Breaking News

বন্দি তোমার মাঝে । পর্ব - ০৩



ঘুম থেকে উঠে মাধবী তীব্রকে আর রুমে দেখতে পায় না। নিজের বালিশে ঠিকঠাক মতো শুয়ে আছে বুঝতে পেরে হুট করে উঠে বসে। ওড়নাটাও গায়ে জড়ানো। মাথায় হাত দিয়ে বিরবির করে বলে,

-আয় হায়, আমি তো এতো সভ্য শান্ত হয়ে নিজেকে কখনোই দেখি না ঘুম থেকে উঠে।আজকে কিভাবে! আর উনিও পাশে নেই। তবে কি উনি ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়েছে!
ওড়না মুখে চেপে বসে থাকে মাধবী। না জানি তীব্র কি ভেবেছে এসব ভেবেই হতাশ সে। কিছুক্ষণ পর বিছানা ছেড়ে উঠে, সব গুছিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায়।

ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা।
একটু আগেই তীব্র ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইচ্ছে করেই মাধবী উঠার আগে রুমের বাইরে চলে এসেছিলো যাতে ইতস্ততবোধ না করে সে।
মাধবীর এলোমেলো অবস্থার কথা মনে হতেই মুচকি হেসে দেয় তীব্র। কেউ খেয়াল করার আগেই স্বাভাবিক হয়ে বসে। সবাই উঠে গেছে এতোক্ষণে। সকালের নাস্তা তৈরি করছে তরী ও নাকিবের বউ মিলি, কাজের মহিলা দুইজন সাহায্য করছে তাদের। নাসিমা শেখ এসে দেখে গেছেন সব ঠিক হচ্ছে কি না।
একে একে সব খাবার টেবিলে গুছিয়ে রাখা হলে সবাইকে খেতে আসতে বলেন নাসিমা শেখ। সবাই এসে বসার পর সেখানে হাজির হয় মাধবী। সাদা ও নীল রঙের কম্বিনেশনের একটা থ্রি পিস পড়েছে সে। মাথায় ওড়না দিয়ে রেখেছে, চুলগুলো বেনী করে এক সাইডে রাখা। ওকে দেখেই মনোয়ারা বলেন,

- আয় মাধবী, তুইও বসে পড় আমাদের সাথে।
মাধবী কিছু বলার আগেই নাসিমা শেখ বলেন,
- ও পরে খেয়ে নিবে আপা। তরী আর মিলিও বাকি আছে। ও বরং পরিবেশন করে দিক সবাইকে।
মাধবীও মাথা নেড়ে সায় জানায়। সবার প্লেটে পরোটা, সবজি, মাংস একে একে দিয়ে দেয়। তীব্রের প্লেটে কাপা হাতে মাংসের তারকারি দেয়ার সময় নার্ভাসনেসে হাত ফসকে কিছুটা ঝোল তার হাতের পিঠে ও গলায় ছিটে যায়। মাধবী চমকে উঠে তখনই, গরম লাগায় তীব্র হাত সরিয়ে নিলে আস্তে করে বলে,
- স্যরি স্যরি।
এ বলে সামনে রাখা টিস্যু এনে তীব্রের হাতে দেয়। সেটা দেখেই নাসিমা শেখ ধমকে মাধবীর উদ্দেশ্যে বলেন,
-এটা কি করলে? সামান্য এটুকু করতেই এতো বেখেয়ালিপনা? এখনো কি ছোটো আছো তুমি? তুমি...
উনার কথার মাঝেই তীব্র বলে উঠে,
-ইটস ওকে। ও বুঝতে পারে নি হয়তো, ভুল হয়ে গেছে।
- এসব জিনিস ভুল হওয়ার মতো না তীব্র। মাধবীর ছটফটানি কমলেই হয়।

পাশ থেকে মনোয়ারা বলেন,
-আহ হা, থামো ভাবী। ছোটো মানুষ ভুল হয়ে গেছে। বাদ দাও। মাধবী আয় আমার কাছে, তোকে আমি খাইয়ে দিই।
ফুপুর ডাকে তার পাশে গিয়ে বসে মাধবী। নাসিমা শেখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে উনি এখনো রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। মনোয়ারা আর তীব্রের এমন সাপোর্টিভ ভাব দেখে নাবিলা মনে মনে খানিকটা অবাকই হয়। সবার সামনে নাসিমার বকা থেকে বাচিয়ে নিলো মাধবীকে, সে হলে তো আরও সুযোগ করে দিতো কথা শুনানোর। মনে মনে ভেংচি কাটে মাধবীর দিকে।
এরপর মনোয়ারা নিজ হাতে মাধবীকে খাইয়ে দেয়।
খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ হলে তীব্রদের যাওয়ার কথা বলে তার মা৷ শফিউদ্দিন শেখ বোনকে
দুপুরের পর যেতে বললেও মনোয়ারা রাজি হয় না৷
কোনোমতে সবাইকে বুঝিয়ে রেডি হতে বলে তান্নি আর তীব্রকে।

তীব্র রুমে আসলে একটু পর মাধবীও আসে। এসে তীব্রের সামনে দাঁড়িয়ে অপরাধী চাহুনি দিয়ে বলে,
-আমি সত্যিই দু:খিত। ভুল হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে করি নি।
- আমি কিছু বলেছি তোমাকে এ নিয়ে?
- উহু কিন্তু আমি তো ভুল করেছি।
- ইটস ওকে। এরপর থেকে সাবধানে কাজ করবে।
- জ্বি।
এরপর তীব্রের গলার দিকে তাকিয়ে একপাশে একটু লাল হয়ে যাওয়া দাগ দেখে। হাইটে ছোটো হওয়ায় ভালো করে দেখতে পায় না মাধবী। তাই বলে,
-একটু নিচু হোন
-হ্যাঁ?

-বললাম একটু নিচে ঝুকে দাড়ান
তীব্র ওর দিকে একটু ঝুকে দাড়াতেই মাধবী গলার লাল হয়ে যাওয়া জায়গাতে আলতো করে আঙুল ছুইয়ে মুখটা এগিয়ে নিয়ে ফু দিতে দিতে বলে,
-ইশশ, কেমন লাল হয়ে গেছে! গরম ছিলো তো।
কয়েকবার ফু দিতেই তীব্র মাধবীর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,
- একদিনেই এতো চিন্তা!? আজীবন তো পড়েই আছে।
মাধবী মুখ তুলে চোখ বড় বড় করে তাকায় তীব্রের দিকে। কোমড়ে তীব্রের শক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠে। আমতা আমতা করে বলে,
-চি চিন্তা মানে, লা লাল হয়ে গে গেছে তাই বললাম।
- চিন্তা থাকা ভালো তো।
- ছা ছাড়ুন।
মাধবী নড়াচড়া শুরু করতেই তীব্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আমার টাচ কি ব্যাড টাচ মনে হয় তোমার? অসহ্য, বিশ্রী লাগে আমি টাচ করলে?
এ প্রশ্নে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয় মাধবী। কারণ, তীব্রের স্পর্শ ওর কাছে খারাপ স্পর্শ মনে হয় না। বাজে ইঙ্গিত অনুভব হয় নি। ইতস্ততবোধ আর লজ্জা লাগায় ছাড়তে বলেছিলো শুধু। তাই জবাবে মাথা নাড়িয়ে না বলে সে।

-না, বিশ্রী লাগে না।
এই জবাবে মনে মনে খুশি হয় তীব্র। কেন জানি তার শান্তি লাগছে।
নিজের বউই যদি বলতো তার স্পর্শ বাজে লাগছে তবে সেটা মেনে নেয়া কষ্টকর হতো।
- গুড, আমি ছাড়া আর কারো কোনো রকম ছোয়া থেকে দূরে থাকবে।
অধিকারটা শুধুমাত্র আমার। মনে থাকবে?

- হুম, থাকবে।
মাধবীকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায় তীব্র। কিছুক্ষণ পর রেডি হয়ে এসে বলে,
-তোমার ফোনটা দাও তো।
মাধবী নিজের ফোনটা টেবিল থেকে নিয়ে তীব্রের হাতে দিয়ে বলে,
-কি করবেন?
-আমার ফোন নাম্বারটা তোমার কাছে নেই যতদুর মনে হয়।
-উহু, নেই।
-জানতাম। তাই সেভ করে দিয়ে গেলাম।
কল দিলেই যাতে সাথে সাথেই রিসিভ হয়। লেট করলে আর কখনো কল দিবো না।
হালকা হুম/কি শুনে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে মাধবী ।
- জ্বি, রিসিভ করবো।

মাধবীর গুলুমুলু গাল দুটো দেখে এতোক্ষণ ধরে একটা ইচ্ছে অনেক চেষ্টা করে আটকে রেখেছে তীব্র।
এখন চলে যাবে তাই আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না।
মাধবীর দিকে এগিয়ে কাছাকাছি দাঁড়ায় সামনে।
দু'হাতে ওর মুখটা আগলে নিয়ে আদুরে গলায় বলে,
- এতো কিউট কেন তুমি? ইচ্ছে করছে নিজের কাছে রেখে দেই।
আমাকে এতোটা মায়ায় জড়িয়ে নিতে কিভাবে পারলে?

মুহুর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় মাধবী। তীব্র এভাবে কিছু বলবে ভাবতেও পারে নি সে।
ওকে লজ্জা পেতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে তীব্র।
আলতো করে মাধবীর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে সরে এসে বলে,
- এতো লজ্জা পেতে হবে না। বাকিটা তুলে রাখো।
মাধবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-আসছি আমি। ভালো থেকো, সাবধানে কাজ করবে। দেখা হচ্ছে শীঘ্রই।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়াটা মাধবীর কাছে সবচেয়ে আদরের লাগে।
তীব্র এতটা স্নেহ করবে তাকে কল্পনাও করে নি।
সবার কথাতে ভেবেছিলো, তীব্র সব সময় রাগারাগি করবে, ধমকে কথা বলবে।
কিন্তু মানুষটা এভাবে আদর দিয়ে কথা বলছে তার সাথে!
চোখ পানি টলমল করছে তার। ঠোঁটে হাসি এনে বলে,
-আপনিও ভালো থাকবেন। সাবধানে থাকবেন।
বিনিময়ে তীব্রও হেসে রুম থেকে বেরিয়ে আসে মাধবীকে সাথে নিয়ে।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় তীব্ররা। যাওয়ার আগে মাধবীর সাথে মনোয়ারা আলাদা করে কথা বলে গেছেন আর সাথে একটা খাম হাতে দিয়ে বলেন,
- নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হলো। এটা আমার পক্ষ থেকে ছোটো উপহার হিসেবে দিলাম। ভালো থাকিস মাধবী।
- উপহারের থেকে তোমার দোয়াই বেশি মূল্যবান আমার কাছে, ফুপি।
-জানি সেটা। তবুও রেখে দে এটা।
এভাবে বলার পর মাধবীও আর মানা করে নি।
সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়িটা আগের মতো হয়ে গেছে। যে যার মতো নিজের কাজে ব্যস্ত।
কেবল মাধবীর জীবনেই একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।
সে এখন থেকে অন্য কারো সঙ্গে জড়িয়ে গেলো, যে সম্পর্কটা আমৃত্যু থেকে যাবে।

রাতে খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত হলে শফিউদ্দিন শেখ মাধবীর উদ্দেশ্যে বলেন,
- তোমার বিয়ে হয়ে গেছে শুধু ভালো একটা দিন দেখে তুলে দেয়া বাকি, এখন থেকে ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই তেমন। পরীক্ষাগুলো দিতে যাবে ব্যস৷ অন্য বাড়ির আমানত হয়ে আছো তুমি, এদিক থেকে সেদিক হলেই আমার উপর দোষ আসবে।

পাশ থেকে নাকিব বলে,
- ও তো ছোটোবেলা থেকেই অন্যের উপর চেপে আছে।
এখন কটাদিন দেখেশুনে রেখে বিদায় করে দিলেই তোমার শান্তি বাবা।
- তাই তো আজই বলে দিলাম।
এতক্ষণ তাদের কথা চুপ করে শুনছিলো মাধবী। আর কিছু বলছে না দেখে বলে,
-বড় আব্বু, সপ্তাহে দুইদিন যাওয়ার অনুমতি দিন। ক্লাস মিস দিলে সমস্যা হয়।
-আমি যেটা বলেছি সেটাই ফাইনাল । কথার নড়চড় যাতে না হয়।

মাধবীর চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে তার ছোটো কাকা বলেন,
- বড় ভাইয়া, ও তো অনিয়মিতই যায় ক্লাসে৷ প্রতিদিন যাওয়ার অনুমতি আগে থেকেই দাও নি।
তবুও দু তিন যেতেই পারে।
- এতদিন ওকে নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে রেখেছিলাম বলেই উচ্ছন্নে যায় নি৷
বাবা মা ছাড়া, তাদের শাসন ছাড়া সন্তান মানুষ এতো সহজ নয়।
এ নিয়ে একটা বাড়তি কথা যাতে না হয়।
এরপর আর কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।
মাধবী মাথা নিচু করে ছোটো কাকার চেয়ারের হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে।
এরমাঝে নাসিমা শেখ বলে উঠেন,
- মাধবী, তুমি এখন থেকে সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিবে।
আজকে যা নমুনা দেখালে! কাজকর্মগুলো শিখে নিবে এখন থেকে।
- জ্বি বড়মা।

এ বলে সবাইকে পরিবেশন করে দেয় মাধবী। সবার শেষে নিজেও একটু খেয়ে নেয়।
মনটা খারাপ হয়ে আছে তার। সব কথাই মেনে নিতে পারে সে কিন্তু বাবা মায়ের কথা
তুললে তার ভালো লাগে না। সব গুছিয়ে রেখে রুমে চলে আসে।
এসে ফ্রেশ হয়ে জামা চেইঞ্জ করে ওভারসাইজ টি শার্ট আর প্লাজু পড়ে নেয়।
আজকে আর সাকীকে ডাক দেয় নি সে।
তার কাকি মনি সাকীকে বুঝিয়েছে আপাইয়ের ঘরে থাকতে হবে না এখন থেকে, একাই থাকবে সে।

সারাদিন ব্যস্ততার মাঝে তীব্র আর ফোন দেয় নি মাধবীকে।
ভেবেছিলো, একেবারে রাতে ফ্রি হয়ে কল দিবে।
মাধবী নিজের ফোনটা হাতে নিয়েই দেখে তিনটা মিসড কল ভেসে আছে নোটিফিকেশনে।
তিনটাই তীব্রের নামে সেভ করা নাম্বার। নাম দেখে ভড়কে যায় সে।
তড়িঘড়ি করে তীব্রকে কল ব্যাক করে।
কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করে তীব্র। রিসিভ হতেই মাধবী সালাম দিয়ে বলে,

- স স্যরি, দেখি নি আ আপনি কল দিয়েছেন।
ওপাশ থেকে ভারী গলায় সালামের জবাব দিয়ে তীব্র বলে,
- কি বলে এসেছিলাম?
- স্যরি।
- প্রথম দিন তাই আর কিছু বললাম না। বারবার এক ভুল যাতে না হয়।
-জ্বি।
-খেয়েছো রাতে?
-হ্যাঁ, আপনি খেয়েছেন?
-হুম। কি করছো? আজকে সাকী তোমার সাথে আছে?
- একটু আগেই রুমে এসেছি আমি। সাকী ওর রুমে।
কাকিমনি নাকি ওকে বুঝিয়েছে এখন থেকে ওর একাই থাকতে হবে।
- তাও ঠিক। আস্তে আস্তে অভ্যাস করা ভালো।
যখন তোমাকে একেবারে এ বাড়িতে নিয়ে চলে আসবো তখন যাতে তার আপাইকে দিতে মানা না করে।
মাধবীর মলিন মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে তীব্রের কথায়।
- ঘুমাবেন না?
- একটু পর, তোমার ঘুম পাচ্ছে?
- না, আপনার জন্য বললাম।
এভাবে আরও কিছুক্ষন কথা বলে দুজন।
একে অপরের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে জানা শোনা করতে থাকে।

দেখতে দেখতে মাধবী ও তীব্রের আকদের দশদিন পেরিয়ে গেছে।
এই কয়েকদিনে দু'জনের আর দেখা হয় নি, প্রতিদিনে ফোনে দুই একবার কথা হয়েছে।
তাদের মাঝে গভীর সম্পর্ক এখনো হয়ে উঠে নি, দুজনই চেষ্টা করছে দুজনকে বুঝার।
কিছু সম্পর্ক একটু একটু করে সময় নিয়ে গড়ে তোলার অনুভূতিটা অন্যরকম
যা এই কয়েকদিনে তারা বুঝতে পেরেছে।

তীব্রের থেকে বেশি মনোয়ারার সাথে কথা হয় মাধবীর। ফুপির সাথে তার জড়তা কাজ করে না যা তীব্রের সাথে কথা বলতে হয়। আজকে কল দিয়ে মনোয়ারা কথার মাঝে মাধবীকে বলে,
-তোর যা কিছু প্রয়োজন আমাকে না হয় তীব্রকে বলবি। পাঠিয়ে দিবো। তুই তো এখন আমাদের বাসার মানুষ , নামে মাত্র কয়েকদিন ওই বাড়িতে থাকবি। লজ্জা পাবি না একদম, শুধু মুখ ফুটে আবদার করবি।
-বড় মা এনে দেয়, যা লাগে আমার। সমস্যা নেই ফুপি। তুমি চিন্তা করো না।
-তবুও , আমারও পাঠানো উচিত ।
- এতো ভেবো না তুমি। লাগলে জানাবো আমি।
- মনে থাকে যেন ।
একটু পর মনোয়ারার সাথে কথা বলে ফোন রাখে মাধবী।
ফোনটা চার্জে দিয়ে পড়ার টেবিলে বসে। ক্লাসে যেতে পারছে না,
বাসায়ই পড়াশোনা করছে যতটা পারছে।

বিকেল বেলা তীব্র ফোন দেয় মাধবীর কাছে। সে তো ঘুমিয়ে বেহুশ।
ফোনের রিংটোন শুনে বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে নেয়।
হাতড়ে পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে না দেখেই রিসিভ করে বলে,
-হ্যালো কে বলছেন? আমি ঘুমাচ্ছি।
ফোন রিসিভ হতেই মাধবীর ঘুম ঘুম গলা শুনে আবেশিত হয়ে যায় তীব্র।
কিন্তু সে কি বলেছে সেটা বুঝতে পেরে ভ্রু কুচকে জবাব দেয়,
- ফোন দেখে রিসিভ করো না? আমি তীব্র।

তীব্রের আওয়াজ শুনেই ধরফরিয়ে উঠে বসে মাধবী।
একহাতে চোখ কচলে ফোন সামনে এনে দেখে তীব্রের নাম ভাসছে স্ক্রিনে।
ঘুম কেটে গেছে তার ইতিমধ্যে। ফোন আবারও কানে নিয়ে বলে,
- ঘুমিয়ে ছিলাম তো। দেখি নি ভালো করে।
- বুঝতে পেরেছি।
তীব্রের নরম গলা শুনে স্বস্তি পায় সে।
-শপিংয়ে যাবে?
- বড় আব্বু যেতে না করে যদি?
- রেডি হও আধ ঘন্টায়। আমি আসছি। বড় মামা যেতে দিবে। ফাস্ট রেডি হও।
- ওকে।
বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হতে থাকে মাধবী।
লাল ও কালোর সংমিশ্রণের একটা সুন্দর রাউন্ড জামা, ম্যাচিং করে হিজাব পড়ে নেয় সে।
জামাটা হাটুর একটু নিচ অবধি, ওড়নাটা কাধে এক সাইডে রেখে পিন আপ করে নেয়।
মুখে একটু ক্রিম আর ঠোঁটে লিপ বাম দিয়েছে।
এর থেকে বেশি সাজে না সে বাইরে যাওয়ার সময়। আজও তাই।

মাধবী রেডি হতেই দরজায় একবার নক করে নাবিলা আসে রুমে। এসে মাধবীকে দেখে বলে,
- কোথায় যাচ্ছিস? কাউকে না জানিয়ে রেডি হয়ে আছিস, ব্যাপার কি তোর?
পেছন ফিরে নাবিলাকে দেখে থতমত খেয়ে বলে,
- উ উনি আসবেন। বাইরে নিয়ে যাবেন বলেছেন।
মাধবীর মুখে তীব্রের কথা শুনতেই নাবিলার মুখের ভঙ্গি কঠিন হয়ে যায় আরও।
- মা বাবার অনুমতির দরকার নেই তোর?
- উনি বলেছেন বড় আব্বুকে জানাবে।
- যত্তসব ঢং।
মুখ ঝামটা দিয়ে বেরিয়ে যায় নাবিলা।
একটু পর সাকী এসে মাধবীকে ডেকে নিয়ে যায় বসার ঘরে। গিয়ে দেখে তীব্র বসে আছে শফিউদ্দিন শেখের সামনে। এতক্ষণে হয়তো তাদের কথা হয়েছে। ওকে দেখেই শফিউদ্দিন শেখ বলেন,

- তীব্রের সাথে যাও। সাবধানে ফিরবে।
মাধবী মাথা কাত করে হ্যাঁ বলে। আর কোনো কথা হয় নি সেখানে।
বসা থেকে উঠে মাধবীর হাত ধরে বাইরে চলে আসে তীব্র। যত্ন করে ধরে আছে তার হাতটা। লাল টয়োটা গাড়ির সামনে এসে ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দেয় মাধবীর জন্য। মাধবীও বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসে সিটবেল্ট লাগিয়ে নেয়। তীব্র ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট লাগিয়ে গাড়ি চালানো শুরু করে। একটু পর পর আড়চোখে মাধবীকে দেখছে। মাধবী বাইরে তাকিয়ে আছে। হুট করে তীব্র বলে,
- তুমি সাজো না?
তীব্রের কথা কানে যেতেই ওর দিকে তাকায় মাধবী। সে ভাবে, তীব্রের হয়তো ওকে সাদামাটা দেখতে ভালো লাগছে না। তাই অসন্তুষ্ট হয়েছে। অপছন্দ হওয়াটাও অস্বাভাবিক না। জবাবে আস্তে করে বলে,
- উহু, সাজলেই কি অসুন্দর থেকে সুন্দর হয়ে যাবো! আর আমি সাজতে পারি না ভালো করে। অভ্যস্ত নই।
- অসুন্দর কে বললো?

- এটা বলতে হয় নাকি! জানি আমি। আমি আপনার মন মতো নই হয়তো এটাও বুঝি। তাই না?
আচমকা গাড়ির ব্রেক কষে তীব্র। সামনের দিকে একটু ঝুকে পড়ে মাধবী তবুও নিজেকে সামলে নেয়। এদিকের রাস্তাটা শুনশান এখন। তীব্র জোরে শ্বাস টেনে সিটবেল্টটা খুলে মাধবীর দিকে এগিয়ে এসে গালে চেপে ধরে বলে,
- সাবধান! আজেবাজে বকবে না। অসুন্দর নও তুমি। তোমাকে অপছন্দ করি কখনো বলেছি? তুমি যেমনই হও তেমনই আমার বউ। এর বাইরে অন্য কোনো চিন্তাও করবে না।
এ বলে নিজের জায়গায় ফিরে আসে তীব্র। তার কথাগুলো কানে বাজছে মাধবীর। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে আলতো করে হেসে দেয়।
এরপর কারো মাঝে কোনো কথা হয় না। কিছুক্ষন পর মাধবী বলে,
- বড় আব্বু কি রাগ দেখিয়েছে?
নজর সামনের দিকে রেখেই তীব্র জবাব দেয়,
- কেন?

-আমাকে নিয়ে বাইরে এলেন যে
- বউ আমার, তাকে শপিংয়ে নিয়ে যাবো এজন্য রাগ দেখানোর রাইট এখন উনার নেই।
ভয় পাচ্ছো তুমি?
- ঠিক ভয় না, আসলে আমার যা যা লাগে বড় মা আর নাবিলা আপু এনে দেয়।
হুটহাট শপিংয়ে আসা হয় না আমার।
-এখন থেকে যা লাগবে আমি দিয়ে আসবো না হয় পাঠিয়ে দিবো।
অন্য কাউকে বলতে হবে না। গট ইট?
- হুম।
তীব্র জানে যে, মাধবীকে কড়াকড়ি নিয়মের মাঝেই রাখা হয়েছে এ অবধি।
পরের মেয়ের রিস্ক কে নিতে চায়!
আর ওর জন্য প্রয়োজনীয় সব এনে দিয়ে সেটা ঘটা করে সবাইকে বলতে বাদ দেয় না তারা।
এমন ভাব দেখায় যেন কোনো অসহায়কে দান করে মহান কাজ করেছে এতোদিন।
এসব তীব্র তাদের কথা শুনেই বুঝেছে।
তাই সে ঠিক করেছে এখন থেকে সব দায়িত্ব নিজেই পালন করবে।
মাধবী তার কাছে মায়ের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, ওর প্রতিটা দিকে সে নজর রাখবে।
একটু পর শপিংমলে এসে পৌছায় দুজন। ভেতরে ঢুকার আগে মাধবীর হাত ধরে তীব্র বলে,
-হাত ধরে থাকবে, ছাড়বে না।
-আচ্ছা।

এরপর কয়েকটা দোকান ঘুরে তীব্র তার নিজের পছন্দে মাধবীর জন্য থ্রি পিস, রাউন্ড জামা মিলিয়ে মোট দশটা ড্রেস কিনে দেয়। এরপর কয়েক সেট করে জুতা, কানের দুল, চুড়ি কিনে। মাধবী ফিসফিসিয়ে বলে,
-অনেক হয়েছে আমার, আর লাগবে না। এতোকিছু একসাথে...
- আমি দিচ্ছি আমার ইচ্ছে। বাড়ির সবার জন্যই শপিং করে নিয়ে যাবো।
পরিচিত এক দোকানে মাধবীর জিনিসগুলো রেখে আসে তীব্র। এরপর বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা শেষ করতে করতে ঘন্টা খানিক লেগে যায়। মাধবী খেয়াল করে দেখে তীব্র নিজের জন্য নেয় নি এখনো। তাই বলে,
- আপনার জন্য কেনা বাকি আছে।
- আজকে আপাতত লাগবে না আমার। ক্লান্ত হয়ে গেছো তুমি তাই না? চলো ডিনার করে বাসায় ফিরবো।
- না না, এখন আপনার জন্য কিনবো। ফুপি আর তান্নির জন্যও নিবো। একটু চলুন না।
তীব্র মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকায় মাধবীর দিকে। সবার কথাই কেমন করে ভাবে মেয়েটা। ওর কথা উপেক্ষা করে না সে। বাকি সবার জন্য কেনা শেষ হলে তীব্র মাধবীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে যায় ডিনার করতে।

শেখ বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে রাতের দশটা বেজে যায়।
কাজের লোক দিয়ে গাড়ি থেকে শপিং ব্যাগগুলো এনে বসার ঘরে রাখে। অন্য একজনকে মাধবী ও তার ব্যাগগুলো মাধবীর রুমে দিয়ে আসতে বলে তীব্র।
সবাই ওদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। এতো শপিং দেখে নাসিমা শেখ বলেন,
- এসব কেন করতে গেলে তীব্র?
- মাধবীকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়েছিলাম তাই ভাবলাম সবার জন্যই নিই।
-এসবের প্রয়োজন ছিলো না।
-প্রয়োজন তো জানি না তবে আমার ইচ্ছে ছিলো তাই এনেছি।
সবাই বেশ খুশিই হয় তীব্রের কথাতে। মাধবীর কাকা পাশ থেকে বলেন,
- আগে দুজন ফ্রেশ হয়ে আসো। ক্লান্ত নিশ্চয়ই তোমরা। পরে এসে সবাইকে গিফট দিতে পারবে তীব্র। যাও বাবা।
তীব্র আর কথা বাড়ায় না। ছোটো মামাকে সে বরাবরই মন থেকে শ্রদ্ধা করে। দুজনেই চলে আসে রুমে।
তীব্র ফ্রেশ হয়ে আসার পর মাধবী যায় ফ্রেশ হতে। ঝটপট করে একেবারে গোসল সেরে বের হয় সে। কোমড় ছুইছুই ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বের হয়। তীব্র বসে আছে বিছানায়। বেবি পিংক কালারের থ্রি পিস পরিহিতা মাধবীর দিকে চেয়ে আছে সে।
তীব্র ভালো করে চুল মুছে নি দেখে মাধবী এগিয়ে এসে বলে,
- মাথা মুছেন নি কেন ভালো করে ?
- এভাবেই শুকিয়ে যাবে।

মাধবী জবাব না দিয়ে নিজের টাওয়ালটা দিয়েই তীব্রের সামনে দাঁড়িয়ে ওর মাথা মুছে দিতে দিতে বলে,
- মাথা ভেজা থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে তো আপনার।
টাওয়াল মাথায় আছে বিধায় তীব্রের মুচকি হাসিটা ঢেকে গেছে। মাধবী দেখতে পায় না হাসিটা।
- এটায় অভ্যস্ত আমি।
- ব্যাড হ্যাবিট।
- তুমি আছো তো, এখান থেকে নিয়ে যাবো। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমাকে নিতে।
এ কথা বলে নিজের মাথা থেকে টাওয়ালটা সরিয়ে দিয়ে পাশে রেখে দেয় তীব্র।
হুট করে একহাতে মাধবীর কোমড় চেপে কাছে টেনে নিয়ে ওর গলায় ঠোঁট ছুইয়ে দেয়।
আচমকা এমন হওয়ায় হা হয়ে যায় মাধবী, এখনো তীব্র তার গলায় মুখ ডুবিয়ে আছে।
গলার একটু নিচে ঠোঁট নামিয়ে এনে আলতো করে কামড়ে দিতেই
মাধবী শিউরে উঠে মৃদু গোঙানি দিয়ে বলে,
- আহ, it hurts.. (এটা ব্যথা দিচ্ছে)
তীব্রের গলা আকড়ে ধরে আছে মাধবী। ওর গলা থেকে মুখ সরিয়ে তীব্র ফিসফিসিয়ে বলে,
- But you have to tolerate it . (কিন্তু এটা তোমাকে সহ্য করতে হবে)

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com