মুনতাসীর ও উপমার বিচ্ছেদ । পর্ব - ০১



যে থালি তে এতদিন খেলে সেই থালি এখন ফুটা করতে চাইছো?
মামীর এমন প্রশ্নের কিছুটা অবাক হলো উপমা।সবে মাত্র রাতের খাবার গুলো গুছিয়ে টেবিলে থেকে কিচেনে নিয়ে রাখছিল।তবে মামীর এমন কথায় কিছুটা অবাক হয়ে যায় সে।হাতে থাকা কাচের গ্লাসটা ধুপ করে নিচে পড়ে যায়। মামীর দিকে এক পলক তাকিয়ে উপমা আমতা আমতা করতে করতে বলল,,
-”আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না মামী।”
-”বুঝতে পারছো না নাকি বুঝতে চাইছো না।”
খানিকটা রূঢ় কন্ঠে বলল মোর্শেদা বেগম। উপমা এবার ভ্রু কুঁচকে বলল,,
-”মামী আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।আপনি যে রকম বিষয়টা মনে করছেন বিষয়টা আসলে তেমন না।”

-”তাহলে কেমন?নাহ মানে তুমি আমাকে বুঝিয়ে বলো আমি তোমার কথা শুনছি।”
উপমা কি বলবে ভেবে পেলো না।মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। মোর্শেদা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,,
-”শুনো তুমি কিন্তু নিজের অবস্থান ভুলে যেও না।তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছো তাও ভুলে যেও না।তুমি কি ছিলে তাও ভুলে যেও না।”
-”মামী আমি”
-”আমার কথা শেষ হয় নি। শুনো তুমি হয়তো আগের কথা ভুলে গিয়েছ।তাই তোমায় একটু মনে করিয়ে দিলাম।আশা করছি তোমাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।”
-”হুম।”
-"শুনো তোমাকে আমি খুব স্নেহ করি তাই আশা রাখছি এমন কোনো কাজ করবে না যা আমাদের সম্পর্ককে স্রোতের উল্টো দিকে নিয়ে যাবে।"
-"হুম মামী।"

-”নিজের রুমে চলে যাও।”
উপমা নিজের পা চালিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে চলে এলো।চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল গুলো ওড়না দিয়ে মুছে নিল।তার খাটের পাশে রাখা বেড সাইড টেবিল থেকে তার বাবা ও মায়ের ছবির ফ্রেম হাতে নিল। ছবিতে হাত বুলিয়ে দিল।
উপমার মা বড় হয়েছে এই বাসায়।
উপমা শুনেছে তার মাকে দাদু অর্থাৎ মুনতাসীর ভাইয়ের দাদুর কাছে সপে দেয়া হয়েছে।
উপমার মা ছিল বেশ গরীব ঘরের মেয়ে তাই মুনতাসীর দাদু অর্থাৎ আয়শা খাতুন নিজের কাছে রেখে দেন উপমার মাকে। 

নির্দিষ্ট একটা বছর পর বিয়ে ও দেন তিনি।সুষ্ঠ ভাবে বিয়ে হয়। 
সংসার ও হয়। উপমা ও হয়।বেশ আদরে বড় হয় উপমা।বাবার জান ছিল সে।
একটা জিনিস চাইতে দেরি কিন্তু উপমার সামনে হাজির হতে দেরি হতো না।
বাবার একমাত্র রাজকন্যা বলে কথা।কিন্তু ওই যে সুখ বেশি দিন থাকে না।
উপমার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিছু দিনের মাঝেই বাবা ছেড়ে চলে যায়।
এর পর শুরু হয় দুঃখের দিন।উপমার মাকে তার ফুপু , চাচা কেউ দেখতে পারতো না।
ওই যে একেতো গরীব ঘরের মেয়ে দ্বিতীয়ত অন্যের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। 
বিয়ে টা নাকি হয়েছিল উপমার বাবার কারণে।নাহলে কি এমন মেয়েকে কেউ ঘরে তোলে নাকি?
 এর পর তাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার শুরু হয় এবং শেষ হয় তাদের বাড়ি থেকে বের করার মাধ্যমে।সেই আবার ঠাঁই হয় এই বাড়িতে।ভালো ভাবেই চলতে থাকে সব। 

উপমাও ভেবেছিল এবার সব ঠিক হবে কিন্তু শেষে মাও উপমাকে ছেড়ে চলে।
ওই যে কার হায়াত কত টুকু সে তো আর বলা যায় না।
মুহূর্তেই যেন উপমা ভেঙে পড়ে।বয়স তেরো বছর।
এই তেরো বছরে বাবা মা দুজনকে হারিয়ে ফেলল সে।
তবে নিজের মন বল শক্তি করলো।তবে এটা বেশ ভালো আছে সে এখানে।
 কবির ভূঁইয়া বেশ ভালো মানুষ ।একদম নিজের ভাগ্নির মত আদর করেন উপমাকে।
 মোর্শেদা বেগম ও বেশ ভালো ব্যবহার করে।
তবে ইদানিং তার ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করছে উপমা।
মানুষের মন বলে কথা।যেই হোক এই বাড়িতে তাকে থাকতে দিয়েছে এটাই বড় বিষয়।
বেশ ভালো আছে সে এখানে।

আর এই যে টুক টাক কাজ করে তা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়।
 পুরো পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকলে ব্যাপারটা কিন্তু ভীষণ খারাপ দেখায়।
-’উপমা আপু আজ তুমি কফি বানাবে না ?”
কারো কণ্ঠে ঘোর কাটে উপমার।কোনো রকমে চোখের জল মুছে নেই।
তাকিয়ে দেখে মিতি দাড়িয়ে আছে।তার মামাতো বোন।
-”কোথায় হারিয়ে গেলে উপমা আপু?”
-”কোথাও না।আচ্ছা আজ তুই একটু বানিয়ে দে না ।
আমার আজ ভালো লাগছে না।”
-”কেনো? শরীর খারাপ নাকি?”
-”তেমন কিছু না।মাথা ব্যাথা করছে।বেশী খারাপ লাগলে নাপা খেয়ে নিবো।”
-”হুম আছেই তো এক জাতীয় ওষুধ।তুমি যখন মন চায় নাপা খেতে থাকো।
না জানি কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলো তুমি।”
-”আমি নিজেই তো অঘটন আর কি অঘটন ঘটাবো বল?”

-”তুমিও না।আচ্ছা আমি যাই।”
-'আচ্ছা। গুড নাইট।"
মিতি চলে গেলো।উপমা বিছানায় শুয়ে পড়লো।
কি হবে এতো কিছু চিন্তা করে?শুধু শুধু মাথা ব্যাথা আরো বেড়ে যাবে।

মুনতাসীর মাত্র বসেছে অফিসের প্রজেক্ট কমপ্লিট করতে।
পেশায় সে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।মাথার উপর বেশ চাপ।
তাই সকল চাপ দূর করতে রাতের বেলায় কফি যেনো যথেষ্ট তবে তা হতে হবে উপমার হাতের।
মুনতাসীর এর প্রায়ই সময় কফি খেতে হয় শুধূ মাত্র চোখ দুটো খুলে রাখার জন্য।
এইযে এতো এতো প্রজেক্ট যে রাতে বেলা কমপ্লিট করতে হয়। 
মুনতাসীর আগে নিজের কফি নিজে তৈরী করে নিতো।
কিন্তু একদম মিতির কাছে শুনলো যে উপমা বেশ ভালো কফি করতে পারে
সেদিন সে উপমার হাতের কফি খেলো।
এবং এর পর থেকে যখন ই কফির প্রয়োজন হয় তখন উপমাকে বলে দিলে কফি দিয়ে যায়।
আজ ও ভেবেছিল যে উপমা কফি নিয়ে আসবে কিন্তু যখন না নিয়ে এলো 
তখন মিতিকে দিয়ে খোঁজ করতে পাঠালো।
কিন্তু মিতি যে কফি নিয়ে আসবে তা সে ভাবে নি।
তাই ভ্রু কুচকে মিতির দিকে তাকিয়ে বলল,,

-”তুই যে?উপমা কোথায়?”
-”আপুর নাকি শরীর ভালো লাগছে না।।”
-”ওহ।আচ্ছা কফি রেখে যা।”
মিতি ও কথা মতো কফি রেখে চলে গেলো। 
মুনতাসীর কিছু একটা ভেবে আর কাজ করলো না।
কফির মগ হাতে নিয়ে ডিভানে হেলান দিয়ে বসলো।
এক সিপ কফি নিয়ে চোখ বন্ধ করলো।
ছোট থেকেই ছিচ কাদুনি উপমা।একটু এদিক সেদিক হলেই কেঁদে কেটে অস্থির।
অবশ্য একটু তো আলহাদি হবেই।এতো আদরে যে বড় হয়েছে।
তবে এই কান্নাকে খুব বেশি বিরক্ত লাগতো মুনতাসীরের।
একটু কিছু হলেই কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিবে।
এটা কোনো কথা কিন্তু সেদিন ফুপা মারা গেলো 
সেদিন তো উপমার কাদতে কাদতে অবস্থা খারাপ হয়েছিল তার চেয়ে 
বরং যেদিন ফুপি মারা গিয়েছিল সেদিন যেনো মেয়েটা পুরো পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিল। 
শোকে এতো তাই কাতর হয়ে গিয়েছিল যে মুনতাসিরের কলেই ঢলে পড়ে।
সেদিন খুব বেশি মায়া হয় উপমার জন্য।
তার পর থেকেই ক্রমে ক্রমে অন্যরকম এক অনুভূতি তৈরি হয় উপমার প্রতি। 

বয়স বাড়ে ,, 
সময় গড়ায়,এই মাঝে তো বিলেতে ও চলে যায় ডিগ্রি নেয়ার জন্য। 
মুনতাসীর ভাবে হয়তো এগুলো সব বয়সের দোষ। 
কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু না সময়ের সাথে উপমার প্রতি তার অনুভূতি আরো প্রখর হয়।
কিন্তু সমস্যা হলো একটাই যে, অনুভূতি গুলো সে উপমার সামনে প্রকাশ করতে পারে না।
কি এক যন্ত্রণা।একটুও ভালো লাগে না।
কথা গুলো ভেবে মুনতাসীর বির বির করে বলে,,
-“প্রেমে পড়ার যন্ত্রণা এক ভয়ংকর যন্ত্রণা।
এই যন্ত্রণায় হৃদয় হয় ব্যাকুল ও মস্তিষ্ক হয় বিভোর।"

চলবে...
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url