Breaking News

হঠাৎ প্রাক্তনের সাথে দেখা সাথে তার বউ



প্রাক্তন হওয়ার গল্পে কখনও মিশে থাকে অভিমান, কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। অভিমানের দেয়াল ছাপিয়ে ভুলের পরিমাণটা যদি অনেকগুণ বেড়ে যায়, তবে সেই স্মৃতি হয়ে ওঠে আক্ষেপের জঞ্জাল। বহুবছর পর যদি স্মৃতিগুলো একটুকরো বাস্তবতা হয়ে দেখা দেয় আবার, চোখে চোখ রেখে কথা বলাও দুষ্কর হয়ে ওঠে। নিঃশব্দ চোখের জলও ভাষা হারায় প্রিয় মানুষটির কাছে।

শপিং করতে যাচ্ছিলাম। মন ভাল নেই। তাই হেঁটে হেঁটেই গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলাম। এটা আমার অভ্যেস। যখন খুব মন খারাপ হয়, আমি উদ্দেশ্যহীনের মতো হাঁটা শুরু করি যেদিকে দুচোখ যায়। মনে হয় পুরো পৃথিবীটাতো আমার একার। মনে হয় বাস্তবতার জাল ছিন্ন করে হারিয়ে যাবো একেবারে নিজস্ব রূপকথায়। যেখানে কেবল সবুজ অরণ্য কোলাহলে ঘেরা আর আমি সুখী রাজকুমারী। কি মনে করে থমকে দাঁড়ালাম। একটু দূরে ছোট একটা বেলপুরীর দোকান। একটা সময়ে বেলপুরীর জন্য কি পাগলটাই না ছিলাম! এখন ওসব আমায় আর টানে না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল পরিচিত মুখটায়। দূর থেকে চিনতেও বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না। এতগুলো বছর পর প্রাক্তনের সাথে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ হবে, তা কে ভেবেছিল!

বেশ হাসিখুশি একজোড়া কপোত-কপোতী। বিবাহিতই হবে। ছেলেটা নিজের হাতে বেলপুরী খাইয়ে দিচ্ছে মেয়েটিকে। মেয়েটা কেমন লাল হয়ে যাচ্ছে দেখ!

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। খেয়াল করলাম ছেলেটা আর কেউ নয়, আমার প্রাক্তন ভালবাসা। তন্ময় একটুও পাল্টায় নি। সেই হাসিখুশি, উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ছেলে হয়েই আছে।

আমি অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। হুশ ফিরতেই ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটাকে তখনও সে বেলপুরী খাওয়ায় ব্যস্ত। তাই হয়তো আমায় লক্ষ্য করেনি।

কেমন আছো তন্ময়!”
কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকালো আমার দিকে। কেমন একটা ইতস্তত ভাব। তারও আমায় চিনতে মোটেও কষ্ট হয়নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ” আরে অবন্তী, কেমন আছো তুমি! আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালই আছি।”

আমি ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম। সুন্দরী মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলাম, “কে ও? তোমার স্ত্রী বুঝি!”

ও ঘাড় না ফিরিয়েই বলল, “হুম। তোমার স্বামী কেমন আছে?”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, ভালোই।”

এমন সময় বিকট কণ্ঠে সেলফোনটা চিৎকার করে উঠলো।

আমি একপাশে সরে এসে ফোনটা তুললাম।

অবন্তী। তোমায় কতবার বলতে হবে যে কাজের সময় ফোন দিওনা। কেন ফোন দিয়েছিলে?!”
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, “তুমি কি একটু আসতে পারবে? ফুচকা খাবো তোমার সাথে। তারপর আমরা একসাথে ঘুরবো, সময় কাটাবো।”

প্রচণ্ড বিরক্তিমাখা কণ্ঠটা বলে উঠলো,
“এজন্য তুমি আমায় ফোন দিয়েছো! সমস্যা কোথায় তোমার! তোমাকে না কতগুলো টাকা দিলাম! ওগুলো দিয়ে যত ইচ্ছে ফুচকা খাও। আমায় কেন জ্বালাচ্ছো। ফোন রাখো। আর ফোন দিবানা।”

আমি অবাক হলাম না। কোনো অনুভূতিও হল না আমার। এসব শুনবো জেনেও আবদার করেছিলাম।
” শাকির, আজ তো শুক্রবার। ছুটির দিন। আজ একটু সময় বের করতে পারবেনা আমার জন্য!”জ্বলন্ত কণ্ঠটা বলে উঠলো, “তোমার এসব ন্যাকামো আমাকে দেখাতে আসবা না। আমি কাজ না করলে এত টাকা উড়াতেও পারতে না। খবরদার আর একবারও ফোন দিবা না।”

ফোনটা কেটে গেল। আজ রাতেও ও ফিরবেনা জানি। অযুহাত তো পেয়েই গেল একটা। আমার সাথে রাগ করেছে। এটাকে তো কাজে লাগাতেই হবে।

চোখের সামনে পুরোনো অ্যালবামটা হঠাৎ উন্মুক্ত হল। সেই পুরোনো দিনগুলো৷ কত সুখ, কত আদরের সাগরে ভেসেছিলাম আমি। অথচ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ওকে আমি প্রাক্তনের তালিকায় ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। ওত সুখ বোধয় সহ্য হয়নি আমার।

রোজই আমাদের দেখা হত। ভার্সিটি শেষে ঘুরতে বের হতাম শহরের ব্যস্ত রাস্তায়। যে রাস্তা আমাদের বরণ করে নিত সবসময়। আমি বায়না ধরতাম বাবল কিনে দেয়ার জন্য। আমার ছেলেমানুষী ওকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করতোনা। বরং ও আমার অবুঝ সত্তাটাকে ভীষণ ভালবাসতো।

টঙের দোকানের ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের গন্ধ আমার নাকে এখনও সেপ্টে আছে। চা খাওয়াটা সে আমাকে শিখিয়েছিল। কত বিকেল যে কেটেছে ওর সাথে চায়ের আড্ডায় সামিল হয়ে, তার ইয়ত্তা নেই।

আর আইসক্রিম! এ কথা ভুলবো কেমন করে! ঠাণ্ডা লেগে যাবে বলে আমায় আইসক্রিম খেতে দিতে চাইতো না। কত অভিমান করেছি! আমার অভিমান ভাঙাতে সে অনেক কিছু করতো। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা৷ শেষমেশ না চাইতেও আইসক্রিম কিনে দিত আমায়। আমি হাসি থামাতেই পারতাম না। আর ও আমার হাসিতে অকারণেই তাল মেলাতো।

কত পথ হেঁটেছি হাতে হাত রেখে। কত বিষন্ন বিকেল কাটিয়েছি গোধূলিকে সাক্ষী রেখে। আমাদের দীর্ঘ পথে শুকনো পাতারা বিছিয়ে দিত ভালবাসার গালিচা। আর আমরা মুগ্ধ হয়ে হেঁটে যেতাম উদ্দেশ্যহীনের মতো।

আমার সমস্ত কথা আমি ওকে বলতাম। যখন মন খারাপ হতো, ওর বিন্দুমাত্র সময় লাগতো না আমার মন ভাল করে দিতে। ও ছিল আমার ভাল থাকার প্রেরণা, আমার মুখে হাসি ফোটার কারণ। আমি কখনই পারিনি ওর উপর দীর্ঘ সময় অভিমান করে থাকতে।

আমাদের সময়টা ছিল রূপকথার মতো। প্রতিটা দিন কাটতো আনন্দময়, আর আমাদের গল্পে জুড়ে দিত নতুন একটা পৃষ্ঠা। কত নতুন নতুন অনুভূতিতে সাজতো আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত।

মাঝেমাঝে যদি দূরে কোথাও যেতে মন চাইতো, ও আমায় নিয়ে যেত। সমস্ত কোলাহলের বাইরে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। ওর বাইকে করে ও আমায় পুরো পৃথিবী ঘুরানোর স্বপ্ন দেখতো। আমিও চাইতাম, পৃথিবীর সমস্ত সবুজের সাথে পরিচিত হব দুজন মিলে।

ভাল সময়গুলো বোধয় খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়। ওর সাথে কাটানো সময়গুলো কেমন ধূসর হয়ে গেছে আজ। হাসিখুশি বর্তমানটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেদিন ৩ বছর আগের সেই অতীত হয়ে গিয়েছিল।

.তম্নয় আমার হাতটা শক্ত করে চেপে বলেছিল, আমায় শুধু বল। কেন তুমি এত সুন্দর সম্পর্কটা ভেঙে ফেলতে চাইছো!”

জবাবে বলেছিলাম, “আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।”

“আমি তাহলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই তোমার বাসায়?”

“তুমি প্রস্তাব নিয়ে যাবে! কোন সাহসে যাবে তুমি? কি আছে তোমার? করো তো একটা বেসরকারি চাকরি। বেতনের পরিমাণ তো মুখেও আনা যায় না। বাবা জানতে চাইলে কি উত্তর দিবে? যেই ছেলেটাকে বাবা ঠিক করেছে। সে তোমার মত হাজার হাজার লোক পালে৷ একটা প্রাইভেট কোম্পানির সিইও সে।”

“অবন্তী। আমরা দুজন দুজনকে ভালবাসি। এটা কি যথেষ্ট নয়! টাকা পয়সা তো আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের এত বছরের সম্পর্কটা নষ্ট করতে পারবে তুমি!”
তন্ময় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল৷ কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিল,

“টাকা পয়সা না থাকলে ভালবাসা জানালা দিয়ে পালায়। শোন নি কথাটা। শোন তন্ময়। আমি তোমাকে এত ব্যাখ্যা দিতে ইচ্ছুক না। আর একটা প্রশ্নও করবে না। আমাদের আজই শেষ দেখা। চললাম।”

আর কোনো প্রশ্ন করেনি ছেলেটি। শুধু শুকনো কণ্ঠে বলেছিল, ভাল থাকো অবন্তী। অভিনন্দন তোমার নতুন জীবনে।”

আমি যা চেয়েছি পেয়েছি। টাকা পেয়েছি অনেক। গাড়ি পেয়েছি, বাড়ি পেয়েছি। তাহলে কেন এখনও মধ্যরাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একা একাই কাঁদি! কেন এখন ভালবাসা আর স্বামীর কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সময়ের অভাবে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। এটাকেই জীবন হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। আমার তো এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হওয়ার কথা।

এমন সময় মিথিলা আমায় এসে বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপু। সেদিন যদি আপনি ওকে ছেড়ে না যেতেন। হয়তো আমি এত সুখের মুখ দেখতাম না।”

“মিথিলার সাথে পরিচয় হয়েছে তোমার? চলো কোথাও গিয়ে বসি। কফি খাবে?

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আজ আসি তন্ময়, আমার এক জায়গায় যেতে হবে। তোমরা ভাল থেকো।”

আমি চোখের পানি লুকোতে চাইলাম। তম্নয় বোধয় খেয়াল করেছিল। কিন্তু একবারও প্রশ্ন করলোনা কোনো। কেবল চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” সুখী হও।”

আমি আর কিছুই বললাম না। ব্যস্ত ফুটপাতটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। পড়ন্ত বিকেল। সুখী মানুষের ভিড়ে নিজের বুক ঠেলে আসা কান্নাটা লুকোতে চাইলাম।

মিথিলা শক্ত করে ধরে আছে তন্ময়কে। কত সুখী জোড়। ওরা সেটাকেই বেছে নিয়েছিল, যা ওদের সুখী হওয়ার জন্য দরকার।

বাইকটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এত কষ্ট হচ্ছে কেন! প্রচণ্ড হিংসে হচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। চোখের সামনে যেন আমার সমস্ত সুখ নিয়ে একটা অচেনা পাখি উড়াল দিল। ওর বাইকে করে আমার পুরো পৃথিবী ঘুরানোর স্বপ্নের কথা হয়েছিল, কিন্তু আজ অন্য কেও কেন? হ্যাঁ আমার নিজের ভুলের জন্যই!
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলাম। ভেজা চোখ আর একবুক আক্ষেপ নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম একটা রঙিন জীবনের দিকে।

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com