মুনতাসীর ও উপমার বিচ্ছেদ । পর্ব - ০৩



কি করছো তুমি দাদু?”
-”পান খাচ্ছি।খাবি?”
-”নাহ।খাবো না।তোমাকে না বলেছি পান খাওয়া উচিত না।
তোমাকে বার বার বলি পান ও চা খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করো 
কিন্তু না তুমি করবে তোমার কাজ।তুমি আমার কথা মানতে নারাজ।”
উপমা দাদুর পাশে সোফায় বসলো। ফর্সা মুখে লাল টুক টুক ঠোঁট।
চোখ গুলো বেশ টানা টানা। বয়স হলেও কি সুন্দর লাল লাল চুল। 
তার মাঝে গুটি কয়েক চুল হয়তো পেকেছে।
হাত পায়ের নখ গুলো টকটকে লাল মেহেদী দিয়ে রাঙানো।
দাদুকে খুব সুন্দর লাগে দাদুকে উপমার কাছে। সৃষ্টিকর্তা কি নিখুঁত করে তাকে তৈরী করেছেন।
না জানি যৌবনে কি সুন্দর ছিল দাদু।তবে দাদুর বাহির যেমন সুন্দর ভেতর তার দ্বিগুণ সুন্দর।
এই মানুষটা থেকে উপমা অনেক কিছু শিখেছে।
কিভাবে সম্পর্ক মজবুত করতে হয় তাও শিখেছে।

দাদুকে আজ পর্যন্ত কারো সাথে উচু আওয়াজে কথা বলতে দেখে নি উপমা।
মামীর সাথেও কি সুন্দর সম্পর্ক।সব চেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে দাদু বেশ দুষ্টুমি করতে জানে।
তাদের সাথে বন্ধুর মতো অচরণ করেন।
উপমা মাঝে মাঝে ভাবে এই মানুষ টা তার আপন না হয়েও কি সুন্দর তাকে আদর করে।
একদম নিজের আপন দাদুর মতো। 
মিতি তো মাঝে মাঝেই বলে,,মিতির থেকে নাকি উপমাকে দাদু বেশি আদর করে।
আসলেই এই মানুষটা উপমাকে একদম নাতনির মতো আদর করে।
উপমাকে অন্যমনস্ক হয়ে দেখে আয়শা খাতুন বলেন,,
-"কি সখী কোথায় তোর মন?কি এতো চিন্তা করছিস?
আবার কারো প্রেমে পড়লি নাকি?
উপমা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-"তেমন কিছু না দাদু।"

-"সখী চাইলে বলতে পরিস।আমি কেউকে বলবো না।
তোর সাথে উনার সাথে সেটিং করিয়ে দিবো।"
-"ধুর দাদু।তুমি কিন্তু বেশি বেশি অনুমান করছো।"
-"আরে লজ্জা পাচ্ছিস কেনো সখী? বল না ছেলে দেখতে কেমন।
কি কাজ করে? কোথায় থাকে?"
উপমা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে দাদুর গলা জড়িয়ে বলল,,
-"একটু তেল দিয়ে দিবে চুলে?
-"কথা ঘুরিয়ে ফেলছিস তুই।"
- "কেমন কিছুই না। বিশ্বাস করো।"
-"আচ্ছা ঠিক আছে।সখীকে কি না করা যায় নাকি?"

বলেই উপমাকে তিনি নিজের কাছে বসিয়ে দিলেন।অতি যত্নে মাথায় তেল লাগিয়ে দিলেন।
 তেল দেয়া শেষে হতেই বসার ঘরে উপস্থিত হলো মুনতাসীর।
 সবে মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে।
উপমা তড়িঘড়ি করে নিজের ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিল।
আজ তিন দিন পর এই লোককে দেখলো সে।
একই বাসায় থেকেও দেখা হয়।সকালে নাস্তা করার আগেই নাকি লোকটা চলে যেতো।
আবার রাতেও অফিস থেকে এসে রুমেই থাকতো।
খাবার টেবিলেও দেখা হতো না।
বেশ ব্যস্ত ছিল নাকি এই কয়েক দিন।
উপমা এবার হাতে তেলের বোতল নিয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল,,
-"চা চলবে?"

-"সখী তোর হাতের চা কি আমি না বলতে পারি নাকি?"
-"আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি।"
বলেই কিচেনের দিকে পা বাড়ালো উপমা। মুনতাসীর এতক্ষণ যাবৎ তাদের কথা শুনছিল। 
মুনতাসীর একবার উপমার যাওয়ার দিকে তাকালো।
কিছু একটা ভাবলো।সোফায় গা এলিয়ে দিলো। 
হাতে থাকা একটা বক্স টেবিলে রাখলো।ক্ষীণ গলায় বলল,,
-"উপমা!"
উপমা মুহূর্তেই দাড়িয়ে গেলো। শরীর জুড়ে শিহরণ হলো। 
ঢোক গিললো সে।বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো।নিজেকে শান্তি করার চেষ্টা চালিয়ে বলল,,
-"জি মুনতাসীর ভাই।"
-"আমার জন্য ও কি এক কাপ চা হবে?"
উপমা মিন মিন করে বলল,,

-"হুম নিয়ে আসছি।"
বলেই চলে গেলো উপমা।মুনতাসীর বার কয়েক চোখের পলক ফেললো।
এই মেয়ের মধ্যে তো কোনো ভাবান্তর নেই।কি রে বুঝবে যে মেয়ে টা তাকে পছন্দ করে কি না?
নাহ মুখে কিছু বলে না কাজে কিছু বোঝায়।
মুনতাসীর দাদুর পাশে বসে পড়লো। উচ্চ স্বরে মাকে ডাকতে শুরু করলো।

মোর্শেদা বেগম নিজের রুম থেকে বসার রুমে চলে এলেন। 
মিতি ও চলে এলো। 
মোর্শেদা বেগম এগিয়ে আসতেই মুনতাসীর বসা থেকে 
উঠে সেই বক্স থেকে মিষ্টি নিয়ে মায়ের মুখের সামনে মিষ্টি এগিয়ে দিলো। 
মোর্শেদা বেগম মিষ্টি মুখ নিলেন। মিতি কেও মুনতাসীর মিষ্টি খাইয়ে দিল।
এর মাঝে চা তৈরি করে নিয়ে এলো উপমা।
এবার উপমার সামনে মিষ্টি ধরতে দুজনেই কিছুটা হতবম্ব হলো।
মুনতাসীর খুশিতে আত্মহারা হয়ে উপমার সামনে তো ঠিক ই মিষ্টি ধরলো কিন্তু এখন।
এখন কি উপমা মিষ্টি টা তার হাতে খাবে?
এদিকে উপমাও মনে মনে খুশি হলো।

মিষ্টি মুখে পুড়ে নেয়ার আগেই মোর্শেদা বেগম বললেন,,
-"উপমা এক গ্লাস পানি এনে দাও তো আমাকে।"
উপমা এক পলক মোর্শেদা বেগমের দিকে তাকালো। 
মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি মোটেও খুশি হন নি।উপমা চলে গেলো।
মুনতাসীর মিষ্টি টা বক্সে রেখে দিতেই শুনতে পেলো,,
-"মিষ্টি কিসের সেটাই তো বললে না।"
-"মা আমার প্রমশন হয়েছে।"

-"তাই। আলহামদুলিল্লাহ। এটা তো খুব খুশির খবর।"
-"হুম মা।আমি এই দিনটার জন্য অনেক খাটুনি খেটেছি।অবশেষে হলো।"
-"হুম। বাবা দোয়া করি এভাবেই এগিয়ে যাও।'
উপমা এক গ্লাস পানি মোর্শেদা বেগমের হাতে তুলে দিল।উপমা সবার সাথে বসবে কি না ভেবে পেলো না।উপমাকে দাড়িয়ে থাকাতে দেখে আয়েশা খাতুন বলেন,,
-”সখী তুই দাড়িয়ে আছিস কেনো?আমার পাশে এসে বস।”
কিন্তু উপমা বসার আগেই মোর্শেদা বেগম বলেন,,

-”উপমা দেখতো চুলোয় আমি রান্না দিয়ে এসেছি।
একটু কষ্ট করে কমপ্লিট করে ফেলো।”
উপমা জানতো এমন কিছুই হবে।তাই সে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।
মিতি মিষ্টির বক্স থেকে মিষ্টি খেতে খেতে বলল,,
-"ভাই ট্রিট দিতে হবে কিন্তু।"
-"বল কি চাই?"
-"একটা ভাবি।"
ঠাট্টার শুরে বলল মিতি।মুনতাসীর কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লো।
মা নির্ঘাত আবার শুরু করবে। নাতির দিকে তাকিয়ে আয়শা খাতুন বলেন,,
-"তুমি তো আমাকে মিষ্টি খাওয়ালে না অন্তত একটা নাতি বউ এনে দাও।"
-"তোমার যে ডায়বেটিস তা কি ভুলে গেলে নাকি?
মুনতাসীর দাদুকে বলতে বলতেই
মোর্শেদা বেগম হাসতে হাসতে বলেন,,
-"সবার একটাই চাওয়া। তোমার বিয়ে।আর কত লেট করবে।
মেয়ে খুঁজতেও তো সময় লাগবে।রাজি হয়ে যাও।"
-"সময় লাগবে কেনো?একটু এদিক সেদিক তাকালে দেখতে পাবে কত মেয়ে।"
-"সবাই তো আর তোমার যোগ্য নয় বাবা।তোমার জন্য লাখে একটা মেয়ে আমি নিয়ে আসবো।"
-'আমার লাখে একজন না।সাধারণ একজন প্রয়োজন।"
-"তুমি শুধু বলো একবার কেমন মেয়ে চাই।তোমার জন্য খুজে নিয়ে আসবো।"
-”সময় হলে বলে দিবো।শুধু জেনে রেখো অসাধারণ কেউকে নয় সাধারণ কেউকে চাই।”
বলেই মুনতাসীর চলে গেলো। 
মোর্শেদ বেগম ও আয়শা খাতুন আরও কিছুক্ষণ কথা বলে যে যার রুমে চলে গেলেন।

নিস্তব্ধ রাত।
অন্ধকার আকাশ। ছাদের দুই প্রান্তে দুই মানবী।
দুজনের মনেই কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভুতির সম্মেলন।
দুজনেই কিছু একটা নিয়ে বেশ বিভোর।
দুজনেই হয়তো কিছু একটা খুব গভীরে ভাবে চিন্তা করছে।
উপমা বেশ কয়েকবার এপাশ ওপাশ করেছে কিন্তু ফলাফল শূন্য।
একটুও ঘুম আসে না তার।কি করবে সে?বেশ অস্থির লাগছিল। 
হাস ফাঁস করতে করতে কোনো রকম গায়ে ওড়না তো জড়িয়ে খুব সাবধানে ছাদে চলে এলো।
একটু সাবধানতা সাথে কেউ দেখে নিলে নির্ঘাত উল্টো পাল্টা কিছু ভাববে। 
অবশ্য ভাবারই কথা।
রাত বিরাত কি মেয়ে মানুষের শোভা পায় নাকি এমন ছাদে যাওয়া?
কিন্তু কি করবে উপমা? 
রুমে ভেতর কেমন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
জানলার পাশে দাড়িয়েই আজ অস্থির ভাব কমে নি।
প্রথমে ভেবেছিল মিতি কে ডাক দিবে কিন্তু মিতির রুমে গিয়ে দেখে মিতি বেঘর ঘুমিয়ে আছে।
যা বাবা।তাই আর ডান বাম না তাকিয়ে সোজা চলে এলো উপর উপমা। 
আসতে করে ছাঁদের গেট খুলে আবার তা চাপিয়ে দিলো। 
উফ এখন একটু শান্তি লাগছে।
জীবন বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময়,বিভিন্ন রঙে রঙিন হয়।মুহূর্তে মুহূর্তে তার গতি পথ পরিবর্তন হয়।
জীবনে কখন চলে ভাটা তো কখন জোয়ার এসব মিলিয়ে জীবন চলতে থাকে। 
যে মেনে নেয় বা মানিয়ে নেয় নিজেকে সেই মূলত সুখী হয়।
জীবনে প্রতিবার কিছু না কিছু শিক্ষা দিয়ে যায়।
তাই উচিত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনে বহুদূর পথ পরি দেয়া যায়।
কথা গুলো ভেবে উপমা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো।
পিছন ফিরে হাটা ধরলো হুট করেই মনে হলো কারো সাথে ধাক্কা খেলো।
উপমা নিজের ফোন এর লাইট অন করলো।ভ্রু কুচকে বলল,,
-"আপনি এখানে? তাও এই রাতে?"
-"তো?তো কি হয়েছে? রাত বলে কি আমি ছাদে আসতে পারবো না?
-"সে কথা আমি কি করে বললাম?"
-"তুমি এত রাতে এখানে কেনো?"
-"রাত উপভোগ করতে এসেছি।"
-"হুম।তোমার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিয়েছ?"
-"হুম।ফুল মার্ক পেয়েছি।ধন্যবাদ আমাকে।"
-"হুম।"

এরপর কেটে গেলো কিছু সময় নীরবতায়।দুজনেই চুপ হয়ে গেলো।
ভাবতে লাগলো কে কাকে কি বলবো? 
দুজনের একবার চোখাচোখি হলো।
মুনতাসীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জড়ো হলো উফ কি একটা অবস্থা।
মুনতাসীর স্বাভাবিক ভাবে বলল,,
-"কাল তো ফুপুর।"

-"হুম মনে আছে।এই দিনেই তো আম্মা আমাকে একা রেখে চলে গেলো।"
-"দুঃখিত আমি তোমাকে।"
-"আপনি দুঃখিত বলছেন কেনো?এটা তো আর কোনো মিথ্যা কথা নয়।
এই যে দেখুন সময় কতো দ্রুত চলে যায়। 
আম্মা আমাকে রেখে চলে যাওয়ার এতো গুলো বছর চলে গেলো।"
-"হুম। সময় কখন চলে যায় বুঝাই যায় না।"
-"জীবনে বাবা মা খুব গুরুত্ব পূর্ণ একটা জায়গা জুড়ে বসবাস করে তাই না?"
-"হুম।"
-"বাবা হচ্ছে বট বৃক্ষ যে ছায়া দেয়।আর মা হলো যে কোনো পরিস্থিতি তে ঢাল হয়ে যায়।
কি সুন্দর বাবা মা আমাদের আগলে রাখে।তাই না?"
-"তা একদম ঠিক।এই দুই মানুষের ঋণ চাইলেও সিধ করা যাবে না।"
-"মুনতাসীর ভাই।
-"হুম।"

-"আপনি খুব লাকি আপনার মা আছে।জানেন যার মা আছে দুনিয়াতে তার সব কিছু আছে।
যার মা নেই তার কেউ নেই।"
এবার উপমার কন্ঠ বেশ নিচু হয়ে গেলো।
হয়তো মেয়েটা করছে। 
অন্ধকার রাতে তা দেখা না গেলেও মুনতাসীর ঠিক বুঝতে পারছে
যে মেয়েটার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু কি করবে মুনতাসীর?আচ্ছা সে যদি একবার উপমার চোখের জল মুছে দিতে পারতো।
একবার মেয়েটাকে বুকে আগলে নিতে পারতো!
মেয়েটার হাত শক্ত করে ধরে বলতে পারতো "আমি আছি তো।
"আমি আছি তো তোমার পাশে আজীবনের জন্য"
কিন্তু না সে আর তো সম্ভব নয়।তাই মুনতাসীর ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,,
-"সবাই আছে তো তোমার সাথে।"
-"আমি নিচে যাচ্ছি।"

বলেই উপমা দু কদম দিলো।সে তো ভেবেছিল হয়তো মুনতাসীর তাকে বলবে যে আমি আছি।
কিন্তু না উপমা বার বার একটু বেশি এক্সপেক্ট করে ফেলে। 
অথবা আরও কিছুক্ষণ পাশে থাকার কথা তো বলতে পারতো।
কিন্তু না কিছুই বললো না।
উপমা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
মুনতাসীর ছাদের রেলিং এ উপর হাত রেখে আনমনে বলে উঠলো,,
-"তোমার কাজল কালো আঁখির জল হোক আমার
তোমার সকল দুঃখ হোক আমার।
তোমার হৃদয়ের ব্যাথা হোক আমার
তোমার দুঃখে ভরা প্রতিটা নিঃশ্বাস হোক আমার।
তোমার সকল দুঃস্বপ্ন হোক আমার
বিনিময়ে শুধু একটাও চাওয়া।
তুমি যেনো হাসতে থাকো বারংবার
তুমি যেনো আমার হও শতবার।"

চলবে...
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url