Breaking News

আকাশচুম্বী স্বপ্ন | পর্ব -০১

পাশের বাসায় মেয়েটিকে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে” আমি যখন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই, মেয়েটি বেল্কনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে। দেখে মনে হয় ছোট্ট এক শিশু মায়ের বকা খেয়ে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে মুচকি হাসে। হাত দিয়ে ইশারা করে কিছু একটা বলতে চায়। একদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েটি বেল্কনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে খিলখিল করে হেসে উঠল।
হঠাৎ সেখানে এক ভদ্রমহিলা এলেন।
আমাকে দেখতেই তিনি মেয়েটিকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। মেয়েটি চিৎকার দিচ্ছিল, চেঁচিয়ে কাঁদছিল তবুও ভদ্রমহিলা ছাড়লেন না। মেয়েটি আবার ছুটে এসে গ্রিল ধরে দাঁড়াল। তখন ভদ্রমহিলা যুবতী মেয়েটির গালে কয়েকটি চড় বসিয়ে দিলেন। টেনে নিয়ে ঘরে বন্দি করে রাখলেন। তারপর থেকে আর কখনো মেয়েটিকে বেলকনিতে দেখিনি। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় পাশের বাসার বেলকনিতে তীব্র ইচ্ছে নিয়ে তাকাতাম, একপলক মেয়েটিকে দেখবার জন্য। প্রতিবার আমাকে নিরাশ হতে হত।
একদিন রাতে বাসায় ফেরার সময় দেখলাম মেয়েটি গ্রিল ধরে এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ফর্সা মুখমন্ডলে এক জোড়া মায়াবী চোখ। স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে চোখদু’টো আমায় মুগ্ধ করেছিল সেদিন।
মেয়েটির গলায়, কানের উপর, চোখের সামনে ব্রাউন কালারের চুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাতাসে এলোমেলো হচ্ছিল। গায়ের হলুদ রঙের ওড়নাটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একসময় নিচে পড়ে গেল। মেয়েটি এতটা নির্লিপ্ত ছিল, তার গায়ের ওড়না গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচে পড়ে গেছে তা বুঝতে পারল না। আমি আরো একটু এগিয়ে গেলাম। উঁচু দেয়ালের কাছ থেকে দোতালায় দাঁড়ানো মেয়েটিকে স্পষ্ট দেখা যায়।আমি আরো এগিয়ে গেলাম। তখন তার কাটা ঠোঁট চোখে পড়ল। যখন আরো একটু মনোযোগ দিয়ে চেয়ে দেখলাম, তখন আরো অনেক কিছু আমার চোখে ধরা পড়লো। মেয়েটির হাতে, কপালে, ঘাড়ে কাটা দাগ। দেখে মনে হলো মারধরের দাগ। মেয়েটি হঠাৎ আমাকে দেখে ফেলল। তার শুকনো ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠল। মেয়েটিকে এত কাছ থেকে দেখিনি আগে। সেদিন খুব কাছ থেকে দেখলাম।
– এই মেয়ে, নাম কি তোমার?
সে কিছু বলল না। দু’হাত দিয়ে মুখ ডেকে রাখল। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলল। তখনই সেই ভদ্রমহিলা আবার এলেন। আবারও মেয়েটিকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। স্লাইড উইন্ডো খুলা ছিল। তিনি পর্দা টেনে জানালা বন্ধ করে দিলেন।
এরপর একে-একে ছ’মাস কেটে গেল। শিকলবন্দী মেয়েটিকে আর দেখতে পেলাম না।
প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যাবার সময় এবং রাতে বাসায় ফেরার সময় ও বাসার বেলকনির দিকে তাকাতাম।
ফাঁকা বেলকনি আমার মন খারাপ করে দিত।
তবুও আশা ছাড়তাম না। পরদিন আবার সেই বেলকনিতে দৃষ্টি রাখতাম।
বাসার নাম আঁখি মঞ্জিল। একদিন সকালে আঁখি মঞ্জিলের দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম।
ডোরবেল বাজাতেই সেই ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে ভড়কে গেলেন।
– কি চাই? (অনেকটা বিরক্তি নিয়ে বললেন)
ভদ্রমহিলার আমার উপর বিরক্ত হবার কোনো কারণ ছিল না।
তিনি কেন বিরক্ত হলেন তা বুঝতে পারলাম না। কৌতূহল দমিয়ে রেখে বিনয়ের সাথে বললাম-
– আসসালামু আলাইকুম।
ভদ্রমহিলা দ্রুত সালামের জবাব দিয়ে দায়সারা হয়ে দরজা আটকাচ্ছিলেন।
আমি দ্রুত বললাম-
– আপনাদের বাসায় একটি মেয়ে ছিলো লম্বা, ফর্সা, ব্রাউন কালার চুল,
তার সাথে কথা বলা যাবে?
ভদ্রমহিলা তীব্র বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুটা সময়।
তারপর হঠাৎ দুম করে আমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
এতে অপমান বোধ করার কথা। কিন্তু আমার একটুও তেমন মনে হলো না।
উল্টো আরো কৌতূহল জাগল। মাসখানেক পর আবার আমি আঁখি মঞ্জিলে গেলাম।
দোতলায় গিয়ে ডোরবেল বাজাতেই সেই ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন।
আমাকে দেখে কিছু বললেন না। হাতে হাত বেঁধে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
– এক গ্লাস পানি হবে?
আমার ধারণা ছিল ভদ্রমহিলা পানি দেবেন না।
কিন্তু তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন- বসুন দিচ্ছি।
আমাকে সোফায় বসিয়ে তিনি পানি আনতে গেলেন।
ভিতরের একটি রুম থেকে অদ্ভুত এক শব্দ ভেসে এলো। লোহার শিকলের শব্দ নয়তো!
আমি উঠে দাঁড়ালাম। রুমের দরজা আপনা-আপনি খুলে গেল।
সেই মেয়েটিকে আবার দেখলাম। তবে এবারের দেখাটা ভিন্ন।
তার চোখের নিচে কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে। শরীর আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।
চুলের চকচকে ব্রাউন কালারটা কেমন যেন সাদাটে হয়ে গেছে। চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা নেই।
হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা। আমাকে দেখে সে কয়েকবার চোখের পলক ফেলল।
দু’হাত দিয়ে চোখ কচলে আবার দেখল। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
যখন সে নিশ্চিত হলো আমিই তার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন সে সব ব্যথা ভুলে শুকনো হাসল।
তারপর শুরু করল টানা-হেঁচড়া। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করল মেয়েটি।
লোহার শিকল ছিন্ন করতে পারল না। ভদ্রমহিলা পানির গেলাস হাতে নিয়ে আসছিলেন।
মেয়েটির এমন কান্ড দেখে তিনি অজান্তেই হাতের গেলাস ছেড়ে দিলেন।
মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল কাচের টুকরো।
তিনি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ছুটে গেলেন মেয়েটির কাছে।
মেয়েটিকে টেনে নিয়ে গেলেন তার শোবার ঘরে।
মেয়েটি চিৎকার দিলো, ছুটে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু ভদ্রমহিলা ছাড়লেন না।
ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম মেয়েটির চিৎকার।
তার কান্নার আওয়াজ আমায় হাতুড়িপেটা করছিল নীরবে।
কিছুক্ষণ পর সব শব্দ থেমে গেল। নিঃস্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ।
ভদ্রমহিলা ধীর পায়ে এলেন। গম্ভীর ভাব নিয়ে বললেন-
– বেরিয়ে যাও আর কখনো এমুখো হবে না।
আমি অগত্যা বেরিয়ে এলাম। অচেনা, অজানা রয়ে গেল সেই মেয়েটি। তার চিৎকার বাজতে থাকল আমার কানে। তার শুকনো হাসি সদ্য ফুটন্ত গোলাপের ন্যায় ভাসতে থাকল আমার ঘোলাটে চক্ষুদ্বয়ে। মনে মনে কৌতূহল জাগল, কে এই মেয়ে? কী তার পরিচয়? কেন সে আমায় দেখলে হাসে? কেন সেই ভদ্রমহিলা আমায় এত ঘৃণা করেন?
একদিন ঠিক করলাম লুকিয়ে লুকিয়ে তার সাথে দেখা করবো। হোক অপরাধ, তবুও দেখা করতে হবে। যত সময় যাচ্ছিল, মেয়েটির প্রতি আমার কৌতূহল ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, তার স্বচ্ছ টলটলে চক্ষু জোড়া কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। কাটা ঠোঁট বলতে দেয় না।
একদিন রাতে ঠিক করলাম, দেয়াল টপকাবো। এ-ছাড়া আর কোনো পথ খুলা ছিল না। প্রতিদিন রাত দশটায় আঁখি মঞ্জিলের সদর দরজায় তালা দেওয়া হয়। চাবি ছাড়া তালা খুলতে পারা আমার সাধ্যের নয়। তাই উঁচু দেয়াল বেয়ে উঠলাম। দেয়াল থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়তেই মৃদু ভয় পেয়ে বসল আমায়। মনে হলো হাঁটু কাঁপছে। আমি পায়ে হাত রাখলাম। সত্যি বলতে হাঁটু কাঁপছিল না। কাঁপছিল আমার বুক। এতটাই ধড়ফড় করছিল, কয়েক মিনিট নড়তেই পারলাম না। শিশিরে আলতো ভেজা ঘাসের উপর স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন রাতের সাড়ে বারো। আশপাশের বাড়িগুলোতে বাতি নিভতে শুরু করেছে। আঁখি মঞ্জিলের সব ক’টা ঘরে বাতি নিভানো হয়ে গিয়েছিল তখন। শুধু সেই মেয়েটির ঘরে আলো জ্বলছিল। বেলকনির পাশে বিশাল কাঁঠাল গাছ।
খুব একটা লম্বা না হলেও এর দেহ ইয়া বড়। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নাগাল পাওয়া যায় না। পায়ের স্যান্ডেল খুলে রেখে আমি কাঁঠাল গাছ বেয়ে কোনোমতে দোতলার বেলকনিতে পা রাখলাম। দোতলায় উঠতে খুব একটা কষ্ট পোহাতে না হলেও মেয়েটিকে এক পলক দেখতে আমাকে অনেকটা বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বেলকনির কাঠের দরজা ভিতর থেকে লাগানো ছিল। তখন উপায় একটাই, জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর দৃষ্টি রেখে পালিয়ে যাওয়া। মুশকিল হলো জানালা পর্যন্ত যেতে পারা। কারণ জানালা বেলকনি থেকে হাত দু’-এক দূরে। যেই না বেলকনির দেয়ালে পা রেখে জানালা ছুঁয়ার জন্য হাত বাড়ালাম, অমনি পা’টা গেল ছুটে। কপাল ভালো কাঁঠাল গাছের বাকানো ডাল পাতা ছিল। নাহলে সেদিন হাত-পা ভেঙে ঘরে ফিরতাম। তারপর দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে জানালা ছুঁতে সক্ষম হলাম। কাচের জানালা দিয়ে ভিতরের ঘরটা পুরোপুরি দেখা যায় না। ঘরে আলো জ্বলছিল তাই আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম।
ঘরের এক কোণে বিছানায় কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটি
এতদিন মনে হয়েছে মেয়েটির বয়স একুশ-বাইশ বছর হবে। কিন্তু ঘুমন্ত মেয়েটিকে দেখে মনে হলো তার বয়স সতেরো-আঠারো হবে। বড়জোড় বিশ এর বেশি হবে না। সেদিন বুঝতে পারলাম, মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে বয়স কমে যায়। শীতকালে কাচ ঘেমে যায়। ঘোলাটে হয়ে যায়। জানালার কাচ-ও ঘেমে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল। আমি হাত দিয়ে মুছে পরিষ্কার করলাম। চোখে পড়ল ঘুমন্ত এক মায়াবী মুখ। এর আগে এত সুন্দর কাউকে দেখিনি আমি। কী অপরূপ! কী অপরূপ! মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে কি তাদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়? জানা নেই। তবে এই মেয়েটির ঘুমন্ত মুখ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি মুগ্ধ নয়নে মেয়েটি দিকে তাকিয়ে আছি। ইচ্ছে করছিল তার কাছে যাই। খুব কাছে গিয়ে পাশে বসি। মুখের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দেই…
.
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com