পারেন, এটা নাটক-সিনেমা বা রূপকথার গল্প নয়, প্রেম যদি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোর মতো অত সহজ হতো, তাহলে কথা ছিল না। প্রথম প্রথম বলাই তো যায়, ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’। শুধু বলা নয়, ভাবাও যায় না, সে ছাড়া এ জীবন!
তবে দিনের পর দিন গড়িয়ে সম্পর্ক একটা ভিত্তি পেলে তবেই না প্রণয় থেকে পরিণয়যাত্রা। নতুন লক্ষ্যে ভালোবাসার নতুন স্বপ্নযাত্রা। আর এসব ভালো লাগার অনুভূতি থেকে পরস্পর পরস্পরের কত কিছু মনে নেওয়া, মেনে নেওয়া!
কেউ কেউ আবার মানেনও না। তাঁরা মনে নিলেও মেনে নিতে নারাজ। অতঃপর একসময় ‘আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে।…’ ফলে টুটে যায় প্রেম, বেঁকে যায় নদীর মোহনা। হয়তো এই দৃশ্য দেখেই কবিতা লিখেছিলেন শহীদ কাদরী, ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না।’
হ্যাঁ, প্রেমে কোনো কোনো সময় অশান্তি হয় বটে, কিন্তু ভালোবাসা-মুগ্ধতার অনির্বচনীয় শান্তি শেষমেশ সবকিছু কি ভাসিয়ে নেয় না?
প্রেমে উত্তাল প্রেমিক যুগল তো ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না’ বলে গায়ে হাওয়া লাগিয়েই বেড়ান, বেড়াতে চান, চিরকাল! তবে গন্তব্যের প্রশ্ন এলে খোলা দখিন দুয়ারে এসে দাঁড়ায় বাস্তবতা।
সাধারণভাবে প্রেমের লক্ষ্য হলো পরিণয়। কিন্তু কেউ তো চাইতে না-ই পারেন ববাহবন্ধন! পরিণয় না পরিণয়হীনতা-এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও প্রেমর দাঁড় বাইতে সবাই ওস্তাদ।
এই যে বসন্তের দিল-ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাসে আজকে চারপাশে এত এত হলুদ-সবুজ বর্ণিল প্রেম, তরুণ-তরুণীদের উচ্ছল কলরব, এর পেছনে অবশ্যই আছে প্রেমের দাঁড় টেনে যাওয়া। প্রেমের দায় বয়ে যাওয়াও কি নয়? সেই দায়কে সবাই মন বাড়িয়েই ছুঁয়েছেন চিরদিন। প্রবল আবেগে কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় হয়তো বলেছেন:
‘হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এককে করি দুই।’
হ্যাঁ, এককে দুই করে তারপর প্রেমিকার চোখে চোখ রেখে আমরা বলতেই পারি জীবনানন্দ দাশ থেকে ধার করে-এবং বলিও, ‘নদীর এ জল/তোমার চোখের মতো ম্লান বেতফল’।
আহা, পাশাপাশি বসে থাকার এ এক মধুর সময়! তখন প্রেমময় সেই মুহূর্তে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত কি শীত-সব সময় আমাদের বুকের ভেতর খেলা করে বসন্ত-অনাবিল বসন্ত।
সেই বসন্তে আমরা ভাসি, কাঁদি, হাসি। কারণ, প্রেম আজও প্রথম সকালের মতো করেই আসে। আর প্রমিককুলের গলায় শোনা যায়, ‘সকালের কৈশরে তোমাকে চাই, সন্ধের অবকাশে তোমাকে চাই…শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।’ সব প্রেম পরিণতি হয়তো পায় না, হয়তো চায়ও না। তা বলে প্রেমের সময়ে বুকের গভীরে যে ধুকপুকানি, তা একবিন্দু মিথ্যাও নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার লাবণ্য, অমিত আর কেতকীর কথা ভাবুন। মনে করুন অমিতের নিজের বর্ণনায় এই দুই নারীর সঙ্গে তার প্রেম, ‘কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল-প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা, সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’
এভাবে কত-কী রকমফের, বিচিত্র রঙেই না ধরা দেয় প্রেম! হায়, প্রেমের একক সংজ্ঞা কে কবে পেরেছে দিতে!
একদা আমাদের প্রেম ছিল গোপন চিঠির ভাঁজে লজ্জারাঙা: ‘এখন তুমি কোথায় আছ কেমন আছ, পত্র দিয়ো/এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালির তালপাখাটা/খুব নিশিথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।’ পাঠকপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় লেখা এসব দিন আজ পুরোপুরি অতীত নয়, তবে ভাব প্রকাশের ধরনে বদল ঘটেছে।
ফেসবুকের দিনগুলোতে চিঠির পরিবর্তে এসেছে ইনবক্স। এখন প্রেমিকপ্রবরদের মধ্যে চিঠির লেনাদেনা হয় ইনবক্সে। প্রেমে পড়লে সবাই কবি। তাই ইনবক্স ভরে ওঠে কথার কবিতায়। ‘হাই…হ্যালো…জান’-এসব বলতে বলতে, হাহা হিহি কিংবা ঝগড়া করতে করতে, ক্রমাগত লাভ সাইন পাঠাতে পাঠাতে কোনো প্রেমিক তাঁর প্রেমিকা বা ‘জিএফ’কে কী বলেন এখন?
যে ভাষায় যত কিছুই বলেন না কেন, মর্মে থাকে প্রেমের চিরন্তন সেই ভাব, সুখী সুখী সেই বার্তা:
‘বসন্ত বাতাসে সই গো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলবাগানে
নানান রঙের ফুল
ফুলের গন্ধে মন আনন্দে
ভ্রমর হয় আকুল…’
(গান: শাহ আবদুল করিম)

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com