পুষ্টিগুণে ভরপুর শজনে পাতা খাওয়ার নিয়ম


আসলে সজনে পাতাকে এখন বলা হচ্ছে অলৌকিক পাতা। বিজ্ঞানীরা সজনে পাতাকে বলছেন অলৌকিক পাতা। কেন? এত কিছু থাকতে সজনে পাতাকে অলৌকিক পাতা বলা হচ্ছে কেন? সজনে পাতার যে ফুড ভ্যালু (খাদ্যমান), এর নিউট্রিশন (পুষ্টি), এর কনটেন্ট যেকোনো মানুষকে বিস্মিত করবে। সে কারণেই বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন যে, এ সময়ের একটি অলৌকিক পাতা হচ্ছে সজনে পাতা।

সজনে পাতা, যা ইংরেজিতে “Moringa Leaves” নামে পরিচিত। সজনে গাছ (Moringa oleifera) হলো এক ধরনের শাকজাতীয় উদ্ভিদ যা মূলত দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এই গাছের পাতা, ফুল এবং ফল সবকিছুই খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু পাতাগুলো বিশেষভাবে জনপ্রিয়। একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর সবজি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশে, সজনে পাতা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি জনপ্রিয় খাদ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সজনে পাতার জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী বেড়েছে। উন্নত দেশগুলিতেও এটি ‘সুপারফুড’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা এটি বিভিন্ন খাদ্যে সংযোজন করছেন। সজনে পাতার পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতার জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। এই প্রবন্ধে আমরা সজনে পাতার উপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম ও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে এর ভূমিকা সম্পর্কে জানব।

দুধের প্রায় সমান পুষ্টি

এটি (সজনে পাতা) যদি তুলনা করেন কোনো খাবারের সাথে, তাহলে আমরা সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি খাবারের সাথে তুলনা করতে পারি। সেটি হচ্ছে গরুর দুধ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গরুর দুধের পুষ্টি এবং সজনে পাতার পুষ্টি অলমোস্ট কাছাকাছি। আমরা উপমহাদেশে বা বাংলাদেশে গরুর দুধ কেন খাই, কিসের জন্য খাই? মূলত কী লক্ষ্যে খাই? গরুর দুধ আমরা খাই মূলত ক্যালসিয়ামের জন্য, প্রোটিনের জন্য, আমিষের জন্য। গরুর দুধ খেয়ে আমরা বলি, এটা একটা সুষম খাবার।

গরুর দুধ এবং সজনে পাতার মধ্যে পুষ্টিগত কোনো পার্থক্য নাই। গরুর দুধে যা আছে, সজনে পাতাতেও তা আছে। যে লক্ষ্যে আমরা মূলত গরুর দুধ খাই, সে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম আছে সজনে পাতায়। পর্যাপ্ত আমিষও আছে।

পুষ্টিবিদের ভাষ্যমতে

শজনে পাতা বা মরিঙ্গার উপকারিতা ও খাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে জানিয়েছেন মিরপুর ইসলামী ব্যাংক অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারের পুষ্টিবিদ তাসরিয়ার রহমান। তিনি জানান, শজনে পাতার মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণে খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন। পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এগুলো ছাড়াও প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটও আছে এতে। অনেকগুলো পুষ্টি একসঙ্গে থাকার কারণে এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

সজনে শাকের উপকারিতা কী কী?

প্রতি গ্রাম সজনে পাতায় একটি কমলার চেয়ে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও দুই গুণ বেশি প্রোটিন, গাজরের চেয়ে চার গুণ বেশি ভিটামিন এ এবং কলার চেয়ে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম বিদ্যমান। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা সহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতি জনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

সংরক্ষন পদ্ধতি

শজনে পাতার পাউডার – সজনের তাজা পাতাগুলি ছায়ায় শুকিয়ে নিন প্রথনমে। সরাসরি সূর্যের আলোতে এগুলি শুকাতে যাবেন না কারণ এটি মরিঙ্গা পাতার পুষ্টির মান হ্রাস করবে। শুকিয়ে গেলে মিহি গুঁড়ো করে নিন।

শজনে পাতার রস- তাজা পাতা পেস্ট করে তারপর ব্যবহারের জন্য রস বের করা হয়। বাজার বা অনলাইন থেকে সজনে পাউডার এবং সজনে পাতার জুস পেতে পারেন।

শজনে পাতার পুষ্টিগুণ

  • এটি রোগ প্রতিরোধে সহযোগিতা করে।
  • হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। পুরুষদের টেস্টোস্টেরন হরমোন বাড়াতে সাহায্য করে।
  • প্রদাহনাশক হিসাবে কাজ করে অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন ব্যথা দূর করে।
  • পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা যেমন খাবার সহজে হজম না হওয়া, পেটে অতিরিক্ত গ্যাস জমে থাকা, বুকজ্বালা ইত্যাদি সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
  • হাড় ও দাঁতের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। শজনে পাতায় প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস রয়েছে, যা দাঁত ও হাড়ের গঠনের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
  • কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য সাহায্য করে।
  • শজনে পাতাতে রয়েছে ভিটামিন সি, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি ত্বকে বয়সের ছাপ দ্রুত পড়তে দেয় না।
  • শজনে পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ, যা চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
  • শজনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল যৌগ রয়েছে। ত্বকের সংক্রমণ, মূত্রনালী সংক্রমণ এবং হজমের সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে এটি।
  • শজনে পাতার গুড়া ওজন কামাতে সাহায্যে করে: শজনে পাতায় প্রচুর ফাইবার থাকে এবং এতে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড থাকে, যা স্বাভাবিকভাবে ওজন কমাতে ও শরীরে জমে থাকা চর্বি কমাতে সাহায্য করে। তাই ওজন কমানোর জন্য শজনে-চা খুব উপকারী ভূমিকা পালন করে। শজনেপাতায় ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন ই ইত্যাদি থাকে, যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
  • শজনে পাতা খেলে প্রেসার কমে যায়: শজনে পাতা প্রদাহজনিত সমস্যা নির্মূল করতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সজনেপাতা। কারণ, এই পাতার মধ্যে পটাশিয়াম রয়েছে যথেষ্ট মাত্রায়। তা ছাড়া, এই পাতায় যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি যৌগ থাকায় তা সামগ্রিক ভাবে হৃদ্‌যন্ত্র ভাল রাখতে সাহায্য করে।
  • রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে: হাইপোগ্লাইসেমিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে মরিঙ্গাতে। এ উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সক্ষম। এছাড়া সজনে পাতায় বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ রয়েছে যা ইনসুলিন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে সাহায্য করে। তাই বলা হয়ে থাকে, নিয়মিত মরিঙ্গা বা সজনে পাতা গুড়া গ্রহণ করলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপকার হতে পারে।

কোন রোগের জন্য সজনে পাতা বেশি উপকারি

মরিঙ্গা চা বেশ কিছু রোগের জন্য উপকারী বলে বিবেচিত হয়। এগুলো হলো:

  • ডায়াবেটিসঃ মরিঙ্গা চা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এটি শরীরে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের মত কঠিন রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে।
  • উচ্চ রক্তচাপঃ এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • হৃদরোগঃ মরিঙ্গা চা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে, যা মানবদেহে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
  • আর্থ্রাইটিস: অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য থাকায় মরিঙ্গা চা জয়েন্টের ব্যথা ও ফোলা কমাতে সহায়ক। অবশতা ও সায়াটিকা প্রতিরোধে সজিনার চা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এর বীজের তেল মালিশ করলে চর্মরোগ দূর হয়।
  • লিভার ও কিডনিঃ মরিঙ্গা চায়ে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল কার্যকারিতা থাকায় এটি লিভার ও কিডনি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
  • পাচনতন্ত্রের সমস্যাঃ মরিঙ্গা চা হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।
  • অ্যানিমিয়াঃ মরিঙ্গা চা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সহায়ক।
  • ইন্টেস্টাইন ও প্রোস্টেট সংক্রমণঃ সজিনা চা এই সমস্ত রোগের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে।
  • গর্ভকালীন অসুস্থতাঃ গর্ভবতী ও প্রসূতিদের জন্য সজনেপাতা খুবই উপকারী। এটি গর্ভকালীন অসুস্থতা, যেমন মাথা ঘোরানো ,বমি বমি ভাব ,খাবারে অরুচি প্রভৃতি সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া নিয়মিত মরিঙ্গা চা খাওয়া হলে তা মায়ের দুধ উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url