অন্তরের সেতু
একটি ছোট শহরে দুটি পরিবার বাস করত। শহরের এক প্রান্তে ছিল রাজীব, একটি গরিব পরিবারে বেড়ে ওঠা এক যুবক। তার বাবা মাধব, একজন কৃষক, মা শ্রীমতী, একজন গৃহিণী, আর তার ছোট ভাই রবি। রাজীবের সংসার ছিল সাদামাটা, তবে তারা একে অপরকে ভালোবাসত, সুখে ছিল। তার স্বপ্ন ছিল একদিন নিজের খামার তৈরি করবে, এবং পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে। কিন্তু রাজীবের হৃদয়ে একটি ক্ষণস্থায়ী আকাঙ্ক্ষা ছিল—সেখানে কিছু ছিল, যা তাকে একটু বেশি আকর্ষণ করত, তার চেয়ে বেশি কিছু চাইত।
অন্যদিকে, শহরের আরেক প্রান্তে ছিল অন্নপূর্ণা, একটি ধনী পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তার বাবা, সুবীর, ছিলেন একটি বড় ব্যবসার মালিক, আর মা, মায়া, ছিলেন একজন সমাজসেবী। অন্নপূর্ণা ছিল সুন্দরী, শিক্ষিত এবং সমাজের প্রতি তার অনেক দায়িত্ব ছিল। তবে, তার জীবন ছিল একঘেয়েমি আর সীমাবদ্ধতার মধ্যে। বড়লোকের মেয়ে হিসেবে তার জীবনে এমন কোনো সঙ্গী ছিল না, যে তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসবে। সেদিন এক ঘটনা ঘটেছিল যা অন্নপূর্ণার জীবন বদলে দিতে যাচ্ছিল।
রাজীবের সঙ্গে অন্নপূর্ণার প্রথম দেখা হয় একটি ত্রাণ কার্যক্রমের সময়। শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বড় বন্যার পর মানবিক সহায়তার জন্য অনেক পরিবার একত্রিত হয়েছিল। রাজীব একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিল, এবং অন্নপূর্ণাও তার পরিবারের পক্ষ থেকে সহায়তা দিতে এসেছিল। প্রথমেই চোখে পড়েছিল রাজীবের তীব্র আত্মবিশ্বাস এবং তার কাজের প্রতি ভালোবাসা। রাজীব যখন এক হাতে বাচ্চাদের খাবার বিতরণ করছিল, তখন অন্নপূর্ণার দিকে তার চোখ পড়েছিল। প্রথম দেখাতেই অন্নপূর্ণা অনুভব করেছিল, রাজীবের মধ্যে কিছু বিশেষ ছিল, যা তার জীবনে এতদিনের অভাব ছিল।
অন্নপূর্ণা একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে রাজীবের দিকে তাকাল। রাজীব কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছিল, কারণ সে জানত, তার জীবন আর অন্নপূর্ণার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। সে ছিল একটি গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা যুবক, আর অন্নপূর্ণা ছিল একটি ধনী পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তবে কিছু একটা ছিল, যা তাদের দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক সৃষ্টি করতে যাচ্ছিল।
দিন কাটতে থাকে, আর একে অপরের দিকে তারা অনবরত আকর্ষিত হতে থাকে। রাজীব এবং অন্নপূর্ণার মধ্যে এক ধরনের অবর্ণনীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজীব যখন শখের খামারের জন্য কাজ করত, তখন অন্নপূর্ণা তার পাশে এসে দাঁড়াত। তারা একসাথে গাছপালা লাগাত, নদীর ধারে হাঁটতে যেত। অন্নপূর্ণা রাজীবের সঙ্গে তাদের সহজ, নিরলস জীবন কাটাতে ভালোবাসত। রাজীবের কাছে সে পেত তার জীবনের এক অদ্ভুত শান্তি, যে শান্তি সে কখনো তার ধনী পরিবারে পায়নি।
একদিন, শহরের গৃহশিক্ষকরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। সেখানে রাজীব এবং অন্নপূর্ণার দেখা হয়, এবং তাদের মধ্যে আরও নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। রাজীব তার স্বপ্নের কথা বলেছিল, কীভাবে সে তার পরিবারের জন্য একটি বড় খামার বানাতে চায়, এবং কীভাবে সে গরিবদের জন্য কাজ করতে চায়। অন্নপূর্ণা তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, এবং সে অনুভব করে, রাজীবের মধ্যে একটি প্রকৃত সত্যতা আছে, যা তার নিজের জীবনে খুবই অভাব।
একদিন অন্নপূর্ণা রাজীবকে একটি নতুন প্রকল্পে সাহায্য করার প্রস্তাব দেয়, যেখানে তারা দুজনে একত্রে কিছু মানুষের জন্য কাজ করবে। রাজীব প্রথমে সন্দেহে ছিল, কারণ তাকে মনে হয়েছিল অন্নপূর্ণার জীবন তার থেকে অনেক দূরে, অনেক উচ্চতায়। তবে অন্নপূর্ণা তাকে আশ্বস্ত করে, যে তার পরিবারের অর্থ এবং প্রভাব তার জন্য একমাত্র বড় ব্যাপার নয়, বরং মানুষের জন্য কাজ করাই তার আসল উদ্দেশ্য। তাদের মধ্যে সেই দিন থেকে এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, এবং সেই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে এক গভীর ভালোবাসায় পরিণত হয়।
সময়ের সাথে সাথে, রাজীব ও অন্নপূর্ণার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক আরো জোরালো হয়ে ওঠে। তারা একে অপরকে নতুনভাবে জানতে থাকে, নিজেদের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেয়। একদিন, রাজীব অন্নপূর্ণাকে একটি ছোট্ট বাগানে নিয়ে যায়, যেখানে তারা প্রথমবার একসাথে হাঁটতে গিয়েছিল। সেই বাগানে রাজীব তার মনের কথা খুলে বলেছিল।
"অন্নপূর্ণা, আমি জানি, আমাদের জীবন অনেক আলাদা। তুমি পৃথিবীর সব কিছু পেতে পার, আর আমি কিছুই নই। কিন্তু আমি জানি, তুমি যদি আমার সঙ্গে থেকো, তাহলে আমি পৃথিবীকে জয় করতে পারব।"
অন্নপূর্ণা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে তার হাত ধরেছিল। "রাজীব, তুমি জানো, আমি সব কিছুই পেয়েছি। তবে আমার জীবনে একমাত্র অভাব ছিল—একজন মানুষের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক। তুমি আমাকে সেই সম্পর্কটা দিতে পারো। আমি তোমার পাশে থাকবো, জীবনভর।"
তাদের মাঝে এক গভীর অঙ্গীকার হয়েছিল। কিন্তু, সমাজের চাহিদা, পরিবার এবং পরিস্থিতি তাদের সম্পর্কের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্নপূর্ণার বাবা সুবীর প্রথমে তাদের সম্পর্ক মেনে নিতে চাননি, কারণ রাজীব ছিল একটি গরিব পরিবারের ছেলে। তিনি মনে করতেন, তাদের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই সফল হতে পারবে না। তবে, অন্নপূর্ণা তার বাবাকে বুঝাতে সক্ষম হয়, যে সত্যিকারের ভালোবাসা কোনো দানে বা শ্রেণিতে সীমাবদ্ধ নয়।
একসময়, সুবীর তার মেয়ের ভালোবাসার পক্ষে সায় দেন, এবং রাজীবের সাথে এক গভীর আলোচনা করেন। রাজীব প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সুবীর তাকে এক সুযোগ দেয়, এবং বলে, "যদি তুমি আমার মেয়ের সুখের জন্য যথাযথ দায়িত্ব নিতে পারো, তবে আমি তোমাদের সম্পর্ক মেনে নেব।"
রাজীব বুঝতে পারে, তাকে শুধুমাত্র অর্থের জন্য নয়, বরং নিজের কর্ম এবং মনোভাবের জন্য প্রমাণ করতে হবে। তার জন্য কাজ শুরু হয়ে যায়, একদিকে সে তার খামার তৈরি করছিল, অন্যদিকে সে গরিবদের জন্য সাহায্য করতে ছিল। তার চেষ্টা এবং নিষ্ঠা তাকে সফলতা এনে দেয়। একসময়, রাজীব তার পরিবারের জন্য একটি সুন্দর খামার তৈরি করে, এবং ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান তৈরি করে।
অন্নপূর্ণা এবং রাজীবের সম্পর্ক এক দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। তারা একে অপরকে ভালোবাসায় পূর্ণ করে তোলে, এবং তাদের জীবনের পথচলা কখনোই একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তারা বুঝতে পারে, সমাজের চোখে অবস্থান কোনো ব্যাপার নয়, সত্যিকার ভালোবাসা এবং মনোভাবই সবচেয়ে বড়।
অন্তত, তাদের প্রেমের গল্পটি এক নিখাদ এবং অনুপ্রেরণামূলক অধ্যায়ে পরিণত হয়, যেখানে প্রমাণিত হয়, প্রেম কোনো শ্রেণির বিষয় নয়, এটি এক অদৃশ্য সেতু, যা মানুষের অন্তরকে সংযুক্ত করে।
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com