Breaking News

আকাশচুম্বী স্বপ্ন | পর্ব -০২

ঘরের এক কোণে বিছানায় কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি। এতদিন মনে হয়েছে মেয়েটির বয়স একুশ-বাইশ বছর হবে। কিন্তু ঘুমন্ত মেয়েটিকে দেখে মনে হলো তার বয়স সতেরো-আঠারো হবে। বড়জোড় বিশ এর বেশি হবে না। সেদিন বুঝতে পারলাম, মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে বয়স কমে যায়। শীতকালে কাচ ঘেমে যায়। ঘোলাটে হয়ে যায়। জানালার কাচ-ও ঘেমে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল। আমি হাত দিয়ে মুছে পরিষ্কার করলাম। চোখে পড়ল ঘুমন্ত এক মায়াবী মুখ। এর আগে এত সুন্দর কাউকে দেখিনি আমি। কী অপরূপ! কী অপরূপ! মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে কি তাদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়? জানা নেই। তবে এই মেয়েটির ঘুমন্ত মুখ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি মুগ্ধ নয়নে মেয়েটি দিকে তাকিয়ে আছি। সেদিন দেখলাম মেয়েটির কপালের বাঁ পাশে একগোছা চুল নেই। আমার কিছুটা অবাক লাগলো। তার কপালের সেই অংশে চুল ছিল সেটা আমি জানলাম কীভাবে!
সব ভাবনা ভুলে গিয়ে আবারো দৃষ্টি রাখলাম ঘুমন্ত মেয়েটির উপর।
দেখে মনে হচ্ছিল, কাপড়ের পুটলিতে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়া বিড়ালছানা।
ইচ্ছে করছিল তার কাছে যাই। খুব কাছে। গিয়ে পাশে বসি। মুখের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা
এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দেই।
কপাল স্পর্শ করে দেখি শরীরে জ্বর আছে কিনা। দেখতে দেখতে দু’টো বেজে গেল।
চোখের পলকে কেটে গেল দেড় ঘন্টা। খেয়াল করলাম আমার পা দু’টো অবশ হয়ে গেছে।
ইচ্ছে করলেও নাড়াতে পারছি না। শীতের রাতে বাইরে একটানা এতটা সময় দাঁড়িয়ে থাকলে এমন হবারই কথা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাঁঠাল গাছ বেয়ে নিচে নামলাম।
দেয়াল টপকে বেড়িয়ে গেলাম আঁখি মঞ্জিল থেকে। যেতে যেতে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম।
কেন জানি মনে হচ্ছিল, মেয়েটি বিছানা থেকে উঠে এসে জানালার সামনে দাঁড়াবে।
আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফাঁক না করে শুকনো হাসবে।
পরদিন সকালে আর দেখা পেলাম না তার।
রাতে যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন দেখলাম আঁখি মঞ্জিলের দোতলার
বেলকনিতে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে।
আমি একটু ইতস্তত করলাম এ লোকটিকে দেখিনি কখনও তাও আবার সেই মেয়েটির বেলকনিতে!
গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল লোকটি। হাতে সিগারেট।
মাঝে মাঝে ধোঁয়া টানছিল। লোকটির গায়ের রং কালো।
শুধু কালো বললে ভুল হবে, কুচকুচে কালো। মুখে খোঁচা খোঁচা পাকা আধা পাকা দাড়ি।
মাথায় এক ঝাকড়া কালো চুল। এ ধরণের লোকেরা চুল কালো করে।
এ লোকটাও করেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কালো চুলে লোকটাকে মানাচ্ছে না।
পাকা চুলে মানাতো হয়তো। সে যাই হোক, লোকটা একবার আমার দিকে তাকাল।
আমি তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
লোকটি আমার দিকে তাকাতেই হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম।
ডান পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবারো সেই বেলকনিতে দৃষ্টি রাখলাম।
লোকটা গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ফুঁকছে
সকালে যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, ঘড়িতে নয়টা বেজে একুশ মিনিট।
প্রতিদিনের মতো রিকশার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
শত ইচ্ছে থাকার পরেও বেলকনির দিকে তাকাচ্ছিলাম না। মনে একটা ভয় কাজ করছিল,
যদি গতরাতের সেই লোকটাকে আবারও সেখানে দেখে ফেলি! দুশ্চিন্তা কম করার জন্য একটা সিগারেট জ্বালালাম। শুনেছিলাম সিগারেটের ধোঁয়া দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়।
আমার ক্ষেত্রে হলো উল্টো, দুশ্চিন্তা বরং বাড়ছিল।
একসময় আমার সামনে একটি রিকশা এসে থামল।
আমি রিকশায় চড়ে বসলাম। দেখব না, দেখব না করেও একবার বেলকনিতে দৃষ্টি রাখলাম।
সেই মেয়েটা গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে উদাসীন ভাবে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
হয়তো সে জানে, আমি তার সামনে দিয়ে যাচ্ছি।
হয়তো সে রেগে আছে। কিংবা অভিমান করেছে কিন্তু আমার মতে একটা অচেনা,
অজানা লোকের সাথে অভিমান করে থাকাটা তার ঠিক হয়নি।
একদিন রাতে বাসায় ফিরছিলাম। আঁখি মঞ্জিলের সামনে এসে চমকে উঠলাম। বাসার ভিতর থেকে চিৎকার, চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই মেয়েটির আর্তনাদ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। তার ডুকরে কান্নার আওয়াজ শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। না, গেট খুলা ছিল না। আঁখি মঞ্জিলের সদর দরজা ভিতর থেকে তালাবদ্ধ। আমি বাধ্য হয়ে দেয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। কলিংবেল চেপে ধরে রাখলাম। ভদ্রমিহলা দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে বললেন- এই ছেলে, ভিতরে এলে কিভাবে? গেট তো তালাবদ্ধ!
আমি এতটাই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম কথা বলতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ দম নিয়ে বললাম-
– দেয়াল টপকে এসেছি
– কেন এসেছো?
– কেন এসেছি মানে! একটা মেয়ে এতটা চিৎকার দিচ্ছে
– কোথায় চিৎকার দিচ্ছে? (ভদ্রমহিলা নিতান্ত সহজ গলায় বললেন)
তখন আমি স্তম্ভিত ফিরে পেলাম। পুরো বাড়ি নিঃস্তব্ধ। চিৎকার, চেঁচামেচি তো দূর, মশা উড়ে যাওয়ার শব্দ পর্যন্ত নেই। খেয়াল করলাম, সেই মেয়েটি ভেজা ভেজা চোখে ভিতরের ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখের পলক ফেলছে। হাতে, পায়ে লোহার শিকল বাঁধা। তার সামনে ফ্লোরে পড়ে আছে ভাঙা কাচের টুকরো টুকরো অংশ। সেদিন আমি ফিরে এসেছিলাম। রাতে ঘুম হয়নি। সারারাত এপাশ-ওপাশ করতে করতে শেষরাতে ছাদে গেলাম। হঠাৎ আমার কাঁধে হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে আছেন৷ তিনি নিচু গলায় বললেন-
– কি’রে এতদিন পর দেশে ফিরলাম, এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেলি না। বাসায় আসার পর কথাও বলিসনি। ব্যাপার কি? শরীর খারাপ নয়তো?
– ওই বাসার মেয়েটিকে দেখেছো বাবা! সারাদিন শিকল বন্দি হয়ে থাকে?
বাবা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-
– জানিস তো, বিথীর সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সে ছাড়া আর কোনো মেয়ে তোর জীবনে ছিল না। আসবেও না। যা শুয়ে পড়। (বলে চলে গেলেন)
এর আগে কখনো তাকে এতটা রেগে যেতে দেখিনি৷ মায়ের মৃত্যুর পর বাবা কখনো আমার সাথে এতটা কড়া গলায় কথা বলেননি। হঠাৎ তার এমন পরিবর্তন আমাকে বিস্মিত করল। তবু আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। স্তব্ধ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল, দেখলাম আমার পাশে বিথী বসে আছে। গাঢ় নীল শাড়ি পড়ছে মেয়েটা। হাতে কাচের চুড়ি। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। খুব বেশি সাজগোজ করেনি। আবার কমও বলা যায় না। আমি যখন ঘুমঘুম চোখে চেয়ে বললাম- কখন এলে?
বিথী ইতস্তত করে উঠে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে বলল- কিছুক্ষণ আগে এসেছি। আঙ্কেল ফোন দিয়েছেন আসার জন্য।
বিথীকে আমি ছোটোবেলা থেকে চিনি। সে আমার দু’বছরের ছোট আমাকে খুব ভয় পেতো, ভাইয়া বলে ডাকতো, আমাদের বিয়ের কথা হওয়ার পর আর ভাইয়া বলে ডাকে না। সে আমাকে এখনও ভয় পায়। হয়তো আগের থেকেও বেশি।
আমি উঠে বসতে বসতে বললাম- বাবা ঢেকে পাঠিয়েছে? হঠাৎ জরুরি তলব! কোনো বিশেষ কারণ?
– জানি না।
তখন বাবা এলেন, বললেন- অফিসে যাবার সময় ওঁকে সাথে নিয়ে যাস। বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর অফিসে যাবি।
– বাইক নিয়ে..?
– না, রিকশা নিয়ে যাবি।
আমি আর বিথী রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন চোখ পড়ল আঁখি মঞ্জিলের দোতলায়। সেই মেয়েটি বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। চিৎকার, টানা-হেঁচড়া কিছুই করছে না। তবে তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল৷ আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এবার আমি নিশ্চিত হলাম, সে আমার উপর রেগে আছে। কিন্তু কেন রেগে আছে, তা জানা হলো না।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরছিলাম। মেয়েটি তখনও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ আমি স্থির হয়ে দাঁড়ালাম। মনে হলো মেয়েটি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছে। আমি একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালাম। সত্যিই ডাকছে। আজ সন্ধ্যের পরেই হয়তো আঁখি মঞ্জিলের গেটে তালা দেওয়া হয়েছে। আমাকে দেয়াল টপকে ভিতরে যেতে হলো। কাঁঠাল গাছ বেয়ে মেয়েটির একদম কাছে চলে গেলাম। এতটা কাছাকাছি হব, ভাবিনি কখনো৷ মেয়েটি শান্ত গলায় বলল- আপনিও আমায় পাগল ভাবেন?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এতদিন আমার ধারণা ছিল, মেয়েটি কথা বলতে পারে না।
এবার সে বললো-
– শক্ত করে ধরুন, পড়ে যাবেন তো!
– আপনি কথা বলতে পারেন?
মেয়েটি খিলখিল করে হাসলো, সে হাসলে তার গালে টোল পড়ে, তা এতদিন খেয়াল করিনি।
ফর্সা গালের গভীর টোল একবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল।
আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললাম-
– নাম কি আপনার?
– আমি নীলা…
.
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com