Breaking News

আবছা আলো । লেখিকা - তাহমিনা তমা

বিয়ের বেনারসি লাল রক্তে ভিজে গেছে,,, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সদ্য বিয়ে করা স্বামীর লাশের পাশে মাটিতে এলোমেলো হয়ে বসে আছে নিশিতা ,,,, চোখে পানির ছিটেফোঁটা নেই,,, না আছে মুখে কোনো কষ্টের ছাপ,,, এক দৃষ্টিতে শ্রাবনের লাশের দিকে তাকিয়ে আছে,,,, বিয়েটা নিজের ইচ্ছায় করেনি,,,,, তবে অন্যকারো সাথে সম্পর্ক ছিলো তা নয়,,,, শ্রাবনের এভাবে চলে যাওয়াও মানতে পারছে না সে,,,,সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি হয়েছে যে অনুভূতিহীন হয়ে বসে আছে নিশিতা,,,
শ্রাবনের মাঃ এতিম বলে দয়া করে ছেলের বউ বানিয়েছিলাম,,,,??
জন্মের আগে বাপকে খেয়েছিস,,,, জন্মের পর মাকে,,,,,
আর এখন বিয়ের বেনারসি গায়ে থাকতেই স্বামীও খেয়ে নিলি,,,(কান্না করে বিলাপ করতে করতে)
(নিশিতা কারো দিকে তাকিয়েও দেখছে না,,, সবাই অনেক কথা বলছে তাকে,,,,
তার দৃষ্টি শ্রাবনের লাশেই সীমাবদ্ধ,,,,আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটলো,,,,
দাফনের জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হলো,,,
নিশিতা তবু যেখানে লাশ রাখা হয়েছিলো সেদিকেই তাকিয়ে আছে,,,,,
বিয়ে বাড়িতে আসা মানুষগুলো মরা বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে কী অদ্ভুত তাই না,,,,??
একেই হয়তো বলে নিয়তি,,, নিশিতা নামের অর্থ সফল বা বিজয়ী,,,,
কিন্তু নিশাত তার নামের সাথে জীবনের কোনো মিল পায় না,,,
আর না বুঝতে পারে তার এমন নাম রাখার কারণ,,, নিয়তির কাছে সে বারবার হেরে গেছে,,,,
তাকে এই নামে অবশ্য কমই ডাকা হয়,,,, অপয়া নামেই তার বেশী পরিচিতি,,,
নিশিতার বাবা-মা নেই,,, আর না আছে ভাইবোন,,,, ছোট খালার কাছেই বড় হয়েছে,,,
তার দুটো ছেলে,,,, শ্রাবণ নিশিতার বড় খালার ছেলে,,,
ছোটবেলা থেকেই নিশিতাকে পছন্দ করে,,,, তবে নিশিতা তার সাথে দুরত্ব বজায় রেখেই চলতো,,,,
এমনই এতিম আবার কোনো ছেলের সাথে মেলামেশায় কী কথা রটে যাবে সেই ভয়ে,,,,
নিশিতার বড় খালা তাকে একদমই সয্য করতে পারেন না,,,,
নিশিতাকে জন্ম দিতে গিয়ে যে আদরের বোনটা চলে গেছে,,,,,
ছেলের কথা মেনে নিশিতার বড় খালা নিশিতাকে ছেলের বউ করতে রাজি হয়,,,
বিয়ে শেষে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় এক্সিডেন্টে শ্রাবণ মারা গেছে কিন্তু আর কেউ গুরুতর আহত হয়নি,,,, রাতেই শ্রাবনের লাশ হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনা হয়,,,
আর ভোরে দাফন,,,,
নিশিতা এখনো সেখানেই বসে আছে,,,, গাড়িতে বলা শ্রাবণের কথাগুলো কানে বাজছে,,,,)
শ্রাবণঃ আমি জানি নিশু,,, তুই আমাকে ভালোবাসিস না,,,,
কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি,,,
তোকে যখন কেউ অপয়া অলক্ষি নানা কথা বলতো,,, সেগুলো আমার কলিজায় লাগতো,,,,
কিন্তু তোর পক্ষে কিছু বলার অধিকার আমার ছিলো না,,,
কিন্তু কথা দিচ্ছি আজ থেকে তোর দিকে কেউ চোখ তোলে তাকাতেও পারবে না,,,
নিশাতঃ (ভাইয়ার কথা শুনে তার দিকে তাকালাম,,,,
আমার বিয়ে হয়েছে কিন্তু অন্যসব নতুন বউদের মতো আমার চোখে পানি নেই,,,,
কারণ আমি নিজেকে আর ছোট খালাকে মুক্তি দিতে পেরেছি,,,,
ভাইয়ার কথা শুনে কেনো জানি না চোখের কোণে পানি চলে এলো,,,,
তবে কী আমার কাঁদার দিন শেষ হলো,,,,,??)
শ্রাবণঃ(ওর মুখটা দু’হাতের আজলে নিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে পানি মুছে দিলাম,,,
কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিলাম,,,, জানি না তোর এই নিষ্পাপ মুখটা দেখেও কেউ এতো বাজে কথা কীভাবে বলে,,,, ওর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরলাম,,,, )
আমি জানি তুইও একদিন ঠিক আমাকে ভালোবাসবি,,,, আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম,,, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি তোর পাশে থাকবো,,, কথা দিলাম,,,,,
নিশাতঃ( বড্ড শান্তি লাগছে এই বুকে,,, কিন্তু কেন,,,?? হঠাৎ সামনে চোখ গেলে বুঝতে পারলাম একটা ট্রাক অনেক স্প্রিডে আমাদের গাড়ির দিকে ধেঁয়ে আসছে,,,,)
ভাইয়া,,,,,, সামনে,,,,,
শ্রাবণঃ(সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে নিশুকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দিলাম,,,
ড্রাইভারও লাফ দিয়েছে,,, নিশুকে ধাক্কা দিতে গিয়ে নিজে লাফ দেওয়ার সময় পেলাম না,,,)
(একটা বিকট আওয়াজের পর সব নিরবতায় ঘিরে ধরলো,,,,,
ট্রাকটাও একটু দূরে গিয়ে একটা গাছে ধাক্কা লেগেছে,,,,
হয়তো ব্রেকফেল করেছিলো,,,,,)
নিশিতাঃ(মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে,,,
ধীরে ধীরে চোখ খোলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম,,,,
শ্রাবণ ভাইয়ার কথা মনে পরতেই মাথা ধরে ওঠে বসলাম,,,,,) শ্রাবণ,,,,,,
নার্সঃ আপনি উঠছেন কেনো,,,,?? আপনার মাথায় আঘাত লেগেছে,,,,
নিশিতাঃ শ,,,শ্রা,,শ্রাবন কোথায়,,,,??
নার্সঃ উনার অবস্থা ভালো নয়,,, আইসিইউতে আছেন,,,,
নিশিতাঃ (নার্সের কথা শুনে আর বসে না থেকে উঠে বেড়িয়ে এলাম,,,,
পেছনে নার্সও আমাকে ডাকতে ডাকতে চলে এলো,,,
আইসিইউর সামনে আসতেই ডক্টর বেড়িয়ে এলো,,,)
ডক্টরঃ অনেক বাজে ভাবে মাথায় আঘাত লেগেছে,,,আর প্রচন্ড ব্লিডিং হয়েছে,,,
আমাদের কিছু করার নেই,,, রোগীর হাতে বেশি সময় নেই,,,
নিশিতাঃ (এটা শোনার পর,,,, পরে যেতে নিলাম,,,
পিছনে নার্স ছিলো সে ধরে ফেললো,,,)
শ্রাবনের মাঃ হায় আল্লাহ,,,, তুমি আমার ছেলের জীবন ভিক্ষা দাও,,,
প্রয়োজনে আমার জীবন নিয়ে নাও,,, এই অপয়া মেয়ের জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেলো,,,(কান্না করতে করতে মাটিতে বসে পড়ে)
ডক্টরঃ এখানে নিশু কে,,,,?? রোগী তার সাথে কথা বলতে চাইছে,,,,
নিশিতাঃ আ,,,,আমি নিশু,,,,
ডক্টরঃ প্লিজ তাড়াতাড়ি ভেতরে জান,,, নার্স উনাকে নিয়ে যাও,,,,
নার্সঃ চলুন,,,,
নিশিতাঃ (নার্স আমাকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো,,,
শ্রাবণকে দেখে বুকের ভিতর ধক করে উঠলো,,,, পুরো মাথা ব্যান্ডেজ করা,,,
হাত পা সব জায়গায় ব্যান্ডেজ করা,,,, জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে,,,, চোখগুলো বন্ধ,,,,
নিজেকে এখন বড্ড অসহায় লাগছে,,,,,, নার্স আমাকে শ্রাবণের পাশে চেয়ারে বসিয়ে দিলো,,,
তারপর বের হয়ে গেলো,,,,
আস্তে করে শ্রাবণের গালে হাত রাখলাম আর ধীরে ধীরে চোখ খোলে তাকালো,,,)
শ্রাবণঃ ত,,,তুই ঠ,,,ঠিক আছিস,,,,??( নিশুর হাতটা নিজের মুঠোয় নিলার অনেক কষ্টে,,,)
নিশিতাঃ (নিজের এই অবস্থায়ও সে আমার কথা আগে ভাবছে,,,,
চোখের পানি বাঁধ মানছে না আজ,,, মাথা নেড়ে বুঝলাম আমি ঠিক আছি,,,,)
শ্রাবণঃ আ,,,,আ,,আমাকে মাফ করে দিস,,,,, আ,,আমি আমার কথা রাখতে পারলাম না,,,,।
নিশিতাঃ শ্রাবণ,,,,,,,,,,(ডুকরে কেঁদে ওঠলাম)
শ্রাবণঃ ত,,,ত,,তোর মুখে শুধু শ্রাবণ ড,,,ড,,ডাকটা শুনতে কতটা মধুর ল,,ল,,লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না,,,,কিন্তু দেখ আমার কপালটা খারাপ,,, তাই শোনার জন্য বেশি সময় পেলাম না,,,,,
(কথাটা শেষ করেই জোরে একটা শ্বাস নিলাম,,,, নিশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে)
নিশিতাঃ শ্রাবণ,,,,(ব্যস্ত হয়ে)
শ্রাবণঃ মাকে একটু দেখে রাখিস,,, আর ক,,কষ্ট পাস না,,,
দেখিস তোর জীবনে এমন একজন আসবে যে আমার থেকেও তোকে বেশি ভালোবাসবে,,,,
তবে আমাকে ভুলে যাস না প্লিজ,,,,
অন্তত দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে আমার জন্য একটু দোয়া করিস,,,,
নিশিতাঃ তোমাকে কখনো ভুলে যাবো না,,,,(কান্না করতে করতে শ্রাবণের বুকে মাথা রেখে,,,) আমাকে কেন ভালোবাসলে,,,,?? আমাকে ভালো না বাসলে হয়তো তুমি আজ ভালো থাকতে,,,, আমি যে অপয়া,,,,
শ্রাবণঃ হুস,,,,, এ,,এই কথা আর কখনো মুখে আনবি না,,,,
আ,,আর স,,সবসময় হাসিখুশী থাকবি,,, মনে রাখিস তোর মুখে হাঁসি থাকলে আমিও ভালো থ,,,
থাকবো,,, ভ,,,ভালো,,,বাসি যে তোকে,,,,,,শুধু এ,,,এ,,একবার বলনা,,, নিশু,,,, ভ,,ভালো,,,,,,,
নিশিতাঃ(সারারুমে পিনপতন নীরবতা,,,, শ্রাবণের বুক থেকে মাথা তোলে তার দিকে তাকালাম,,,,
চলে গেছে না ফেরার দেশে) এ,,এই শ্রাবণ,,,,,,, আ,,আমি বলছি তো,,, শুনো না,,, ভ,,,,ভালোবাসি,,,,,
নিশু,,,,,,,
নিশিতাঃ (কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে তার দিকে তাকালাম,,,, ছোট খালা,,,)
ছোট খালাঃ চল,,,,এখানে যার জন্য এসেছিলি সেই তোকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে,,,
এখানে থাকার আর কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই,,,
নিশিতাঃ (খেয়াল করে দেখলাম সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে,,,
বাড়িতে মানুষের ভীর অনেক কমে গেছে,,,,
আজ এই বাড়িতে নতুন বউ দেখতে আসার কথা ছিলো মানুষের,,,
দেখতে এসেছে বরের লাশ,,,, আল্লাহ কী চায় সেই ভালো জানে,,,,
বুকের বা পাশটায় বড্ড খালি খালি লাগছে,,,, কবুল শুধু একটা শব্দ নয়,,,
একটা দোয়া,,, কবুল বলার সাথে সাথে দুজন মানুষের জন্য অদৃশ্য মায়া তৈরী করে দেন আল্লাহ তাআলা,,,,
এসবই শুনে এসেছি সবসময়,,,, আজ তার প্রমাণ পেলাম,,,,
যে শ্রাবণকে সবসময় এড়িয়ে চলতাম,,, আজ তার না থাকা আমাকে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে,,,,,
চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্নাগুলো গলায় আটকে আছে বের হতে পারছে না,,,
তবে কী আমিও ভালোবাসতাম তাকে,,,, বুঝতে দেরি করে ফেলেছি,,,??
তুমি আমার জীবনে #আবছা_আলো হয়ে এসেছিলে শ্রাবণ,,,,,
অন্ধকার কাটিয়ে উঠার আগেই হারিয়ে গেলে,,,,,।
নিজে ওঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই,,,, ছোট খালা ধরে উঠালো,,,
বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই শ্রাবণের দাদির গলা শুনে থেমে গেলাম,,,)
দাদীঃ(শ্রাবণের বাবার ফুপি) কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওকে,,,,??
চলবে,,,

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com