গল্পঃ ব্যাস্ত আমি লিজা

ফুটপাথের উপর ধীর পা ফেলে এই ভরসন্ধ্যাবেলায় এখন আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।
এখন না আকাশে মেঘ আছে, না আছে ঝড়ো হাওয়া । 
তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আজ রাতে বৃষ্টি নামবে ,
শরৎকাল তো সারপ্রাইজ দিতে ভীষণ পছন্দ করে বলেই জানি । 
হঠাত লক্ষ্য করলাম , একা একা হাসছি বলে কয়েকজন পথচারি ঘুরে আমার দিকে তাকাচ্ছে , 
সম্ভবত পাগল ঠাওরেছে আমাকে । সে যাকগে ,যার যা ভাবার তাই ভাবুক । 
কে কি ভাবল তা নিয়ে আবির কিন্তু মাথা ঘামায় খুব কম সময়েই , হুম ।
ক্লিনিকটা ছোটখাট , ব্যক্তিমালিকানাধীন। 
এইখানের ছোট্ট এলাকার মানুষদের ভরসার স্থান । 
আর আমার মত রোগাপটকা হলে তো কথাই নেই , 
এই দুইমাসে আমি তৃতীয়বারের মত আমি এই হাসপাতালে হানা দিলাম । 
এবারের এক্সকিউজ – কি বলা যায় ? আমি দুদিন হল আমার নাকের অস্তিত্ত টের পাচ্ছিনা , 
বাজে টাইপের বিচ্ছিরি লেভেলের সর্দিতে আমার নাক সম্ভবত বিলীন হয়ে গেছে । 
এই সমস্যাটি কিন্তু নতুন নয় , দুইমাস পরপরই আমার এই অবস্থা হয়।

এক ঘন্টা অপেক্ষার পর আমার সিরিয়াল যখন আসল , 
আমি তখন ঠিক ” পাইছিরে ” টাইপের ইমোতে ছিলাম । 
কিন্তু আমি দরজা খুলে ঢুকবার পরই আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারের ১০০ ওয়াট বাল্বের মত চেহারা
 ২৫ ওয়াট বাল্বের মত হয়ে গেল । আমি এখানে এত বেশি হানা দেই যে ডাক্তার থেকে শুরু করে কম্পাউন্ডার পর্যন্ত সবাই আমার চেনা হয়ে গেছে। 
কিন্ত এই ডাক্তার কে এইবার এইখানে প্রথম দেখলেও সে আমার অচেনা নয়। 
এই ডাক্তার আমার জীবনের সবথেকে আপন একটা মানুষ । 
ফিচলা হাসি হেসে ডাক্তার সাহেব বললেন ,” কি খবর তোমার ?
ভালোই একটা রোগ বাঁধিয়েছ দেখছি ?

আমি কি বলব বুঝলাম না , সত্যি বলতে কি , এই ডাক্তার একসময় আমার জীবন সঙ্গিনী ছিলো।
আমার বউ।বিয়ে করা বউ। আমাকে দেখে অবাক হবার কথা।
অবাক হয়েছেও কিন্ত মুখে সেইটা প্রকাশ করছে না। 
আশা করি প্রকাশ করবেও না।
লিজা এখনো ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। 
ওর চিন্তা আমি স্পষ্ট ধরতে পারছি। 
আমি একসময় বইয়ের মতো পড়তে পারতাম এই মেয়েটাকে।
লিজা নিশ্চয়ই ভাবছে, 
চার বছর আগে যে ছেলেটার সাথে দীর্ঘদিনের ভালবাসার সম্পর্ক কোন কারণ ছাড়াই 
এক লহমায় চুকিয়ে দিয়েছি কাউকে না জানিয়েই তাকে একা করে চলে এসেছিলাম 
সেই ছেলে এত দ্রুত শক কাটিয়ে এত ভাল থাকছে কি করে?

লিজার মতো বেখেয়ালি ডাক্তার আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি ।
আরে আমার অসুখ হলে তোমার কী ?তোমার তো অসুখি হবার কারন নেই ,
তোমার আরো টু পাইস ইনকাম হবে । তাও এত প্যাচালের কি মানে আছে ?
আমার পুরো ছোটবেলা অবশ্য কেটেছে এই বেয়াদব ডাক্তারের বাবার চিকিৎসা নিয়ে , 
তিনি এখনও চিকিৎসা পেশাতেই আছেন , তবে হয়ত অন্য হাসপাতালে বসেন । 
নিজের এই ক্লিনিকটাতে বসার আর এখন সময় পান না , 
কেন যেন বুড়ো বয়সেই ডাক্তার গুলি বিখ্যাত হয়ে যায় । 
এমন ভাল মানুষ ডাক্তারের মেয়ে কিভাবে এমন ফিচলা বেয়াদব হল সেটা একটা ভাববার বিষয় । 
তবে আপাতত সেটা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমি চেয়ারে দুপ করে বসে পড়লাম । 
মুখ গোমড়া করে সরু নেইমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম , 
যেখানে লেখা – ডাঃ লিজা আহসান ( হ্যান ত্যান ডিগ্রি ) ।

এবার বল দেখি কি হয়েছে ?” আমি খ্যাসখ্যাসে গলায় বললাম ,” সর্দি জ্বর , গলাব্যাথা , 
দম নিতে পারিনা ।” আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে বলল , ” 
তোমাকে ওষুধ হিসেবে আইসক্রিম দিয়ে দেই ?” মেজাজ বয়েলিং পয়েন্টে উঠে গেল , 
কিন্তু গলা ব্যথার কারনে কিছু বললাম না ।
আবির ,তোমাকে মাঝেমাঝেই আইসক্রিম হাতে রিকশায় দেখা যায় , তাই বললাম । 
এখন বরং তুমি একটু সোফায় গিয়ে বস ,আর চারটা রুগী আছে , দেখে নেই । 
তুমি পার্সোনাল রুগি তো , তোমার সাথে একটু আলাপ করব , ঠিক আছে ?
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম , 
আমি যে আবার এই এলাকাতেই চলে এসেছি লিজা সেইটা খেয়াল করেছে।
অথচ লিজা এখন এই হাসপাতালে বসে সেইটা আমি জানি না।
এখন দেখছি আমি নিজেই একটা বেখেয়ালি।

এতক্ষন ধরে বসে আছি , আরো বসে থাকতে বলে ? কত বড় সাহস , 
আরে আমার সময় কি আলুখেতে ধরে নাকি ? 
তারপরেও আমি হতাশার সাথে আবিষ্কার করলাম , 
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমি ঠিক সোফাতে গিয়েই বসেছি ।
কফি আনাই ?” আমি কিছুই বললাম না ।
বেয়াদব মেয়েদের সব কথার উত্তর দিতে নেই , 
তবে মিনিট পাঁচেক পরে আমাকে ঠিক গরম কফি হাতেই বসে থাকতে দেখা গেল ।
পাঠক কি ভাবছেন ? গরবল কিনা ? জি, ঠিকই ভাবছেন , এভরিথিং ইজ গরবল ।
কারন কফি না খেলে কিংবা হাসপাতাল থেকে সোজা বের হয়ে আসতে চাইলেও
লিজা কখনোই আমাকে বের হতে দেবে না। গল্প করা লিজার স্বভাব। 
কিন্ত সবার সাথে না। শুধু আমার সাথে।

প্রজেক্ট নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে লিজার পাশে বসারো সময় পেতাম না।
অথচ লিজা আমার বিয়ে করা বউ। 
সারাদিন হাসপাতালে থেকে রাতে শুধু একটা ঘন্টা চেয়েছে আমার সাথে গল্প করার জন্য। 
অথচ আমি সেই সময়টুকুই লিজাকে দিতে পারি নি।
আজ এখন আমার হাতে যদিও প্রচুর সময় নেই 
কিন্ত লিজার মুখের কথাগুলো শুনতে খুব ইচ্ছে করে। 
খুব ইচ্ছে করে মিলার সাথে বসে গল্প করতে।
কিন্ত সে অধিকার নিজের হাতে মেরে ফেলেছি আমি।
বাহ বাহ তুমি তো কফিমগ নিয়ে ভাল মডেলিং কর , 
কিন্তু আমি তো মডেলিং করার জন্যে এটা দিই নাই , 
তোমার গলার জন্যে দিয়েছি ” লিজার কথায় বাস্তবে ফিরে আসলাম , বললাম ,
আমাকে আর কতক্ষণ বসতে হবে ? ” ” এখানে এসে বস 
সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল । আমি সোফা ছেড়ে চেয়ারে আসতেই বলল

লিজাঃ কি গরম দেখেছ ? একটা বৃষ্টি হওয়া উচিত কি বল ? কতদিন হয়না ।
আমিঃ কে বললো বৃস্টি হয়না। 
গতকালই ত আমি টাকা এক ঘন্টা বৃস্টিতে ভিজলাম।( বলেই জিভ কামড়ে ধরলাম।
ইস আবার লিজার পুরনো টিক্সে পা দিয়ে ফেলেছি।
লিজাঃ এখন এইসব হেয়ালীপনা ছাড়ো। নিজের খেয়াল রাখতে শেখ।
প্রেস্ক্রিপশন লিখে দিলো। 
হয়ত আমার সাথে কিছু কথাও বলতে চাইছিলো কিন্ত আমার যে সেই সময়ের অভাব।
গল্প শোনার সময় যে আমার এখনো হয়না।
বের হওয়ার পরে খেয়াল করলাম মিলা আমার পেছন পেছন
হাসপাতালের মেইন গেট পর্যন্ত চলে এসেছিলো।
আমি পেছনে ফিরে দেখা মাত্রই আবার ভেতরে চলে গিয়েছে।
আমি কি আর বলব পুরো দোষটাই যে আমার।
কথা দিচ্ছি লিজা এই প্রজেক্ট টা সেশ হলে সেই ভার্সিটি লাইফের মতো তোমার কাছে যাব।
তোমার গল্প শুনব।

<>সমাপ্ত<>

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url