Breaking News

গল্পঃ ভালোবাসতে বারণ । পর্ব- ১৮ এবং শেষ

হসপিটালে এপাস ওপাস পায়চারি করছে কেও কেও। কেওবা গালে হাত দিয়ে বসে আছে, চোখে মুখে চিন্তার ভাজ।
ফ্লোড়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে রিদের লাশটা। তার পাশে মন মরা হয়ে বসে আছে আজমল চৌধুরি। মাঝে মাঝে কেদে উঠছে সে।
এতোটা বছর নিজের থেকে দুরে ঠেলে রেখেছিলো রিদকে। তবুও কেনো আজ এতো কষ্ট হচ্ছে তার? যতই অভিমান থাকুক না কেনো, নিজেরি তো ছেলে। ছোটবেলা থেকেই মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত ছিলো সে। মায়ের আদর কেমন তা জানা ছিলোনা তার। আর বড় হয়েও পরিবার তাকে ঠেলে দিলো দুরে। যেই প্রিয় মানুষটার জন্য ছেরেছিলো সবাইকে, সেও চলে গেলো তাকে একা ফেলে। সব হারিয়ে ফেললো লাইফ থেকে। ছিলো শুধু এই জীবনটা। আজ তাও নিজের পরিবার রক্ষার্থে বিলিয়ে দিয়ে লাশ হয়ে পরে আছে হসপিটালের ফ্লোড়ে। আর তার পাসে আজমল চৌধুরি ও তার বন্ধু রাফিনের কাতর মুখ দুটি।
এক ছেলের মৃত্যুতে অনেকটাই ভেঙে পরলো আজমল চৌধুরি। তার হয়তো মনেই পরছেনা যে, তার আরেকটা ছেলে এখনও মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।
অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে শুয়ে আছে আদিত্য। এখনো জ্ঞান ফিরেনি তার।
ওদিকে জ্ঞান ফিরতেই ছটপট করতে থাকে শুভ্রতা। নার্সগুলো এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের কথা শুভ্রতার কান অব্দি পৌছোচ্ছেনা। সে যেনো ছুটে যেতে চায় তার আদিত্যের কাছে। একটি নজর দেখতে চায় সে কেমন আছে। মনে জাগছে হাজারও চিন্তা।
,, ঠিক আছে তো আমার আদিত্য? ওর কিছু হয়নি তো?
শুভ্রতার পাসে বসে আছে আসিফ স্যার, তার মা। কিছুক্ষন পর বৃষ্টি ও সাগরও এলো হসপিটালে।
শুভ্রতাকে সেই অনেক আগেই ঘুমের ইমজিকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। তার পাসেই বসে আছে তারা।
মেহের মাথায় বার বার হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আসিফ স্যার। র্যেনো অতিতের সব ভুলে আগলে নিয়েছে তার নতুন শুভিকে। সব অভিমান যেনো চাপা পরে গেছে তার চখের অস্রুর নিচে।
আজ দু,দিন আদিত্যের জ্ঞান ফিরার কোনো নাম গন্ধও নেই। কখন ফিরবে তারও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা ডাক্তার রা। রাতে কেও চলে গেছে বাসায় আর কেও দাড়িয়ে আছে বাইরে। ভেতে আদিত্যের পাসে কাওকেই থাকতে দিলোনা ডাক্তার। তবুও শুভ্রতার জেদ ও তার জোরাজুরিতে তার ভেতরে থাকার অনুমতি মিললো। যদিও শর্ত দিলো, রোগিকে কোনো প্রকার ডিস্টার্ব করা যাবে না।
পাসে চুপটি মেরে বসে আছে শুভ্রতা। মাঝে মাঝে দু,চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে নোনা জল। আদিত্যের হাতের আঙুলের ফাকে আঙুল দিয়ে হাতটা নিজের গালের কাছে নিয়ে আসে শুভ্রতা। মনে মনে বলছে হাজারও কথা। আচ্ছা ভালোবাসার মানুষের মনের খবর নাকি একে অপরে বুঝতে পারে। তাহলে আমারটা কি বুঝতে পারছে ও? তাওলে সারা সারা দিচ্ছেনা কেনো?
রিদের দাফন কাফন সম্পন্ন করলো গত কাল।
মন মরা হয়ে বসে আছে আজমল চৌধুরি। এক ছেলে কে হারিয়ে আজ সে ব্যথিত। আর অন্য ছেলেও লড়াই করে চলছে মৃত্যুর সাথে। মাঝে মাঝে পার্থনা করে, সৃষ্টিকর্তা জদি আমার বিনিময়েও আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়?
সকালে ডাক্তার সকল কে ডাকলো।
,, আদিত্যের জ্ঞান ফিরেছে। আপনাদের সবাইকে দেখতে চাচ্ছে সে। আর হ্যা, রোগিকে বেশি প্রেসার দেওয়া যাবে না।
মাথায় এখনো ব্যান্ডেজ করা। আধ সোয়া হয়ে বসে আছে আদিত্য। পাসে বসে আছে শুভ্রতা ও তার বাবা। আশে পাশে সবাইকে দেখছে সে। এই চেনা চোখ গুলোর মাঝেও একজনকে খুজে বেড়াচ্ছে সে। সকল কে দেখতে পাচ্ছে। নেই শুধু সেইজন।
বাবার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,,
— বাবা রিদ কোথায় তাকে দেখছি না যে?
আজমল চৌধুরি কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। পারছেনা নিজের ভিতর জেগে উঠা কান্নাকে থামাতে। সে তো এখনো নিজেও সেই ব্যাপারে অবুজ। আরেকজন কে কিভাবে বুজদান করবে সে? সে তো নিজেকেও এখনো সান্তনা দিয়ে উঠতে পারেনি। আরেক জনকে কি করে সান্তনা দিবে সে? ডাক্তার বলেছে কোনো চাপ না দিতে। তাহলে কি মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে?
— কি হলো বাবা, চুপ করে আছো যে? তুমি কি রিদকে এখনো মেনে নিতে পারোনি?
— কে বলছে পারিনি। তিনদিন আগেও যে, ও আমার এই কোলে মাথা রেখেছিলো।
আদিত্য হাস্যজ্জল মুখে বলে উঠে,
— কোথায় সে?
— আছে, বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছে। শরির খারাপ তাই আসতে পারেনি।
কথাটা বলেই বজমল চৌধুরি অন্যদিকে চেয়ে নিজের চোখের পানি আড়াল করছে।
— আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছো বাবা।
সোজা হেটে বাইরে চলে যায় আজমল চৌধুরি। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে চুপ করে বসে আছে আদিত্য। সে তো আর অবুজ নয়। সারাটাদিন চুপ চাপ করে পাথরের রুপ ধারন করে আছে সে।
ডাক্তারের সাথে কথা হলো। আগামি কালই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবে আদিত্যকে। এখন মোটামুটি সুস্থ হয়েছে। এই কয়েকদিন নিজের প্রতি কোনো কেয়ার ছিলোনা শুভ্রতার, সবটা ছিলো তার আদিত্যের প্রতি। রাতে শুভ্রতা আছে তার পাশে। নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে আদিত্যকে।
রাতে আদিত্যের বুকে মাথাটা হালকা করে রেখে হৃদপিন্ডের শব্দ শুনছে শুভ্রতা। ঘুমের ঘোরে আদিত্যও তাকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। কে বলছে ভালোবাসতে বারণ? আজ যে তারা খুব ভালোবেসেই একে অপরকে আপন করে নিয়েছে। সার্থক হলো তাদের ভালোবাসা।
রিদের কবর পাড়ে বসে আছে আদিত্য। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে অস্রু।
,, কেনো চলে গেলি ভাই, এভাবে সকলকে ফেলে? আমার সুখের জন্য নিজের জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিলি? আর আমি? দেখাতে পারিনি সুখ। ফিরিয়ে আনতে পারিনি পরিবারে তোর তোর ভালোবাসার মানুষদের মাঝে। কিচ্ছু করতে পারিনি তোর জন্য। আর তুই নিজের জীবনের বিনিময়েই আমাকে সব দিয়ে গেলি? জানিস বাবাও এখন তোর প্রতি অভিমান করে নেই। সারাক্ষন তোর জন্য কেদেকেটে অস্থির। খুব ভালোবাসে বাবা তোকে। কিন্তু এই ভালোবাসা চাপা পরে ছিলো, সামান্ন কিছু অভিমানের কাছে।
এর পর কবর জিয়ারত করে চোখের পানি মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে আদিত্য।
,, কেনো এমন হলো ভাই। দুই ভাই মিলে কি একসাথে সারাটা জীবন শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারতাম না?
৭ বছর পর,,,,,,
বারান্দায় বসে আছে আদিত্য। বাইরে চলছে ঝিম ঝিম বৃষ্টি ফোটার আওয়াজ। শুভ্রতা এসে দাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হাত দিয়ে ছুতে চাইছে বৃষ্টি ফোটা গুলো।
বসা থেকে উঠে, পেছন থেকে শুভ্রতাকে জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আদিত্য।
,, চলোনা ছাদে যাই, এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজি, হারিয়ে যাই কিছু অদ্ভুদ অনুভুতিতে।
,, ইশ, শখ কতো। তুমি যানো না। আমার বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর হয়।
,, ব্যাপার না, আমি আছিনা? জ্বর হয়ে খুব বেশি ঠন্ডা লাগলে, সারাক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকবো?
,, তার মানে তুমি চাও আমার জ্বর হোক?
,, হি হি, আমি তা চাইবো কেনো? আমার দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র বৌ।
আদিত্য শুভ্রতাকে আরো কাছে টেনে নিলো। এটা যেনো বৃষ্টি ফোটার মাঝে একটা রোমান্টিকতার আভাস।
তার মাঝেই ছুটে এলো তাদের এক মাত্র ছেলে শুভ। তাদের ভালোবাসার শুভ। যাকে বাচাতে শুভ্রতার সইতে হয়েছে হাজারও আঘাত।
,, আম্মু আম্মু, আমি ছাদে যাচ্ছি।
,, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে ভিজে যাবে তো।
,, আমিতো ভিজতেই যাচ্ছি। বৃষ্ট আন্টির মেয়ে সন্ধার সাথে।
,, কিহ্ তুই সন্ধার সাথে ভিজবি? একধম জাবিনা। তোরও জ্বর হবে ওকেও অসুস্থ করে ছারবি। জাওয়ার দরকার নেই গিয়ে রুমে খেলা কর।
,, আমি তো যাবোই যাবো। আর সন্ধাও যাবে। বাই বাই আব্বু, বাই আম্মু।
হেলে দুলে ওখান থেকে প্রস্থান করলো শুভ। শুভ্রতা রাগে ফুলে যাচ্ছে। আর তা দেখে না চাইতেও হেসে দিলো আদিত্য।
,, দেখলে? কতো ফাজিল ছেলে। কথার কোনো মুল্যই দিলোনা।
আদিত্য আবার জড়িয়ে ধরে বলে উঠে,
,, ওদের নামটার দিকে খেয়াল করেছো? শুভ-সন্ধা। অদ্ভুদ একটা মিল তাই না?
,, আমরা কিন্তু ওদের দুজনকে এভাবে মিশতে দিয়ে ঠিক করছিনা। কারণ সাগর চায়না সন্ধা শুভর সাথে মিশুক।
ছাদে একে অপরের হাত ধরে বৃষ্টি ফোটার মাঝে ঘুরছে শুভ ও সন্ধা। সন্ধা বয়সে একটু ছোট। কিন্তু তা যেনো প্রকাশ পাচ্ছেনা তাদের বৃষ্টি বিলাশে।
ওদিকে শুভ্রতাকে এখনো নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছে আদিত্য। হাত বাড়িয়ে জল ছুয়ে, সেই জল ছিটকে মারছে শুভ্রতার মুখে।
আজ আর নেই কোনো ভালোবাসতে বারণ। এই ভালোবাসা দেখছে প্রকৃতি, দেখছে এই বৃষ্টি ফোটা। আর তা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে দুজন।
<>সমাপ্ত<>

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com