Breaking News

প্রেয়সী | পার্ট: ৪ | লেখিকা: সুলতানা তমা

বেশ কিছুক্ষণ হলো রোদ আর জানালার পর্দার লুকোচুরি খেলা চলছে, চোখেমুখে রোদের উষ্ণ ছোঁয়া লাগছে তবুও ঘুমের  ভাব কাটছে না আমার। চোখ বুজে জানালার পর্দা আর সকালের মিষ্টি রোদের লুকোচুরি খেলা উপভোগ করছি, হয়তো হিমেল বাতাস বইছে তাই জানালার পর্দাটা বারবার এভাবে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ পর্দা পুরোপুরি সরে গেলো আর সাথেসাথে রোদের উষ্ণ ছোঁয়ায় পুরো রুমটা আলোকিত হয়ে গেলো। এবার ভালোভাবেই ঘুমের ভাবটা কেটে গেল আমার চোখ থেকে, আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসে আবছা দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম, চোখ কচলে নিয়ে ভালোভাবে তাকালাম উঁহু স্বপ্ন নয় সত্যিই তো একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানালার পর্দা ধরে। কিন্তু এই মেয়ে কে? তাহলে কি এতক্ষণ বাতাস নয় এই মেয়েই পর্দা আর রোদের লুকোচুরি খেলা খেলছিল? কিন্তু কেন? আমার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য? এক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এসব আবোলতাবোল প্রশ্ন ভাবছিলাম তখনি মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে আমার দিকে তাকালো, আরে এতো অর্পিতা, এতক্ষণ পিছন দিক দেখছিলাম বলে ছিনতে পারিনি। কিন্তু অর্পিতা আমার রুমে কি করছে? আম্মু দেখলে তো… আবারো অর্পিতা খিলখিল করে হেসে উঠলো, আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওর ঠোঁটের দিকে, এই মেয়ে এতো সুন্দর করে হাসে কিভাবে? একটা মানুষের হাসিতে সত্যিই কি এতোটা পবিত্রতা মিশে থাকতে পারে? গোলাপি রঙের সালোয়ারকামিজ পরনে, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক আর চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়ানো, সত্যি খুব মায়াবী লাগছে অর্পিতাকে। এই প্রথম ওকে আমি এভাবে দেখছি এতটা…
অর্পিতা: এত বেলা হয়ে গেছে কিন্তু আপনি উঠছেনই না তাই জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিলাম, রোদের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই কেমন উঠে বসে গেলেন দেখেছেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
অর্পিতা: কি হলো এভাবে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন?
আমি: দেখছি..
অর্পিতা: কি দেখছেন সেটাই তো জানতে চাইছি। (অর্পিতা এসে আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে টেবিলে রেখে দিলো, আমি কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম এতক্ষণ)
অর্পিতা: কি বলুন।
আমি: কিছুনা।
অর্পিতা: বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি?
আমি: হ্যাঁ, ঐ আরকি ফজরের নামাজ পড়ে বই পড়া আমার অভ্যাস।
অর্পিতা: আর বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েন বলতে পারেন না তাই তো? (অর্পিতা হাসতে হাসতে এসে আমার পাশে বসলো, বুঝতে পারছি না হঠাৎ করে অর্পিতা আমার সাথে এতোটা ফ্রী হয়ে কথা বলছে কেন)
অর্পিতা: ভাবি আর দাদি বললেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে কিন্তু আপনি তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন তাই জানালার পর্দা সরিয়ে আপনাকে জাগাতে হলো।
আমি: কিন্তু আপনি আমার রুমে এসেছেন সেটা দেখলে তো আম্মু…
অর্পিতা: ভয় নেই বাসায় কেউ নেই।
আমি: কেউ নেই মানে? সবাই কোথায়?
অর্পিতা: আপনার আব্বু, চাচ্চু আর ভাইয়া অফিসে, তনিমা কলেজে আর…
আমি: আম্মু আর চাঁচি? আম্মু আর চাঁচি কোথায়?
অর্পিতা: শপিং এ।
আমি: ওহ বাঁচলাম। কিন্তু এত সকালে শপিং এ? (অর্পিতা টেবিলের উপর থেকে আমার ফোনটা এনে আমার সামনে ধরলো)
অর্পিতা: দেখুন কয়টা বাজে।
আমি: এগারোটা উনিশ? অনেক বেলা হয়ে গেছে।
অর্পিতা: হ্যাঁ। আপনি বলেছিলেন আজ আমাকে নিয়ে কোর্টে যাবেন আমাদের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলার জন্য।
আমি: এজন্যই বুঝি আপনার মন আজ এতো খুশি?
অর্পিতা: জানিনা, তবে কেন যেন ভালো লাগছে খুব আজ।
আমি: রেডি হয়ে নিন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, একটু পর বেরুবো আমরা।
অর্পিতা: ঠিক আছে।
অর্পিতা মিষ্টি হেসে চলে গেল। আমি ফ্রেশ হতে যাবো তখনি রাতের কথা মনে পড়লো, রাতে তো আব্বু কিসব যেন বলছিলেন যা শুনে আমি দুটানায় পড়ে গিয়েছিলাম অর্পিতাকে ডিভোর্সটা দিবো কিনা ভেবে। কি করবো এখন? আচ্ছা দুর্জয় যদি সত্যি খারাপ ছেলে হয় তাহলে কি অর্পিতাকে ডিভোর্স দেয়াটা ঠিক হবে আমার? কিন্তু ডিভোর্স এর কথা শুনে তো অর্পিতা খুব খুশি, যে মেয়ে সারাক্ষণ কাঁদে তার মুখে হাসি ফুঁটেছে ডিভোর্স এর কথা শুনে, ওর এই হাসিটা কেড়ে নিবো আমি? যা হবে পরে দেখা যাবে আগে ডিভোর্স নিয়ে কথা বলে আসি তাতে অন্তত মেয়েটা সবসময় হাসিখুশি থাকবে।
ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে এসে ঢুকলাম তখনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো, ফোন হাতে নিয়ে দেখি আব্বু কল দিয়েছেন। আশ্চর্য এই সময় আব্বুর ফোন?
আমি: হ্যাঁ বলো।
আব্বু: কি করছ?
আমি: ফ্রেশ হয়ে আসছি বেরুবো একটু।
আব্বু: কোথায়?
আমি: সেটাও বলে যেতে হবে?
আব্বু: অর্পিতাকে দেখলাম আজ খুব খুশি, ডিভোর্স দিবে বলেছ?
আমি: জোড় করে তো বিয়েটা দিয়েছ কিন্তু জোড় করে কি ঠিকিয়ে রাখা সম্ভব? ডিভোর্স দিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
আব্বু: আজ যদি তুমি অর্পিতাকে ডিভোর্স দাও তাহলে একদিন তোমাকে পস্তাতে হবে, তোমার নিজেকে বড্ড বোকা বলে মনে হবে আর আজকের বোকামির জন্য সেদিন নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে হবে তোমার।
আমি: কি বলতে চাইছ তুমি?
আব্বু: নিজেকে একটু সময় দাও, তাড়াহুড়ো করো না। বিয়ে সম্পর্কটা এত সস্তা নয় যে চাইলেই ডিভোর্স দিয়ে দিবে।
আমি: সস্তা নাহলে এত সস্তা ভাবে বিয়েটা দিয়েছ কেন? কেন এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দিলে?
আব্বু: একদিন তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দিবো, একদিন দিবো আজ নয়।
আমি: হুম।
আব্বু: নিজেকে সময় দাও আয়াস, ডিভোর্স এর সিদ্ধান্ত এখনি নিও না।
আব্বু ফোন কেটে দিলেন, কিযে করবো বড্ড দুটানায় পড়ে গেছি।
ড্রয়িংরুমে দাদি, ভাবি আর অর্পিতা বসে আছে দেখে আমিও এসে ওদের পাশে বসলাম, ভাবি আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর হাসছে দেখে ভ্রু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম…
আমি: কি?
ভাবি: কিছুনা।
আমি: অর্পিতা রেডি হবেন না?
অর্পিতা: হ্যাঁ যাচ্ছি। (অর্পিতা উঠে রুমের দিকে চলে গেল। ভাবি আর দাদি আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি? এভাবে দুজনে কি দেখছ?
দাদি: কোথায় যাবি অর্পিতাকে নিয়ে? (এখন কি বলবো? ডিভোর্স এর কথা বললে যদি ওরা রাগ দেখায়?)
ভাবি: কি হলো বলো কোথায় যাবে।
আমি: না মানে আসলে…
ভাবি: না মানে আসলে কি?
আমি: অর্পিতার খুব মন খারাপ তো তাই ভাবছিলাম ওকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি, তোমরা না করলে যাবো না প্রমিস।
দাদি: আরে না করবো কি এটাই তো আমি চাইছিলাম।
ভাবি: সকাল সকাল অর্পিতাকে কি এমনি এমনি তোমার রুমে পাঠিয়েছিলাম?
আমি: মানে?
দাদি: অর্পিতাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, ও দেখতে সুন্দর। চোখ গুলো দেখেছিস কি সুন্দর? আর ওর হাসিটা… হাসিতে কি যেন একটা আছে, মুখটা মায়ায় ভরা। সর্বোপরি অর্পিতা তোর জন্য পারফেক্ট, দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে।
আমি: কিন্তু দাদি…
দাদি: কি অর্পিতা হিন্দু? ভালোবাসা কি জাত ধর্ম মানে? তুই পারবি না ওকে ভালোবেসে তোর করে নিতে? থাক না ও হিন্দু তাতে কি? নিজের ধর্ম ছেড়ে আমাদের ধর্ম নাহয় গ্রহণ করলো না কিন্তু তুই তো ওকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারিস।
আমি: এ হয় না দাদি।
ভাবি: আচ্ছা এমনো তো হতে পারে তোমার ভালোবাসা ওকে পালটে দিলো আর ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো।
আমি: এসবের কোনো প্রয়োজন নেই, অর্পিতা ওর মামাতো ভাইকে ভালোবাসে।
দাদি: শুধু এটাই কারণ?
আমি: (নিশ্চুপ)
দাদি: অর্পিতা যদি অন্য কাউকে ভালো না বাসতো তাহলে কি তুই ওকে ভালোবাসতি?
আমি: এত জানিনা।
ভাবি: রাগ দেখিয়ে চলে গেলেই বুঝি সত্যিটা লুকাতে পারবে? তুমি মুখে বল সব ভুলে গেছ কিন্তু আসলে তুমি কিছুই ভুলুনি, তুমি দুবছর…
অর্পিতা: চলুন। (অর্পিতা আসছে দেখে ভাবি আর দাদির একদম কাছে গিয়ে ওদের দিকে তাকালাম)
আমি: দুবছর আগের কিছু যেন অর্পিতা না জানতে পারে, আর হ্যাঁ আমি আর কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারবো না।
ভাবি: ভালোবাসা কখনো বলে আসেনা, এইটা মনের ব্যাপার। নিজের অজান্তে কখন কাকে ভালোবেসে ফেলবে বুঝতেও পারবে না। রাগ জিদ জোর অন্য সব কিছুর সাথে দেখানো গেলেও নিজের মনের সাথে দেখানো যায় না।
আমি: তোমাদের আর কতবার বুঝাবো? কিভাবে বললে তোমরা বুঝবে?
অর্পিতা: কি হলো উনাদের রাগ দেখাচ্ছেন কেন?
রাগে ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু ভেঙ্গেচুরে ফেলি কিন্তু অর্পিতা পাশে। দাদি আর ভাবির দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্পিতার হাত ধরে ওকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
আমার রাগ দেখে অর্পিতা ভয়ে চুপসে গেছে একদম। গাড়িতে উঠতে ইশারা করলাম, অর্পিতা গাড়িতে জড়সড় হয়ে বসলো। আমি গাড়িতে বসে অর্পিতার দিকে তাকালাম, অর্পিতা জড়সড় হয়ে বসে আছে।
আমি: কি হয়েছে?
অর্পিতা: কিছুনা।
আমি: এভাবে জড়সড় হয়ে বসে আছেন যে?
অর্পিতা: আপনার এতো রাগ কেন? রাগে চোখ দুটো কেমন রক্তবর্ণ হয়ে গেছে। (কিছু না বলে চোখ দুটো খানিকক্ষণ বন্ধ করে রাখলাম, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলাম)
অর্পিতা: তখন ওদের উপর এভাবে রাগ দেখালেন কেন?
আমি: এমনি।
অর্পিতা: এত রাগ ভালো না, তাছাড়া উনারা খুব ভালো মানুষ।
আমি: হুম।
দুজনের মধ্যে নীরবতা নেমে এসেছে। অর্পিতা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এদিকওদিক দেখছে আর আমি একমনে গাড়ি চালাচ্ছি।
উকিল: বিয়ে হয়েছে কতদিন? (দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে আছি কি বলব এখন? চার দিন হয়েছে মাত্র বিয়ের আর এখনি ডিভোর্স নিয়ে ভাবছি এই কথা শুনলে তো উকিলও বোকা হয়ে যাবে)
উকিল: কি হলো? বিয়ে হয়েছে কতদিন হয়েছে?
আমি: চার দিন।
উকিল: আয়াস তুমি কিন্তু ভুল করছ। (উকিল আমার নাম জানে দেখে বেশ অবাক হলাম)
আমি: আপনি আমাকে চিনেন?
উকিল: সাদিকুর রহমানের একমাত্র ছেলে তুমি, তোমাকে এই শহরে কে না চেনে? কিন্তু তুমি ডিভোর্স…
আমি: আঙ্কেল সমস্যা আছে বলেই তো এসেছি।
উকিল: কিন্তু আয়াস ডিভোর্স দিতে চাইলেই তো দেওয়া যায় না, এর জন্য যথেষ্ট কারণ দেখাতে হয়।
আমি: কারণ তো আছেই, আমরা দুজন চাচ্ছি এই ডিভোর্সটা।
উকিল: মামুনি তুমি মন থেকে চাইছ?
অর্পিতা: (নিশ্চুপ)
আমি: কি হল বলুন।
অর্পিতা: হুম।
উকিল: তাহলে কি আর করার। কিন্তু আয়াস ছয়মাস এর মধ্যে তো ডিভোর্স কোনো ভাবেই সম্ভব না।
আমি: কেন?
উকিল: এটাই আইন। ছয়মাস তো তোমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।
আমি: ঠিক আছে।
অর্পিতা: কিন্তু…
আমি: ছয়মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
অর্পিতা: হুম।
যে মেয়েটার ঠোঁটের কোণে একটু আগেও হাসি লেগে ছিল তার মুখ জুরে এখন বিষণ্ণতার ছাপ, কি যে করবো আমি। অর্পিতা চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে পড়লো।
আমি: ঘুরতে যাবেন?
অর্পিতা: না আমি বাসায় যাবো।
আমি: এর আগে কখনো শহরে এসেছিলেন?
অর্পিতা: (নিশ্চুপ)
আমি: চলুন শহরটা ঘুরে দেখাই মন ভালো হয়ে যাবে। (অর্পিতা মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো, ওর দুচোখে পানি টলমল করছে)
আমি: ঠিক আছে ঠিক আছে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।
এই মেয়ের তো দেখছি চোখে সবসময় পানি এসেই থাকে, একটু কিছু হলেই কান্না শুরু করে দেয়। ঘুরতে যাবে না আবার মনও খারাপ করে রাখবে, আমি আর কি করবো বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
অর্পিতা: ছয় মাসের আগে কি কোনো ভাবেই ডিভোর্স সম্ভব নয়? (আনমনা হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম হঠাৎ অর্পিতার প্রশ্নে ঘোর কাটলো, ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার গাড়ি চালানোতে মন দিলাম)
অর্পিতা: সম্ভব নয় কি?
আমি: আইন তো আইন’ই। আইনের বাইরে গিয়ে তো কিছু করার নেই।
অর্পিতা: কিন্তু…
আমি: আরে ছয় মাসই তো দেখতে দেখতে কেটে যাবে। (আব্বু বারবার ফোন দিচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না)
অর্পিতা: কি হলো ফোন রিসিভ করছেন না কেন?
আমি: হুম করছি। (গাড়ি সাইটে দাঁড় করিয়ে ফোন রিসিভ করলাম)
আমি: কি হয়েছে?
আব্বু: রেগে আছ এখনো?
আমি: আব্বু আমি ড্রাইভ করছিলাম আর তুমি…
আব্বু: এতবার বারণ করার পরও তুমি উকিলের কাছে গিয়েছিলে? (অর্পিতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে আসলাম)
আব্বু: কি হলো?
আমি: হুম গিয়েছিলাম কিন্তু উকিল বলেছে ছয় মাসের আগে সম্ভব না।
আব্বু: ছয়মাস কেন আয়াস কখনোই সম্ভব না এই ডিভোর্স। পাগলামি করিস না বাবা।
আমি: আমি পাগলামি করছি না আব্বু, আমি অর্পিতাকে মুক্তি দিতে চাচ্ছি। দেখো আব্বু এই বিয়েটা আম্মু না মানলেও এটা তো সত্যি যে বিয়ের রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে, আইন অনুযায়ী অর্পিতা আর আমি এখন স্বামী স্ত্রী আ…
আব্বু: আর আমি চাই তোমরা দুজন স্বামী স্ত্রী হিসেবে সারাজীবন থাকো।
আমি: এইটা সম্ভব না। আমি অর্পিতাকে দুর্জয় এর কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই।
আব্বু: এই ভুল করো না। ছয়মাস সময় আছে তো ডিভোর্স এর, আমি বলছি এই ছয় মাসের মধ্যেই তুমি দুর্জয় এর আসল রূপ ধরতে পারবে।
আমি: হয়তো তুমি ঠিক বলছ দুর্জয় যে খারাপ। কিন্তু তারপরও তো অর্পিতাকে ডিভোর্স দিতে হবে।
আব্বু: কেন?
আমি: পারবো না… পারবো না কাউকে ভালোবাসতে, পারবো না কাউকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে।
আব্বু: আয়াস শান্ত হ… (হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন আমার শার্ট খামছে ধরলো, পিছনে ঘুরে দেখি অর্পিতা। ফোন পকেটে রেখে চোখ দুটো খানিকক্ষণ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিলাম। অর্পিতা বাচ্চা মেয়ের মতো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি হয়েছে অর্পিতা? (অর্পিতা হাত দিয়ে সামনের একটা দোকান দেখালো, দোকানে কি দেখাচ্ছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না)
আমি: পানি খাবেন?
অর্পিতা: (নিশ্চুপ)
আমি: কি বলছেন বুঝতে পারছি না।
অর্পিতা: আপনি কখনো কাউকে ভালোবাসেননি? (হঠাৎ অর্পিতার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ওর চোখের দিকে, সব স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে, বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা করছে)
অর্পিতা: কোনো মেয়েকে ভালোবাসলে তো জানার কথা মেয়েদের মন খারাপ থাকলে কি করে ভালো করতে হয়।
আমি: মানে?
অর্পিতা: আইসক্রিম খেলে মেয়েদের মন ভালো হয়ে যায়। (মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে, কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? কেন সবকিছু দুবছর আগের স্মৃতির সাথে মিলে যাচ্ছে?)
অর্পিতা: আপনি ঠিক আছেন তো?
আমি: হ্যাঁ, হুম ঠিক আছি আমি। দাঁড়ান আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।
অর্পিতা: আচ্ছা।
দোকানে এসে এক বোতল পানি নিয়ে তাড়াতাড়ি চোখেমুখে দিলাম, ভিতরটা বড্ড অশান্ত লাগছে, কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? পিছন ফিরে অর্পিতার দিকে তাকালাম, ও গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করে এক বক্স আইসক্রিম কিনে অর্পিতার দিকে এগিয়ে গেলাম।
অর্পিতা: এক বক্স আইসক্রিম? সবগুলো আমার জন্য?
আমি: তো এখানে কি আর কেউ আছে?
অর্পিতা: আইসক্রিম খেলে আমার মন ভালো হয়ে যায় আর অনেক বেশি আইসক্রিম খেলে আমার মন আরো বেশি ভালো হয়ে যায়। (মৃদু হাসলাম অর্পিতার কথা শুনে, ও গাড়িতে হেলান দিয়ে আইসক্রিম খেতে শুরু করলো। মন খারাপ হলে ওকে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগে হাহাহা)
অর্পিতা: হাসছেন কেন?
আমি: এমনি, এখানে দাঁড়িয়ে খাবেন নাকি? গাড়িতে যেতে যেতে…
অর্পিতা: জায়গাটা খুব সুন্দর এখানে দাঁড়াতে ভালো লাগছে।
যাক বাবা মন তো ভালো হলো ওর , আর কিছু না বলে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম।
সিগারেট খাচ্ছি আর আনমনা হয়ে স্মৃতি আওড়াচ্ছি, স্মৃতি গুলো আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছে আমায়। বিশেষ করে অর্পিতা আমার জীবনে আসার পর থেকে স্মৃতি গুলো যেন আমার পিছুই ছাড়ছে না। এভাবে সবকিছু চোখের সামনে ভাসতে থাকলে আমি হয়তো একদিন পাগলই হয়ে যাবো। রাগে সিগারেট ছুড়ে ফেলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলাম, দুর্জয় এখানে? সাথে এই মেয়ে কে? এখন তো দেখছি আব্বুর কথাই সত্যি। দুর্জয় তাহলে অর্পিতাকে ভালোবাসে না? আমিও না, পাগলের মতো কিসব ভাবছি আমিতো চোখের সামনেই সব দেখতে পাচ্ছি। দুর্জয় যদি অর্পিতাকে ভালবাসতো তাহলে কি এই রাস্তার পাশে অন্য মেয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে হাটতো? হঠাৎ অর্পিতার কথা মনে পড়লো, পিছনে তাকালাম, এক মনে আইসক্রিম খাচ্ছে। অর্পিতা যদি দুর্জয়কে অন্য মেয়ের সাথে এভাবে দেখে তাহলে তো খুব কষ্ট পাবে, ওর মুখের এই মিষ্টি হাসিটা নিমিষেই মলিন হয়ে যাবে। খুব আঘাত পাবে ও এখনি এসব জানলে, আস্তে আস্তে নাহয় ওকে বুঝাবো যে দুর্জয় ওকে নয় অন্য কাউকে ভালোবাসে। দৌড়ে অর্পিতার কাছে আসলাম।
আমি: অর্পি গাড়িতে চলো। (ও আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি হলো অর্পি গাড়িতে চলো।
আমার কোনো কথাই তো ও শুনছে না কি করবো এখন? একবার সামনে তাকালেই তো দুর্জয় এর দিকে চোখ পড়বে ওর। কোনো কিছু না ভেবে অর্পিতাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। জানি অর্পিতা এমন কিছুর জন্য মুটেও প্রস্তুত ছিলনা, হাতের আইসক্রিম ফেলে আমার বুকে মুখ গুঁজে পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। আমিতো ওকে জড়িয়ে ধরেছি ও যেন দুর্জয়কে না দেখে এজন্য কিন্তু আমার ভিতরটা এমন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে কেন? কেন অর্পিতা আমার আশেপাশে থাকলেই স্মৃতি গুলো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়? কেন আমি বারবার অর্পিতাকে গুলিয়ে ফেলছি তার সাথে…
চলবে?

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com