বিরহ মিছিল । পর্ব - ০২



মুগ্ধতার মনে হলো আদিলের আগে পৃথিবীতে জন্মানো তার ঠিক হয়নি। পাপ করেছে সে, আদিলের আগে পৃথিবীতে এসে। কিন্তু এটা তো ভবিতব্য। মুগ্ধতার মন খারাপ হলো। বিতৃষ্ণা গ্রাস করে ফেললো মেয়েটার শরীরের অঙ্গে-অঙ্গে , বক্ষস্থলে। মুগ্ধতা কন্ঠে রাগ ঢেলে আদিল কে শুধালো,

" দাঁড়িয়ে আছো কেন তাহলে? আসো আমায় কোলে নাও।"
মুগ্ধতার কথায় আশ্চর্য আদিল। প্রথম থেকেই আদিল বোধগম্য মেয়ে টা তার বয়সের থেকে একটু বেশিই চটপটে। আদিল ছোট করে বলল,
" কেন?
মুগ্ধতা ভঙ্গিমা করে শুধালো,
" তুমিই বললে আমি পাঁচ বছরের বাচ্চা। বাচ্চাদের কোলে চড়িয়ে ঘোরাতে হয় জানো না? "
ভয়ংকর বিপাকে পড়লো আদিল। এই মেয়ে কে ছোট বললেও তেঁতো উঠে। আবার বড় বললেও। আর আপু বললে তো কথাই নেই গর্জে উঠে সঙ্গে সঙ্গে। কোন দিকে যাবে সে। এই মেয়ের সাথে কথা বলাই উচিত হয়নি। নিজেকে ধিক্কার জানালো আদিল। অসহায় কন্ঠে বলল,
" বিরাট ভুল বাক্য উচ্চারণ করেছি আমি। আমি এর প্রায়শ্চিত্ত কিভাবে করব বলো। "
আদিল কথা থামালো। তার হাত ঘড়ির দিকে একবার উঁকি দিয়ে পূনরায় বলল ,
" দুইটা বাজছে। আমার কোচিং চারটায়। ঝটপট বলো।"
মুগ্ধতা ডেবডেব আঁখি যুগলে আদিলকে অবলোকন করল। স্বেদজলের অস্তিত্ব আদিলের ললাটে। ক্লান্ত চোখমুখ। আদিল কে এ ভাবে দেখে মুগ্ধতা বেঁকে গেল। হাতের নখ পরোক করতে করতে বলল,
" কিছু করতে হবে না। যাও তোমার ঘরে।"
এতো সহজে মুগ্ধতার কব্জা থেকে নিস্তার মিলবে ভাবে নি আদিল। মুগ্ধতা কে আরেকবার অবলোকন করে দীর্ঘ শ্বাস নির্গত করল, তারপর দ্রুত প্রস্থান করল সে। মিনিটে মিনিটে মুড চেঞ্জ করতে বেশ জানে এই মুগ্ধতা নামক মেয়ে। যদি আবার মুড চেঞ্জ হয়!

মায়ের মার খাওয়ার ভয়ে মুগ্ধতার পুরো একটা দিন জেঠিমার বাড়িতে কাটলো। এখন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। পড়ার টেবিলে বসে আদিল ও মুগ্ধতা। দুজনের মাঝে বড় জেঠা রফিক আজম। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি দুই জনকে গণিত করান। বলা যায় দুজনের গণিত শিক্ষক উনি।
মুগ্ধতা কে পরিমিতি অধ্যায় থেকে দুটো বোর্ডের সৃজনশীল করতে দিয়েছেন রফিক আজম। মুগ্ধতা মনোযোগ সহিত অংক কষছে। আদিল কে নিয়ে নতুন অধ্যায় ধরলেন রফিক আজম।
মুগ্ধতার দুটো সৃজনশীল করা শেষে বড় জেঠার সামনে খাতা রাখলো। বড় জেঠা খাতা দেখতে দেখতে বললেন,

" নৈবিত্তিক দেখ গাইডের। না বুঝলে বলবি।"
মুগ্ধতা তার ব্যাগ থেকে গণিত গাইড বের করে, খুলে মুখের সামনে রাখল।
চোখ দুটো সেথায় থাকলেও আড় চোখে আদিলকে দেখছে সে।
ললাটে ক্ষীণ ভাজ ফেলে আদিলের কথা ভাবলো।
আদিলের পুরো মনযোগ অংক খাতায়। জেঠা তাকে অংক খাতায় বোঝাচ্ছে।
মুগ্ধতা তার লেখার কলম বুদ্ধি করে হাত ঠেলে টেবিলের নিচে ফেললো।
বড় জেঠা, আদিল দেখে নি তা। এই সুযোগে কলম তোলার অজুহাতে আদিলের
পায়ের অবস্থান দেখল। মুগ্ধতা কলম তুলে পূনরায় চেয়ারে বসলো ।
গাইডে মনযোগ রেখে নিজের পা আদিলের পায়ের উপর রাখল।
পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাহায্যে সুড়সুড়ি দিল আদিলের পায়ের পিঠে।
আদিলের অভিব্যক্তি আড় চোখে মুগ্ধতা দেখার চেষ্টা করল।
মুহূর্তে দুজনের চোখাচোখি হলো। আদিলের পানসে মুখ,চোখ জোড়া বিব্রত।
মুগ্ধতা ঠোঁট চেপে হাসলো।

আধ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও মুগ্ধতার হেলদোল দেই।
যতক্ষণ পড়ার টেবিলে রইল। আদিলের পায়ে খোঁচা দিয়ে গেল।
বড় জেঠিমা একবার এসে বলে গেছেন তার বাবা অফিস থেকে ফিরেছেন।
বাসায় ফেরার পরিকল্পনা করল সে। বই খাতা ব্যাগে ঢুকালো।
রফিক আজম চলে গেছেন। পড়ানো শেষ। রুম ফাঁকা। আদিল ঠায় টেবিলে বসে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুগ্ধতার মুখবিবরে। মুগ্ধতা তার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে
বের হতে আদিল বলে উঠলো,
" লিমিট ক্রস করছ। সব সময় এসব বরদাস্ত করবো না।"
মুগ্ধতা আহ্লাদিত কন্ঠে আওড়াল,
" করতে বলেছে কে? করো না।"
" আমি শেষ সুযোগ দিয়েছি তোমায়। আরেকদিন আমার সাথে বাজতে এসো। তারপর।"
মুগ্ধতা কন্ঠে অসহায়ত্ব এঁটে বলল,
" ভয় পেয়েছি।"
কথাটি বলে হাসতে শুরু করলো মুগ্ধতা। আদিল বিভ্রান্ত হলো। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো,
" এই মেয়েটাকে এত ছাড় দিচ্ছিস কেন আদিল?"

চুপিচুপি এক পা ফেলতে ফেলতে সতর্কে
ঘরে প্রবেশ করলো মুগ্ধতা। রান্না ঘরে, বসার ঘরে মাকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হতে বাবা কে দেখতে পেল মুগ্ধতা। আরিফ আহমেদের চোখমুখ কঠোর। বুঝতে অসুবিধা হলো না মায়ের সাথে কাচাল হয়েছে।
আরিফ আহমেদ এগিয়ে মেয়ের পিঠে হাত রেখে বলল,
" রাতে খাওয়া হয়েছে আমার মামনীর?"
চোখমুখে কঠোর ভাব এখন দেখা যাচ্ছে না। মুগ্ধতা হেসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
" না বাবা খাওয়া হয়নি।"
" আচ্ছা চলো,আজকে তুমি আমার সাথে খাবে।"
মুগ্ধতা কে একটা চেয়ারে বসিয়ে আরিফ আহমেদ পাশের চেয়ারে বসল। নিজেই মেয়ের প্লেটে ভাত বেরে দিল ও নিজের প্লেটে ভাত নিল। মুগ্ধতা মাকে খুঁজলো। আরিফ আহমেদের দৃষ্টিতে এড়ালো না। তিনি মুগ্ধতার প্লেটে তরকারি রেখে সরল কন্ঠে বললেন,
" তোমার মা ক্ষেপেছে। রাগ কমলে আসবে। তুমি খাওয়া শুরু করো মামনী।"
মুগ্ধতা খেতে শুরু করল। আরিফ আহমেদ মুখে ভাত পুরে বন্ধুত্ব সূলভ গলায় আওড়ালেন,
" তোমার আম্মু যা বললো তা কি সত্যি মামনী? "
মুগ্ধতা ইঙ্গিত বুঝলো। লজ্জা পেল ঈষৎ। আরিফ আহমেদ বুঝতে পেরে বললেন,
" বাবা কে বলতে পারো মামনী।"
মুগ্ধতা উপর নিচ করে মাথা নাড়াল। আরিফ আহমেদ বললেন,
" আদিলের বয়স কত মামনী। ছোট। ক্যারিয়ার গড়তে লাগবে অনেক সময়। নিতান্ত দুজনই বাচ্চা তোমরা। সমবয়সী বলা যায়।

মুগ্ধতা মনোযোগ সহকারে শুনলো। চঞ্চল কন্ঠে বলল,
" আমরা দুজন ছোট খাটো একটা চাকরি জোগাড় করে নিব বাবা। আমার অসুবিধা হবে না। একটু কষ্ট হবে। তবুও আদিলকে আমি চাই বাবা।"
আরিফ আহমেদ কিছু বলতে মুখ খুললেন, তৎক্ষনাৎ আমেনা গর্জে উঠলেন,
" চাওয়াচ্ছি বাপ মেয়েকে।"
মুগ্ধতা কে টেনে টেবিল ছাড়া করলেন আমেনা। আরিফ আহমেদ খাওয়া ছেড়ে উঠলেন। বললেন,
" কি হচ্ছে কি আমেনা। আমার মেয়ে কে ছাড়ো।"
একপ্রকার ধমকানো কন্ঠস্বর ওনার। আমেনা মুগ্ধতা কে ছাড়লেন না। আগুন চোখে আরিফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে শুধালেন,
" ছাড়ব না। আমার মেয়েকে আশকারা দিচ্ছ তুমি। কতোটা প্রভাব পড়বে আমার মেয়ের জীবনে জানো? আমায় একদম আটকাবে না।"
নিজের ঘর মূখী হলেন আমেনা। মুগ্ধতা কাঁদছে। মা টেনেহিঁচড়ে রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন তাকে। মুগ্ধতা 'বাবা , বাবা' আওড়াচ্ছে। আরিফ আহমেদ শাসিয়ে বললেন,
" আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিয়ো না আমেনা।"
" কি করবে তুমি হ্যা? শরীরে আমার আ গু ন দিব আজকে, যদি আজ আমায় আটকিয়েছ।"

বাঁশের লাঠি দিয়ে দিকবিদিক না দেখেই মুগ্ধতা কে মারতে লাগলেন আমেনা। আরিফ আহমেদ দরজা ধাক্কালেন, হুঙ্কার দিলেন। আমেনার সিদ্ধান্ত থেকে তলানো গেল না।
মুগ্ধতা এক একটা আঘাতে চিৎকার করে উঠছে। মেয়ের উপর দয়া হলো না আমেনার। তার ভাষ্যে মেয়ে হাত ছাড়া হয়ে হচ্ছে। এখন শাসন না করলে পরে বিগড়ে যাবে।
মুগ্ধতা চেতনাহীন প্রায়। চোখ মুদে আসছে। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে যাচ্ছে। মৃত্যু বোধহয় আজ দ্বার গোড়ায়। বাবার চেঁচামেচি কানে এলো। আদিলের আবছা কন্ঠ শুনতে পেল মুগ্ধতা।
" আঙ্কেল কি হয়েছে? "

মাকে আহাজারি করে ক্ষীণ গলায় মুগ্ধতা বলল,
" ব্যথা লাগছে আম্মু্। আমার শ্বাস রোধ হয়ে আসছে। আমি হয়তো আর বাঁচব না আম্মু।"
মেয়ের কথা শ্রবণ হতেই হাত থাকলো আমেনার। লাঠি ফেলে মেঝেতে নেতিয়ে থাকা মুগ্ধতার মুখে থাপ্পড় মারার মতো গালে আঘাত করে বললেন,
" এই মুগ্ধতা।"
মুগ্ধতার চেতন নেই। আমেনার বুকে ভয়ের বাসা বাঁধে। ভেজা গলায় শুধালেন,
" এই মুগ্ধতা, চোখ খোল।"
.
চলবে~
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url