গল্প বিশেষ কেউ | লিখা- মুনিয়া রহমান | পর্ব -০৪

রুনা বেগম পেঁয়াজ,মরিচ ভেজে তার মধ্যে ভাজা ইলিশ মাছ গুলো ছেড়ে দিলেন।
হাতটা মুছতে মুছতে ধৃতিকে বললেন
–কিরে সেই কখন থেকে গরমের মধ্যে এখানে দাড়িয়ে আছিস ?
কত করে বলছি রুমে যা। কোন কথাই কানে নিচ্ছিস না তুই ?
–তুমি রান্না শেষ করো তারপর এক সাথে রুমে যাবো।
ধৃতিযে দাইয়ানের কারণে রুমে যাচ্ছে না। এটা রুনা বেগম খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন ।
— বাসায় ছেলে এসেছে আমার। কোন বাঘ বা ভাল্লুক আসেনি যে তোকে এত ভয় পেতে হবে।
–কে বলেছে আমি ভয় পাচ্ছি? ক..কই আমি একটুও ভয় পাচ্ছি নাতো। তুমি শুধু শুধু এগুলো বলছো আমায়।
–ভয় যদি নাই পাবি। তাহলে আমার আচল ধরে দাড়িয়ে আছিস কেন ?
–আমি মোটেও তোমার আচল ধরে দাড়িয়ে রইনি।তোমার পাশে দাড়িয়ে তোমার রান্না দেখছি।
রুনা বেগম আলতো হাসেন।মনে মনে বলেন মেয়েটাকে মিথ্যা বলার সময়ও কত মিষ্টি লাগে দেখতে।
–ঠিক আছে। মেনে নিলাম তুই রান্না দেখছিলি। এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয় তো!আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।
ধৃতি আর কথা বাড়ায়না।ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।এমনি দাইয়ানকে দেখার পর থেকেই ওর সমস্ত কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।এখন যদি কথা বলে তাহলে নিশ্চই আরও উল্টা পাল্টা কিছু বলবে।
ধৃতি রুমে এসে এক গ্লাস পানি খেলো।ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো। মুখ মুছতে মুছতে বেডের উপর বসে পায়ের পাতায় হাত বুলাতে থাকলো। তখন টেবিলের সাথে ধাক্কাটা একটু জোরেই লেগেছে। তখন ব্যাথাটা বোঝা না গেলেও এখন অনেকটা বোঝা যাচ্ছে। কি দরকার ছিলো ওভাবে তাড়াতাড়ি উঠে দাড়ানোর। এখন নিজেকে ভীষণ বাজে গালি দিতে ইচ্ছে করছে ধৃতির।
–আসবো?
–হ্যা.. হ্যা অবশ্যই।
–কি দিন আসলো আমার জীবনে দেখ? নিজের রুমে আসতেই এখন পারমিশন লাগছে।
ধৃতি দাইয়ানের কথা শুনে একটু নয় অনেকখানি অবাক হয়। কি সুন্দর সহজ সাবলীলভাবে কথা বলছে।মনেহচ্ছে এই মানুষটার সাথে ওর রোজ দেখা হয়,কথা হয়। মাঝখানে যে দুই বছর দেখা হয়নি।এই ব্যাপারটা বোঝাই যাচ্ছেনা। দুই বছর আগেও যে সম্পর্কটা স্বাভাবিক ছিলো এমনটাওতো নয়। তাহলে এখন এমন স্বাভাবিক আচরণের মানে কি ?
–কিরে স্কুলে থাকতেতো মুখে খৈ ফুটতো।এখন এতো চুপচাপ। এত চুপচাপ থাকার মেয়েতো তুই নস। তাহলে আমি কি ধরে নেবো সামনে নতুন কোন ঝড় আনবি?
ধৃতি এবার মনে মনে চরম বিরক্ত হলো ওর খুব করে দাইয়ানের কান টেনে ধরে বলতে ইচ্ছে করলো এই ছ্যাচড়া! আমি নিজে আর কি ঝড় বয়ে আনবোরে। তুই নিজেইতো একটা ঝড়।
এইযে সন্ধ্যা থেকে আমার বুকের ভেতর একটু পর পর বয়ে যাচ্ছিস। শত কথা মনের ভেতর চাপা দিয়ে হাসিমুখে শুধু বললো
–এইতো এমনি..
দাইয়ান ধৃতির বইগুলো উলোট পালোট করতে করতে বললো
–পড়াশোনা কেমন চলছে তোর। সব বুঝতে পারছিসতো ঠিকমতো।কোন অসুবিধা হলে মাকে বলবি কিন্তুু।পরে দেখা যাবে চান্স না পেলে কেঁদেকেটে এক করে ফেলেছিস। তোর কান্নাতো আবার আষাঢ়ের বৃষ্টির মত একবার শুরু হলে আর থামতেই চায় না।হ্যারে আষাঢ়ের বৃষ্টি যেমন গ্রামের রাস্তাঘাট নষ্ট করে ফেলে।তুইও নিশ্চই কান্না করার সময় নাকের পানি দিয়ে মুখের মেকাপ নষ্ট করিস।
ধৃতির এবার সত্যি সত্যি বিশ্বাস হলো তার সামনে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা ভেতরে বাইরে দুই দিকেই বদলেছে। তা-নাহলে যে মানুষটা স্কুলে থাকতে মুখ উঁচু করে কোনদিন কথা বলেনি। সেই মানুষটা আজ এমন করে কথা ওকে বলছে কি করে ?
ধৃতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুনা বেগম এলেন ওদের ডাকতে।
–কখন থেকে ডাকছি তোদের কেউ কোন কথাই বলছিস না।
–কথা বলবে কি মা ?এই মেয়েতো কথা বলাই ভুলে গেছে।
–ও নাহয় কথা বলতে ভুলে গেছে কিন্তুু তুই ? তুইতো আর কথা বলতে ভুলিস নেই। তাহলে তুই বলিস নাই কেন ?
দাইয়ান ওর মাকে দেবার মত কোন উত্তরই খুঁজে পেলোনা। বরং আহ্লাদী হয়ে বললো
–কতোদিন পর বাসায় এলাম। কই একটু আদর করবে তা না করে তুমি আমায় বকছো।
ছেলের এমন আহ্লাদী গলা শুনে রুনা বেগমের চোখ ভারী হয়ে আসে।কিছু সম্পর্ক সারাজীবন আদরের কিন্তুু একটা সময়ের পর সেই আদর টুকু চাইলেই প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনা। ছোটোবেলায় চাইলেই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া যেতো। এখন আর সেটা হয়ে ওঠেনা। এখন মাথায় হাত বুলাতে হলে আগে বলতে হয়
–বাবা একটু নিঁচু হ’তো। দেখি তোর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেই। ছেলেটা যেন হুট করেই পাহাড় সমান লম্বা হয়ে গেল।
–মা চলোতো আজ তুমি আমায় নিজে ভাত মেখে খাওয়াবে। উঁহু! অনেক ক্ষুধা পেয়েছেতো।
রুনা বেগমকে আর একটা কথাও বলতে না দিয়ে দাইয়ান হাত ধরে ডায়নিং টেবিলে নিয়ে যায়।
ধৃতি চুপচাপ ওদের পিছনে পিছনে যায়।
খাবার সময় রুনা বেগমের এক পাশে দাইয়ান আর অন্য পাশে ধৃতি বসলো। খাওয়ার এক পর্যায়ে দাইয়ান প্রশ্ন করলো
— আচ্ছা মা তুমি বলোতো আমার আর ধৃতির মধ্যে কে বেশি চতুর ?
–অবশ্যই তুই চতুর কারণ প্রেমের খাতায়তো তোর নামটা উঠেছে।আর আমি যতদূর জানি ধৃতির নাম এখনও ওঠেনি।
রুনা বেগমের এমন কথা শুনে ধৃতি ভীষণ রকম ভাবে বিষম খায়।পানি খেয়ে গ্লাসটা টেবিলে রেখে প্রশ্ন করে
–প্রেম করলে মানুষ চতুর হয় ?
দাইয়ান ভাত চিবুতে চিবুতে উত্তর করে
–শুধু কি চতুর? প্রেম করলে মানুষ মিথ্যা বলা শেখে,কাজে ফাকি দিতে শেখে,চুরি করা শেখে .. আরও কত গুণ অর্জন করে তার হিসাব রাখাই মুশকিল।তোকে অন্যদিন বলবো না হয় সেসব।
— এই এতো সব হয়..!
–হ্যা’তো।
ধৃতি মনে মনে বলে কিন্তুু আমারতো মনে হয় মানুষ প্রেমে পড়লে কথা বলার শক্তিটুকুই হারিয়ে ফেলে। এই যে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
চলবে…..
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url