ডাক্তার সাহেব । পর্ব-৩৩

ভাবান্তর ঘটার পূর্বেই আমরা তিনজনই মাকে ধরে বিছানায় শুয়ালাম। কাহিনীর রহস্য এখনও রয়ে গেছে। মাকে শুইয়ে সেটারেই উদঘাটন করার চেষ্টা করলাম৷ এবার নীলের দিকে তাকিয়ে বললাম

– তোমার মতো দেখতে এই সুনীলটা কে?
সুনীলের মুখটা ততক্ষণে চুপসে গেছে৷ বেচারা হয়তো ভাবতেও পারেনি এমন মসিবতে পড়বে। ভাবনার দূরগোড়া এত কঠিন অবকাশ নিবে সেটা হয়তো টের ও পায়নি। শুধু ঢুক গিলতে লাগল। নীল হালকা গলায় বলে উঠল
– আমার জমজ ভাই সুনীল। বিদেশে পড়াশোনা করে সেখানেই স্যাটেল। দেশে এসেছে কিছুদিন হলো। যেহেতু সুনীলের কথা কেউ জানত না তাই একটু মজা নিতে চেয়েছিলাম। মিহু ব্যাপারটা জানত তাই তোমাকে গোলক ধাঁধায় ফেলার জন্য ঐদিন ঐ কথা বলেছিল।
আমি আর সুনীল তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কারণ তোমার বাবা আর আমার বাবা এর মধ্যে কথা বলে আমাদের কাবিনের তারিখ ধার্য করেছেন আগামি সপ্তাহে। আমি সবাইকে নিষেধ করেছিলাম তোমাকে বিষয়টা বলতে কারণ চেয়েছিলাম একটা বড় সারপ্রাইজ তোমাকে দিতে।
তাই সুনীলের সাহায্য নিই। সে বলল সে আমার জিন হয়ে তোমাকে বিভিন্ন সারপ্রাইজ দিবে।
তারপর কাবিনের আগের দিন তোমাকে সে বলবে পরদিন তোমার আমার সাথে কাবিন।
স্বাভাবিকভাবেই তুমি সেটা সহজে বিশ্বাস করবে না কিন্তু পরদিন তুমি লক্ষ্য করবে সত্যি সত্যিই তোমার কাবিন হয়েছে আমার সাথে।
তখন তুমি সুনীলকে জিন ভাবা শুরু করবে আর সেটা নিয়েই তোমার সাথে মজা করব ভেবেছিলাম।
কিন্তু তোমার মতো নাছোরবান্দা পাবলিক যে জিনকেও কলার ধরে আটকে রাখবে সেটা কে জানত?
অনীলের কথা শুনে কপালটা ভাঁজ করে বললাম
– ভাইয়া তো বলেছিল প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে।
পাশ থেকে সুনীলের নম্র কন্ঠে উত্তর আসলো।
– কাহিনীর প্রয়োজনে একটু মিথ্যা বলেছিলাম। তবে আপনি সত্যিই পাগল একজন মহিলা। এভাবে কেউ কারও কলার চেপে ধরে৷
কপালের ভাঁজটা আরও প্রখর হলো। কন্ঠটা ভারী করে বললাম
– আমার সাথে মজা নেওয়া কী এত সহজ?
দুজন মিলে আমাকে যে গোলক ধাঁধায় ফেলেছিলেন তার উচিত জবাব হয়েছে।
কে বলেছে এমন করতে?
এমনিতেই এক নীলের চিন্তায় মাথা পাগল হওয়ার উপক্রম তারপর জুটেছিল আরেক নীল।
এত প্যারা নিতে পারব নাকি।
মা শুধু শুয়ে শুয়ে আমাদের কথা শুনছিল। ঘটনা বুঝতে মায়ের বাকি নেই।
তবে মা লজ্জাও পাচ্ছে একটু। এমন একটা পরিস্থিতির শিকার হবে বুঝতে পারেননি তিনি।
তবুও লজ্জা ভেঙে অনীল আর সুনীলকে বলল
– বাবারা যা হওয়ার হয়েছে। আমার ছেলে নেই বলে খুব মন খারাপ করেছিলাম এখন আল্লাহ আমাকে একসাথে দুটো ছেলে দিয়েছে। তোমরা বসো আমি পায়েস রান্না করে নিয়ে আসি।
বলেই মা রান্না ঘরের দিকে ছুট লাগালেন। এবার আমারও ভীষণ লজ্জা লাগছে। যতইহোক দেবরের কলার চেপে ধরাটা কোনো কম্যের কম্য না বরং অকম্য। সুনীল ভাইয়ার দিকে বেশ লজ্জা চোখে তাকিয়ে বললাম
– ভাইয়া দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি তাই এমনটা করে ফেলেছি। কলার চেপে ধরা উচিত হয়নি। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
– থাক মিস জরিনা ভাবি অনেক হয়েছে। আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছে না চিন্তা হচ্ছে আমার ভাইয়ের জন্য। বেচারা সারাজীবন কীভাবে কাটাবে সেই ভয়ে আছি।
কথার মানে বুঝতে খুব একটা সমস্যা হলো না। তবে উত্তর দিলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সুনীল ভাইকে বসতে দিয়ে নীলকে ইশারা করলাম আমার রুমে আসতে। নীল আমার ইশারা টের পেয়ে আস্তে করে আমার পিছু পিছু আমার রুমে চলে আসলো। রুমে আসতেই নীলের কলার চেপে ধরে বললাম
– আমি কী বাঘ নাকি ভাল্লুক যে তোমার ভাই ঐ কথা বলল?
নীল কলারে চেপে রাখা আমার দুটো হাত ধরে বলল
– তুমি বাঘ আর ভাল্লুকের চেয়েও ডেন্জারাস। আমার তো মনে হয় বাঘ ভাল্লুকও তোমাকে দেখে ভয় পাবে।
– ও তাই??
বলেই নীলের কলার চেপে নীলকে একটু ঝুঁকিয়ে নিজের কাছে এনে কাঁধে জোরগতিতে কামড় বসালাম। নীল আমাকে আরও জোরে চেপে ধরল। কানের কাছে এসে বলল
– আর গুণে গুণে চারটা দিন অপেক্ষা করো। একেবারে নিজের করে নিব। আগে কাবিন হবে পরে প্রোগ্রাম। কেন যে তুমি এত ছোট? আরেকটু বড় হলে কী হত?
– আরেকটু বড় হলে তোমার সাথে তো পাগলামি করতে পারতাম না। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতে পারতাম না। আচ্ছা মিহুকে তুমি পিল দিয়েছিলে কেন?
– মজা করে দিয়েছিলাম। একটা খেলে তেমন কিছুই হবে না। আজকে বলেও দিতাম বিষয়টা।
– ও তো একটা না ৭,৮ টা খেয়েছে। আর এটা নিয়ে বড় একটা কাহিনিও হয়েছে, আন্টির ঝাঁটার পিটানিও খেয়েছে। কী যে করো না তুমি?
– তোমার মতো পাগল বউ যার কপালে জুটবে তার তো এমন হবেই।
ভুলেও আমি সার্জারির ডাক্তার হব না।
কারণ দেখা যাবে তোমার প্যারাতে রোগীর পেটে অপারেশন থিয়েটারে কাঁচি,
ব্যান্ডেজ রেখে অপারেশন সাকসেসফুল করে ফেলব।
– তুমি একটু বেশি কথায় বলো সবসময়। মোটেও আমি এতটা পাগল না। তুমি কী চাও পাগলামি ছেড়ে দিব?
নীল আমার কপালে তার ঠোঁট আলতো ছু্ইয়ে দিয়ে বলল
– আমি চাই আমার পাগলি বুড়ি সারা জীবন পাগলামি করুক।
কারও গলার আওয়াজ কানে আসতেই দুজন দুদিকে ছিটকে পড়লাম। লক্ষ্য করলাম মা এসেছে। নীলকে ডাকছে পায়েস খেতে৷
শোঁ শোঁ বাতাস এসে শরীরে ঝাঁপটা দিচ্ছে। কপালের চুলগুলো অবাধে উড়ছে। আজকে কেন জানি ভীষণ ফুরফুরা লাগছে৷ দেখতে দেখতে চারটা দিন পার হয়ে গেল কীভাবে যেন। কোন ঘোরে চারটা দিন পার করলাম টের পাইনি একদম। কাল আমার কাবিন। মনের ভেতরটা কেমন জানি উথাল পাতাল করছে। ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে পাওয়ার মাঝে বড্ড আনন্দ। যে আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করা বড় দায়।
সারা রাত নীলের সাথে কথা বললাম। সংসার বুনার স্বপ্ন দেখলাম। কতই না মধুর সময়।
ইশ সময়টা যদি কোনো ফ্রেমে বন্দি করা যেত কতই না ভালো হত।
মনে মনে ভাবছিলাম কাল তো কবুল বলব।
কবুল বলার অনুভূতিটা ঠিক কেমন!
কবুল বলার সময় কী চোখ বন্ধ হয়ে যায় অনুভূতির দাবানলে নাকি চোখ খোলে কবুল বলতে হয়।
কত উদ্ভট প্রশ্নই না মনে জাগছে।
ভালোবাসা পূর্নতা পাবে ভেবেই যেন বুকের ভেতরটায় শীতলতা অনুভূত হচ্ছে।
একটা বাজি যে আমাকে এত পূর্ণতা দিবে বুঝতে পারিনি।
ভালোবাসার অনুভূতির শুরুটায় হয়েছিল নীলকে দিয়ে আর প্রাপ্তিও হবে তাকে দিয়ে।
নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। ঘুম যেন চোখে আসছেই না।
যতই চোখ বন্ধ করছি ততই যেন সব স্বপ্ন ঘিরে ধরছে।
উফ এটা কেমন মিষ্টি যন্ত্রণা যে যন্ত্রণা উপভোগ করতেই ভীষণ ভালো লাগছে।
মিহুর রাগটাও এর মধ্যে মলিন হয়ে গেছে। তাকেও আসতে বলেছি কাল। যেহেতু প্রোগ্রাম পরে হবে তাই বাকিদের বলতে নিষেধ করা হয়েছে পরিবার থেকে।
রান্না ঘর থেকে বাসন কোসনের আওয়াজ আসছিল টুংটাং। হয়তো সাজেদা খালা এসে বাসন কোসন ধুচ্ছে।
আওয়াজ প্রখর হয়েও মৃদু হয়ে গেল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম বেলা বাজে ১২ টা ৩০।
রাতে ছটফট করতে করতে ঘুম হয়নি। ফজরের নামাজের পর দু চোখ লেগে এসেছিল।
মা রান্না ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগল এ দিনও কেউ এত বেলা করে ঘুমায়।
নানু মাকে থামিয়ে দিয়ে কী যেন বলছে৷ বাড়িটায় বেশ বিয়ে বাড়ি ভাব লাগছে৷
বাইরে থেকে আজানের ধ্বনি আসছে। চট জলধি উঠে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম নীলের মেসেজ
“প্রিয়তম তিনটায় দেখা হচ্ছে। লাল শাড়ি পরে থেকো।
চোখে মোটা করে কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক দিও।
এখন আর কথা বলব না কবুল বলার পরেই কথা হবে।”
মেসেজ টা পড়ার পড় অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে।
শোরগোলের শব্দ আসছে বাইরে থেকে। শোরগোলের কন্ঠের মালিক হলো মিহু।
এসেই মা আর নানুর সাথে গল্পে মত্ত হয়ে গেছে৷
আমি আর সেদিকে না গিয়ে সরাসরি বাথরুমে ঢুকে পড়লাম গোসল করার জন্য।
গোসল শেষ করে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
চুল গুলো তোয়ালে দিয়ে আলতো করে মুছছিলাম।
নিজের প্রতিচ্ছবিটাও আয়নাতে আজকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে।
মনে হচ্ছে এরপর থেকে আমার পেছনে নীল দাঁড়িয়ে থাকবে।
আমার চুল মুছে দিবে। মাঝে মাঝে চুল গুলো ঘাড় থেকে সরিয়ে ঘাড়ে কামড় কষবে।
কত শত চিন্তা করতে করতেই যেন আমি আয়ানার দিকে তাকিয়ে মজে গেলাম।
আচমকা একটা আওয়াজ কানে ধেয়ে আসতেই চমকে গেলাম।
বুকের ভেতরটাও যেন ধুক করে উঠল।

চলবে…
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url