কম বাজেটে ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া ট্যুর । অল্প টাকায় ঘুরে আসুন মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়াতে বাজেট ফ্রেন্ডলি একক ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন? তাহলে এই ব্লগটি আপনার জন্য। আজ আমি আপনাদের সাথে আমার ঢাকা থেকে শুরু হওয়া ৬ দিনের মালয়েশিয়া সলো ট্যুরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। এই ট্রিপের মোট বাজেট ছিল মাত্র ১৫,০০০ টাকা, যেখানে আমি মালাক্কা, পেনাং এবং কুয়ালালামপুরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান ঘুরে দেখেছি। আসুন, আমার এই যাত্রার প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে জানি।
মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি ও ভিসা প্রসেস
মালয়েশিয়া ভ্রমণের জন্য প্রথমেই আপনাকে একটি ভিসার প্রয়োজন হবে। আমি একটি অথরাইজড এজেন্সির মাধ্যমে ই-ভিসা করিয়েছিলাম, যার খরচ ছিল ৪,০০০ টাকা এবং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে চার দিন সময় লেগেছিল। মালয়েশিয়ান ই-ভিসা সাধারণত ইমেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়, যেটি প্রিন্ট আউট করে পাসপোর্ট ও এয়ার টিকেটের সাথে নিয়ে যেতে হয়। আমার ভিসাটি ছিল সিঙ্গেল এন্ট্রি এবং ছয় মাসের মেয়াদী।
ফ্লাইট বুকিংয়ের জন্য আমি এয়ার এশিয়ার ২:৩০ টার রাতের ফ্লাইটে যাত্রা করেছিলাম, যা ঢাকা থেকে গো জায়ানের মাধ্যমে ছিল। ফ্লাইটের খরচ ছিল ২৭ হাজার টাকা। আমি সবসময় সহজ ও দ্রুত বুকিংয়ের জন্য গো জায়ান অ্যাপ ব্যবহার করি, যেখান থেকে শুধু ফ্লাইট নয়, হোটেল ও বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিও বুক করা যায়। নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য আমি SY500 কুপন কোড ব্যবহার করার পরামর্শ দিব, যার মাধ্যমে ৫০০ টাকা ছাড় পাওয়া যায়।
যাত্রা শুরু: বিমানবন্দর থেকে মালাক্কা
রাত ১০ টায় বাসা থেকে বের হয়ে তিন ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছানো উচিত, যাতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ঝামেলা এড়ানো যায়। প্লেনে ওঠার পর আমি বুঝতে পারলাম যে পুরো প্লেনে আমি একমাত্র একক ভ্রমণকারী মেয়ে। আমার খাবার আগেই বুক করা ছিল, যা প্লেনে বেশ ভালো ছিল।
সকালবেলা মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে অবতরণ করে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর আমি প্রথম কাজ করলাম মানি এক্সচেঞ্জের, যেখানে ডলার রেট ছিল ২৬ রিঙ্গিত। এয়ারপোর্ট থেকে নেটওয়ার্ক সমস্যা থাকার জন্য আমাকে একটি সিম কিনতে হয়।
এয়ারপোর্টের সামনে থেকে মালাক্কা যাওয়ার বাস পাওয়া যায়, যেটির ভাড়া ছিল মাত্র ২৪ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ৬৪৮ টাকা)। বাসের মান এবং রাস্তাঘাট খুবই সুন্দর এবং পরিষ্কার ছিল। মালাক্কা যেতে সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘন্টা।
মালাক্কা: ঐতিহাসিক শহরের একদিন
মালাক্কা সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছে আমি দ্রুত গ্র্যাব কল করে হোস্টেলে পৌঁছলাম, যা মাত্র ৩৮৫ টাকায় (বাংলাদেশি) বুক করা ছিল। এই হোস্টেলটি ছিল ডিসকাউন্টে, সাধারণত দাম হয় ১৫০০-১৬০০ টাকা। যদিও আমি শুধু রাত কাটানোর জন্য হোস্টেলটি নিয়েছিলাম, তবে ওভারঅল পরিবেশ এবং লোকজনের আচরণ আমাকে ভালো লেগেছিল।
মালাক্কা শহর এক্সপ্লোরেশন
হোস্টেল থেকে বের হয়ে প্রথমেই আমি কাছাকাছি একটি মনোরম টেম্পল দেখলাম, যেটি খুবই ভাইব্রেন্ট এবং শান্তিপূর্ণ ছিল। এরপর আমি একটি স্থানীয় রেস্টুরেন্টে ডাম্পলিং এবং সুপ খেয়ে নিলাম, যা ছিল বাজেট ফ্রেন্ডলি এবং সুস্বাদু।
পুরো শহরটি খুবই সাজানো ও পরিষ্কার, যেখানে ডাচ স্কয়ার বা "রেড স্কয়ার" আমার অন্যতম প্রিয় স্থান। এই স্কয়ারটি মালাক্কার ঐতিহাসিক শহরের একটি আইকনিক স্থান, যেখানে লাল রঙের টাওয়ার এবং ফাউন্টেন খুবই আকর্ষণীয়।
মালাক্কা ছিল ১৫০০ সালের দিকে একটি বড় ট্রেডিং হাব, যেখানে বিভিন্ন শাসকরা শাসন করেছিল। তাদের প্রভাব এখনও শহরের আর্কিটেকচারে স্পষ্ট।
রিভার ক্রুজ ও চায়না টাউন
মালাক্কা রিভার ক্রুজ ছিল আমার দিনের অন্যতম আকর্ষণ। ৩০ রিঙ্গিতে বড়দের টিকেট নিয়ে নদী পথে ঘুরতে পারা যায়, যেখানে বিভিন্ন ব্রিজ এবং রেস্টুরেন্ট দেখা যায়। বিকেলে নদীর পাশে অনেকেই ছবি তুলতে আসেন।
চায়না টাউন ছিল অন্যরকম এক জায়গা, যেখানে হাজার হাজার খাবারের দোকান রয়েছে। প্রতি শনিবার রাতে এখানে একটি নাইট মার্কেট বসে, যেখানে কম দামে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়। আমি বিকেল ৫-৬টার মধ্যে গেলে তুলনামূলক কম ভিড় পেতাম, যা অনেক সুবিধাজনক।
মালাক্কা সুলতান প্যালেস মিউজিয়াম
এটি ছিল একটি রেপ্লিকা, যা ঐতিহাসিক মালাক্কা শাসনের আর্কিটেকচার এবং জীবনযাত্রার প্রতিফলন ঘটায়। এখানে প্রবেশ ফি নেই এবং এটি দেখতে খুবই শিক্ষণীয়।
খাবার ও হোস্টেলের অভিজ্ঞতা
রাতে আমি একটি ভারতীয় রেস্টুরেন্ট থেকে গার্লিক নান এবং মাসালা চিকেন অর্ডার করেছিলাম, যা ছিল মাত্র ১০ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ২৭০ টাকা)। মালাক্কায় ট্রাফিকের কারণে গ্র্যাব ট্যাক্সি পাওয়া কঠিন হয়েছিল, তাই আমি দৌড়ে হোস্টেলে ফিরে আসি এবং সেখান থেকে বাস স্টেশনে যাই।
পেনাং: জ্বরের মধ্যেও এক নতুন অভিযাত্রা
পেনাং যাওয়ার জন্য আমি অনলাইনে ইজি বুক অ্যাপ থেকে বাস টিকেট কিনেছিলাম, যার দাম ছিল ৪০ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি ১০৮০ টাকা)। বাস সাড়ে পাঁচটায় পেনাং সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছায়, যেখানে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং আমি জ্বর নিয়ে ক্লান্ত ছিলাম।
স্টেশন থেকে হোস্টেলে যাওয়ার জন্য গ্র্যাব কল করলাম, যদিও ভাড়া একটু বেশি ছিল (৩৩ রিঙ্গিত)। হোস্টেলে পৌঁছে গেট বন্ধ থাকার কারণে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, তবে অবশেষে ঢুকতে পারলাম।
পেনাং হোস্টেলের সুবিধা
আমার হোস্টেলটি ছিল খুবই আরামদায়ক, যেখানে লকার, ফিল্টার করা পানি, রান্নাঘর, লন্ড্রি সুবিধা এবং কমপ্লিমেন্টারি খাবার পাওয়া যায়। এখানে সবাই বিদেশি ভ্রমণকারী ছিল এবং পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল।
আমি এখানে নিজে রান্না করতাম, কারণ বাইরে খাওয়া আমার বাজেটের বাইরে যেত। আমার প্রথম দিনের ব্রেকফাস্ট ছিল কফি ও কয়েকটি বিস্কুট, যা হোস্টেল থেকে ফ্রি পাওয়া গেছে।
পেনাং ঘুরে দেখা
জর্জ টাউনের রাস্তাগুলো খুবই সুন্দর এবং পরিষ্কার। এখানে অনেক সুন্দর স্ট্রিট আর্ট এবং গ্রাফিতি পাওয়া যায়, যা বিশ্বখ্যাত আর্টিস্টদের দ্বারা আঁকা। আমি অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে এসব দেখেছি এবং সেলফি নিয়েছি।
এছাড়াও পেনাংয়ের বড় বড় মন্দিরগুলো দেখে খুব ভালো লেগেছে, যেখানে প্রবেশ ফি নেই এবং শান্ত পরিবেশ পাওয়া যায়।
শপিং ও স্থানীয় জীবন
পেনাংয়ের স্ট্রিট শপগুলোতে বিভিন্ন রঙিন জামাকাপড় এবং জুতার দোকান আছে, যদিও দাম বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি। তাই আমি কিছুই কিনিনি।
আমি স্থানীয় সুপারশপ থেকে কিছু ফলমূল এবং ডিম কিনে হোস্টেলে রান্না করেছি। ফলগুলো বেশ মিষ্টি এবং অনেকে আমার কাছে নতুন ছিল।
যাত্রার উপসংহার ও পরবর্তী পরিকল্পনা
এই ৬ দিনের সলো ট্রিপের প্রথম অংশে আমি মালয়েশিয়ার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শহর মালাক্কা এবং পেনাং ঘুরে দেখেছি। প্রতিটি জায়গার নিজস্ব সৌন্দর্য, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাজেটের মধ্যে থেকে ভ্রমণ করাটা চ্যালেঞ্জিং হলেও এক্ষেত্রে পরিকল্পনা এবং ধৈর্য্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তী অংশে আমি কুয়ালালামপুরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, যেখানে আরও আকর্ষণীয় স্থান এবং খাবার আমাকে অপেক্ষা করছে।
যদি আপনি মালয়েশিয়াতে কম খরচে ভ্রমণ করতে চান, তাহলে এই ব্লগটি আপনার জন্য একদম উপযোগী। মনে রাখবেন, পরিকল্পিত বাজেট এবং সঠিক তথ্য থাকলে একক ভ্রমণও হতে পারে নিরাপদ, আনন্দময় এবং স্মরণীয়।
ট্রাভেল টিপস: বাজেট মালয়েশিয়া সফরের জন্য
- ভিসা করানোর জন্য অনুমোদিত এজেন্সি থেকে সাহায্য নিন অথবা নিজেই ই-ভিসা আবেদন করুন।
- গো জায়ান অ্যাপ ব্যবহার করে সহজে ফ্লাইট, হোটেল এবং অন্যান্য সার্ভিস বুক করুন।
- বিমানবন্দরে তিন ঘণ্টা আগে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন।
- চেক ইন ব্যাগে ফ্লেমেবল বা নিষিদ্ধ জিনিস রাখবেন না।
- স্থানীয় SIM কার্ড কিনে নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করুন।
- বাস ও গ্র্যাব ট্যাক্সির ভাড়া আগে থেকে যাচাই করে নিন।
- হোস্টেল বুক করার ক্ষেত্রে স্থানীয় ল্যান্ডমার্ক দেখে নিন।
- বাজেটের মধ্যে থাকার জন্য নিজে রান্না করার সুযোগ থাকলে সেটি কাজে লাগান।
- স্থানীয় খাবার ও সংস্কৃতি উপভোগ করুন, তবে ভিড় এড়িয়ে চলুন।
মালয়েশিয়া একটি ভ্রমণপ্রিয় দেশ, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার এক অনন্য মিশ্রণ পাওয়া যায়। আপনার পরবর্তী ছুটির গন্তব্য যদি হয় মালয়েশিয়া, তাহলে আমার অভিজ্ঞতা থেকে এই টিপসগুলো কাজে লাগাতে পারেন। শুভভ্রমণ!