গল্পঃ তালাক
এক তালাক! দুই তালাক! তিন তালাক! বাইন তালাক! প্রচন্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে দিলো রইস উদ্দিন! বউ রমিজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্বামীর দিকে। রইস উদ্দিন কথাগুলো বলে,বারান্দায় কপালে হাত দিয়ে বসে রইলো। রমিজা কাপড় চোপড় গুছানো শুরু করে বাপের বাড়ি চলে যাবে বলে,
রইস উদ্দিন সবই তাকিয়ে দেখতে লাগলো। তার আটকার ইচ্ছেও নেই ” তার জীবনটা অসহ্য যন্ত্রণায় ভরে তুলেছে এই রমিজা। দশটা কথা বললে একটাও শুনেনা! দিনরাত নাই! নাই খাই! খাই করতেই থাকে।ডানে বললে বামে যায়,বামে বললে ডানে যায়! এমন বউ আর তার চাই না! রমিজার বাপের বাড়ি পাশের গ্রামে। পাত্রী দেখে রইস উদ্দিনের বেশ পছন্দ হয়েছিল কিন্তু কে জানতো এই রমিজা তার হৃদয়টা কে কেটে টুকরো টুকরো করবে? রমিজা চোখে পানি নেই! সে তালাকের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। যাবার একবার স্বামীর দিকে তাকাবার প্রয়োজনও অনুভব করলোনা।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় কিতাব আলী শুনে রইস উদ্দিনের কথা। কিতাব আলী রমিজা চলে গেলে রইস উদ্দিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কাজটা কি ঠিক করলা? রইস ভাই!
রইসের মাথা ঠিক মতো কাজ করছিলো না, তাই জিজ্ঞেস করে কোন কথা কোন কাজ? এই যে একটু আগে ভাবি সাব,রে যে তালাক দিলা! রইস উদ্দিন চুপ করে থাকে। কিতাব আলী বলে, না ভাই কাজটা তোমার মুটেই করা ঠিক হয়নি।
রইস উদ্দিন রাগে বলে, যা করেছি ঠিক করেছি! তুই জানিস না আমার জীবনটা কেমন করে সে তছনছ করেছে?
বিয়ের কয়েক মাস পরে দেড়,বছর বাপের বাড়ি থেকেছে ঝগড়া করে। তারপর থাকে ছয় মাস! তুই ক কিতাব আলী আমি কি খারাপ মানুষ! কেন তবে আমার সাথে তার বনিবনা হয়না? কিতাব আলী জিজ্ঞেস করে, আজ সে কি করেছে? বলছে বাপের বাড়ি গিয়ে দুই মাস থাকবে! আমি বললাম তিন দিন বা একসপ্তাহ গিয়ে থেকে আসুক। কিন্তু তার এককথা তার যতদিন ইচ্ছে থাকবে! আমি বললাম আমার সংসারে মানুষের দরকার। তাই বিয়ে করা। ঘরে বৃদ্ধা মা! তাকে সেবা করার জন্যও তো একজন মানুষ দরকার। বল তুই কিতাব আলী আমি কি এমন অন্যায় আবদার করেছিলাম? ঠিক আছে কিন্তু তাই বলে তোমার এমন কথা মুখে আনা উচিৎ হয়নি। কি করবো কিতাব আমি বললাম আর বাড়লে তালাক দেব! সে বলে সাহস থাকে তো দিয়ে দেখা? তখন মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না! কিতাব আলী জিজ্ঞেস করে, এখন কি করবে? কি আর করবো ভাগ্যে যা আছে তাই হবে!
কথটা গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। কয়েক মাস কেটে গেল। এখন রইস উদ্দিনের মনে জাগে এমন কাজটা তার করা ঠিক হয়নি। রমিজাও মনে মনে ভাবে তার স্বামী তো খারাপ মানুষ ছিলোনা! তার জেদটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল!
এখন দিন যায় দুজনের অন্তরেই অনুশোচনার আগুন জ্বলতে লাগলো। কিন্তু এখন কি করবে তারা বুঝতে পারছেনা? রইস উদ্দিন মাঝে মাঝে তার শ্বশুর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে! রমিজার সাথে তার চোখে চোখ পড়ে দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথাটা একজনের কান থেকে আরেক জনের কানে যায়।
গাঁয়ের মাতবরের কানে যায়। তিনি গাঁয়ের মুরুব্বিদের কানে যায়। তখন সবাই মিলে চিন্তা করে এর একটা বিহিত করা দরকার!
তখন দু পক্ষকেই ব্যাপারটা জানানো হয়। দু’পক্ষের লোক জন আবার মিলিত হতে চায়। রইস উদ্দিনের বাড়ির উঠানে লোকজন বসে। রমিজাও হাজির হয়।
মাতবর রইস উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করে তুমি রমিজাকে তালাক দিয়ে আবার তার বাড়ির সামনে ঘুরাঘুরি করো ব্যাপারটা কি? রইস উদ্দিন মাথা নিচু করে বলে, আমি রাগের মাথায় ওরে তালাক দিছি! আমি তখন হুঁশে ছিলাম না! মাতবর বলে, রাগের মাথায় দাও আর ঠান্ডা মাথায় দাও ইসলামি আইন মোতাবেক তালাক! তালাকই। তা অন্যকিছু হয়ে যাবে না।
এখন যদি তুমি তাকে ঘরে নিতে চাও তবে কিছু নিয়ম কানুন আছে। তা পালন করে তোমাকে তাকে গ্রহণ করতে হবে অন্যথায় তা হালাল হবেনা।
এবার মাতবর রমিজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি রইস উদ্দিনের ঘরে আবার যেতে চাও। রমিজা মাথা নেড়ে সায় জানায়।
মাতবর এবার গাঁয়ের মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, সবই তো আপনি শুমলেন, এখন কি করতে হবে?
মাওলানা সাহেব বয়ান করলেন, তালাক একটা নিকৃষ্ট হালাল কাজ। স্ত্রী যদি স্বামীর অবাধ্য হয় কোন ভাবেই তাঁকে পুষ মানানো যাচ্ছে না তখন তালাক দেবার অনুমতি রয়েছে।
সেই তালাক হবে পর্যায়ক্রমে। প্রথমে বিছানা আলাদা করে দিতে হবে! তাতেও যদি স্ত্রী বশে না আসে তবে, মাসে বা চল্লিশ দিনে একটা করে তালাক দিয়ে তিন তালাক পূর্ণ করতে হবে। এর মধ্যে যদি তাদের মন ঘুরে যায় তবে তারা সংসার করতে পারবে।
কিন্তু তিন তালাক পূর্ণ হয়ে গেলে আর লাভ নেই! রইস উদ্দিন বলে কিন্তু আমি তো রাগের মাথায় তালাক দিয়েছি? মাওলানা সাহেব বলেন, তুমি রাগের মাথায় যে তালাক দিয়েছো তা হলো তালাকে বেদাত। জঘন্যতম তালাক! কিন্তু স্ত্রী তোমার জন্য হারাম হয়ে গেছে।
মাতবর সাহেব বলেন , মাওলানা সাহেব ওরা তো মিলিত হতে চাইছে এ ক্ষেত্রে কি করনীয়? এ ক্ষেত্রে রমিজাকে কারও সাথে নিকা করতে হবে। স্বামী স্ত্রীর মত সংসার করে তারপর ঐ স্বামী তাকে তালাক দিলে পরে পুনরায় রইস উদ্দিন রমিজাকে বিয়ে করতে পারবে।
অন্যথায় তা হালাল হবেনা। এখন কেউ যদি না মানে তবে তার পাপ হবে! মানুষ বিয়ে না করেও আজকাল স্বামী স্ত্রীর মতো থাকছে কিন্তু তাই বলে, তাদেরকে হালাল বলা যাবে?
মাতবর বলেন, শুনতে পেয়েছো রইস উদ্দিন? হুম! তুমি কি এভাবে রাজি আছো? রইস উদ্দিন বলে, আমি একটু ভেবে জবাব দেই? সবাই তা তো অবশ্যই। রমিজাও একই কথা বললো,
রইস উদ্দিন, ভেবে ঠিক করে কিতাব আলীই তাঁকে সাহায্য করতে পারে তাই তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে রইস উদ্দিন বলে, ভাই কিতাব তুই আমার এই উপকারটুকু করে দে? কিতাব আলী বলে, এতে আমার লাভ কি? তোকে আমি দশ হাজার টাকা দেব। না বিশ হাজার দেবে তাহলে আমি রাজি আছি। কথা হলো কিতাব আলী বিয়ে করে আলাদা বিছানায় থাকবে। রইস উদ্দিন জানে কিতাব আলী নেশাখোর! নেশাটাই তার জীবন! তাই ওর বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে! বউয়ের জন্য ওর এতো মাথা ব্যাথাও নেই। মজলিসের মধ্যে এসে রইস উদ্দিন বললো আমি রাজি, রমিজাও রাজি হয়। তাদের বিয়ে হয়ে যায়। রইসের রাতে ঘুম আসেনা কিতাব আলী তার সাথে আবার বেঈমানী না করে বসে। পরদিন সকালে উঠেই রইস কিতাব আলীর বাড়িতে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে রমিজা সবেমাত্র গোসল করে কাপড় শুকাতে দিচ্ছে। তা দেখে রইস উদ্দিনের মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়। কিন্তু নিজেকে কোন ভাবে সামলিয়ে কিতাব আলীর কাছে গিয়ে বলে, এটা কি করলি? কিতাব আলী বলে, হুজুর যা বলেছে তাই করেছি। রমিজা এখন আমার বউ! তা অন্যায়টা কি করছি? তুই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলি?
আহা! রইস ভাই। এখানে আমি কোন অন্যায় তো করিনি! শুধু শুধু রাগ করছো কেন? রইস উদ্দিন রাগে বলে, দে এখন তালাক দে রমিজাকে?
আহ্ রইস ভাই! এতো তারাহুরোর কি আছে আরও কয়েকদিন যাক পরে ভেবে দেখবো। রইস রমিজার কাছে যায়। রমিজা বলে, আমি কি করবো কিতাব আলী বললো হালাল স্বামী স্ত্রীর মতো থাকতে হবে! তাই তুমি করলে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রইস!
এভাবে দিন যায় মাস অতিবাহিত হয় কিতাব আলী রমিজাকে নিয়ে সংসার করে। আর রইস উদ্দিন ঘুরেফিরে হতাশার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে!
রইস উদ্দিন একসময় হৃদয়ে পাথর চাপা দেয়। ভাবে রাগের মাথায় যা অন্যায় সে করেছে তার ফল সে হাতেনাতে পেল! একদিন সে বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে আসে। আবার নতুন করে সংসার শুরু করে।
কিতাব আলী রমিজাকে নিয়ে কয়েক মাস মেতে থাকে পরে আবার নেশায় ডুবে যায়! রমিজার দুঃখের সীমা থাকে না। তার রাগ জিদ সব নিঃশেষ হয়ে যায়। ভাবে সেদিন যদি জিদ,না করতো তবে, রইস উদ্দিনের সাথে তার সুখের সংসার থাকতো এখন।
এই তালাকে দুজনেই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো! কিন্তু জীবন চলতে লাগলো।
…………………………….সমাপ্ত……………………………………….