রাজশাহী জেলার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য


রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা, যা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগে অবস্থিত। এটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এবং এর ভৌগোলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, প্রশাসনিক কাঠামো এবং শিক্ষার প্রসারে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। রাজশাহী জেলা শুধু একটি প্রশাসনিক ইউনিট নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বটে। অন্যান্য জেলার তুলনায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।​

রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলা, ৬৬টি উপজেলা এবং ৫৬৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই বিভাগে অবস্থিত জেলাগুলো হলো: রাজশাহী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন

রাজশাহী জেলার আয়তন প্রায় ২৪০৭.০১ বর্গ কিলোমিটার। এর উত্তরে নওগাঁ ও নাটোর জেলা, দক্ষিণে পদ্মা নদী ও ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলা, পূর্বে নাটোর জেলা এবং পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অবস্থিত। এই জেলা প্রধানত সমতল ভূমি নিয়ে গঠিত, তবে পদ্মা নদীর তীরবর্তী অঞ্চল কিছুটা ভাঙনপ্রবণ।

প্রশাসনিক বিভাগ ও জনসংখ্যা

রাজশাহী জেলা ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো – পবা, গোদাগাড়ী, চারঘাট, বাঘা, পুঠিয়া, তানোর, মোহনপুর, দুর্গাপুর এবং বাগমারা। এছাড়াও রাজশাহীতে একটি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে – রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, যা মহানগর এলাকার প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

মোট থানার সংখ্যা ১৩টি, যার মধ্যে ৪টি রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতাভুক্ত (মতিহার, রাজপাড়া, বোয়ালিয়া, শাহ মখদুম)। বাকিগুলো জেলা পুলিশের আওতাভুক্ত।

জেলায় মোট ইউনিয়ন রয়েছে ৭২টি এবং গ্রাম রয়েছে ১,৯১৪টি। পৌরসভা আছে ১৪টি এবং একটি মহানগর এলাকা রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন হিসেবে গঠিত।

রাজশাহী জেলার মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৩০ লাখের কাছাকাছি (২০২১ সালের প্রাক্কলিত তথ্য অনুযায়ী)। এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব ও লিঙ্গ অনুপাত বাংলাদেশের গড়ের কাছাকাছি।

রাজশাহীর ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। এখানে বিভিন্ন প্রাচীন মন্দির, মসজিদ, বিহার ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। গোদাগাড়ী উপজেলার উপরবাড়ি টিলা বৌদ্ধ বিহার, কুমারপুরের আলী কুলীবেগের মাজার, দেওপাড়া গ্রামে পদুমসার শিব মন্দির, খেতুর গ্রামের শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গবাড়ী মন্দির ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।​

রাজশাহী একসময় মহাস্থানগড়, পুন্ড্রবর্ধনের অংশ ছিল। এই অঞ্চলে বহু প্রাচীন সভ্যতার বসতি ছিল এবং এখানে মৌর্য, গুপ্ত ও পাল রাজবংশের শাসন ছিল। মুঘল ও ব্রিটিশ আমলেও রাজশাহী প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।

রাজশাহীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো রাজশাহী সিল্ক। রাজশাহী সিল্কের শাড়ি, ফতুয়া এবং পাঞ্জাবি সারাদেশেই জনপ্রিয়। রাজশাহী শহরে আছে বারনাসি ধাঁচে তৈরি সিল্ক শিল্পের পুরনো ঐতিহ্য।

শিল্প-সাহিত্যে রাজশাহীর অবস্থানও সমুজ্জ্বল। এখানে একাধিক সাহিত্যিক, কবি ও বুদ্ধিজীবী জন্মগ্রহণ করেছেন।

পর্যটন ও দর্শনীয় স্থান

  • রাজশাহীতে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেমন:
  • বরেন্দ্র রিসার্চ জাদুঘর
  • শাহ মখদুম রূপোশের মাজার
  • বাঘা মসজিদ
  • পুঠিয়া রাজবাড়ী ও মন্দির
  • পদ্মা নদীর তীর
  • জাহাজঘাট ও নবাববাড়ী এলাকা
  • এছাড়াও রাজশাহী সিল্ক কারখানাগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

নদী

পদ্মা, মহানন্দা, করতোয়া, আত্রাই, ইছামতি, বড়াল, তুলসীগঙ্গা, পুনর্ভবা, গুমানি, নাগর, বাঙ্গালী।

রাজশাহী জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি

এখানে আরও কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম দেওয়া হলো:
  • মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা: রাজনীতিবিদ ও জাতীয় নেতা।
  • পলান সরকার: রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী
  • প্রফেসর মহা. হাবিবুর রহমান: শিক্ষক ও গবেষক
  • গোলাম মোস্তফা: বাঙালি লেখক ও কবি
  • রজনীকান্ত সেন: বাংলা সঙ্গীত ও সাহিত্য জগতের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি
  • হাসান আজিজুল হক: প্রখ্যাত অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক
  • শুকুর মাহমুদ: মধ্যযুগীয় কবি
  • রাণী ভবানী: রাজশাহীর জমিদার
  • কাজী আশরাফ উদ্দীন: রাজশাহীর বর্তমান জেলা প্রশাসক

রাজশাহী জেলার পৌরসভা সমূহ

রাজশাহী জেলায় পৌরসভা রয়েছে ১৪ টি।
  • বাঘা পৌরসভা
  • আড়ানী পৌরসভা
  • চারঘাট পৌরসভা
  • পুঠিয়া পৌরসভা
  • কাটাখালী পৌরসভা
  • নওহাটা পৌরসভা
  • কাঁকনহাট পৌরসভা
  • গোদাগাড়ী পৌরসভা
  • মুন্ডুমালা পৌরসভা
  • তানোর পৌরসভা
  • দুর্গাপুর পৌরসভা, রাজশাহী
  • ভবানীগঞ্জ পৌরসভা
  • তাহেরপুর পৌরসভা
  • কেশরহাট পৌরসভা

উপজেলা ও থানা

রাজশাহী জেলা মোট ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। প্রতিটি উপজেলা প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ৯টি উপজেলা হলো:​

  1. পবা
  2. চারঘাট
  3. বাঘা
  4. পুঠিয়া
  5. তানোর
  6. মোহনপুর
  7. দূর্গাপুর
  8. বাগমারা
  9. গোদাগাড়ী​

জেলার মধ্যে মোট ১৩টি থানা রয়েছে, যার মধ্যে ৪টি রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অধীনে। এই থানাগুলো হলো:​

  1. পবা
  2. গোদাগাড়ী
  3. মোহনপুর
  4. বাগমারা
  5. চারঘাট
  6. পুঠিয়া
  7. দূর্গাপুর
  8. বাঘা
  9. তানোর
  10. বোয়ালিয়া (আরএমপি)
  11. রাজপাড়া (আরএমপি)
  12. শাহমখদুম (আরএমপি)
  13. মতিহার (আরএমপি)​

ইউনিয়ন ও গ্রাম

রাজশাহী জেলার মোট ৭২টি ইউনিয়ন রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আওতায় গ্রামীণ উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই ইউনিয়নগুলো বিভিন্ন মৌজা ও গ্রাম নিয়ে গঠিত। জেলার মোট মৌজার সংখ্যা ১,৭১৮টি এবং গ্রাম রয়েছে ১,৯১৪টি।​

পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন

রাজশাহী জেলায় ১৪টি পৌরসভা রয়েছে, যা শহরাঞ্চলের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়াও, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (আরসিসি) শহরের উন্নয়ন ও সেবা প্রদান করে থাকে।​

জনসংখ্যা ও শিক্ষা

রাজশাহী জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩০,২৩,২১৬ জন (২০২০ সালের প্রাক্কলিত তথ্য অনুযায়ী)। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১৫,২৬,৩০২ জন এবং মহিলার সংখ্যা ১৪,৯৬,৯১৪ জন। শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য, এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।​

কৃষি ও অর্থনীতি

রাজশাহী জেলা কৃষি প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে ধান, গম, আলু, আম, লিচু টমেটো, শাকসবজি ও নানা রকমের ফলমূল উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে আম, লিচু ও বরই (কুল) চাষে রাজশাহী অনন্য। রাজশাহীকে বাংলাদেশের “আমের রাজধানী” বলা হয়। রাজশাহী জেলার মোট জমির পরিমাণ ২,৪২,৫৪০ হেক্টর, যার মধ্যে আবাদী জমির পরিমাণ ১,৮১,৩৫১ হেক্টর এবং সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ১,৫৮,১৭২ হেক্টর।​

পদ্মা নদীর কাছাকাছি হওয়ার কারণে সেচ সুবিধা প্রচুর, ফলে কৃষিজ উৎপাদন অনেক বেশি। এখানে বিআরডিবি, কৃষি ব্যাংক, পল্লী উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদি কৃষক সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে।

পরিবেশ ও জলবায়ু

রাজশাহী জেলার জলবায়ু অপেক্ষাকৃত শুষ্ক, এখানে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম পড়ে। এটি দেশের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলের মধ্যে একটি। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠতে দেখা যায়। তবে শীতকালে আবহাওয়া ঠান্ডা ও মনোরম হয়। এছাড়াও, রাজশাহীতে বনায়ন ও সবুজায়ন কার্যক্রম অনেক সফল হয়েছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন পরিবেশবান্ধব সাইকেল চালনার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

রাজশাহী জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। এখানে রেল, সড়ক ও বিমান চলাচল ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাজশাহী শহরে একটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর রয়েছে, যা ঢাকা-রাজশাহী রুটে বিমান চলাচল করে। এছাড়া বাস ও ট্রেন যোগাযোগ খুবই সহজলভ্য।

রাজশাহী জেলা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক অঞ্চল নয়, এটি একটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মডেল। এই জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে একটি প্রাণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যার উন্নয়ন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। রাজশাহী জেলা তার ঐতিহ্য, পরিবেশ, এবং শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে বারবার গর্বিত করেছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই প্রত্যাশা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url