কুরবানির পশু জবাই করার সহি ও সঠিক নিয়ম


কুরবানির শর্ত ও নিয়মাবলি

কোরবানি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ফজিলতময় ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার ইবাদতের জন্য পশু জবাই করাই কোরবানি। ঈদুল আজহার অবিচ্ছেদ্য অংশ কোরবানি। আর কোরবানির অবিচ্ছেদ্য অংশ সুস্থ-সবল পশু। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার ইবাদতের জন্য এই পশু জবাই করার নামই কোরবানি, যা প্রতিটি সামর্থ্যবান নর-নারীর ওপর ওয়াজিব।টাকা-পয়সা, সোনা-রূপার অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, সৌখিন বা অপ্রয়োজনী আসবাবপত্র এসব কিছুর মূল্য কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।

১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ ও নারীর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৭ ভরি সোনা অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার কুরবানি করা ওয়াজিব।

অন্যদিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যখন জবাই করবে, তখন ইহসানের (আসানির) সাথে জবাই করো, আর তোমাদের ছুরিগুলো খুব ভালোভাবে ধারালো করে না-ও, যাতে তোমরা তোমাদের জবাইকৃত পশুকে আরাম দিতে পারো।’ (সহিহ মুসলিম)

পবিত্র কোরআনুল কারিমে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ৩১)

ভাগে কোরবানির নিয়ম

মুসলিম উম্মাহর সার্বজনীন দুইটি উৎসবের অন্যতম একটি কোরবানির ঈদ। ঈদুল আজহার প্রধান আকর্ষণ পশু কোরবানি করা। 

নিজের অর্থে কেনা পশুটি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে জবাই করার মাধ্যমে একজন প্রকৃত মুসলমান মূলত নিজেকে আল্লাহর কাছে সমপর্ণের শিক্ষা নেয়। 

কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না।

যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগেকোরবানি করা জায়েয। (মুসলিম, হাদিস: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)


কোনো অংশীদারের নিয়ত গলদ হলে

অংশীদারদের কেউ যদি আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে, শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে; তাহলে তার কোরবানি শুদ্ধ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে অংশীদারদেরও কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অংশীদার নির্বাচন করা জরুরি। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯)

পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেয়া যাবে না সেগুলো হলো:

  • দৃষ্টিশক্তি না থাকা
  • শ্রবণশক্তি না থাকা
  • অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া
  • এই পরিমাণ লেংড়া যে জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম
  • লেজের বেশির ভাগ অংশ কাটা
  • জন্মগতভাবে কান না থাকা
  • কানের বেশির ভাগ কাটা
  • গোড়াসহ শিং উপড়ে যাওয়া
  • পাগল হওয়ার কারণে ঘাস-পানি ঠিকমতো না খাওয়া
  • বেশির ভাগ দাঁত না থাকা
  • রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে যাওয়া
  • ছাগলের দুটি দুধের যেকোনো একটি কাটা
  • গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোনো দুটি কাটা।

কোরবানির পশু বড় ধরনের দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হবে। হাদিসে এসেছে, চার ধরনের পশু, দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। সেগুলো হলো অন্ধ, রোগাক্রান্ত, পঙ্গু ও যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৪৪)।

যেসব ত্রুটি থাকলেও পশু কোরবানি দেয়া যাবে সেগুলো হচ্ছে :

  • পশুটি পাগল, তবে ঘাস-পানি ঠিকমতো খায়
  • লেজ বা কানের কিছু অংশ কাটা, তবে বেশির ভাগ অংশ আছে
  • জন্মগতভাবে শিং নেই
  • শিং আছে, তবে ভাঙা
  • কান আছে, তবে ছোট
  • পশুর একটি পা ভাঙা, তবে তিন পা দিয়ে সে চলতে পারে
  • পশুর গায়ে চর্মরোগ
  • কিছু দাঁত নেই, তবে বেশির ভাগ আছে।
  • পশু বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম
  • পুরুষাঙ্গ কেটে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে অক্ষম।

তবে সর্ব উত্তম হচ্ছে ত্রুটিমুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি দেয়া, ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি দেয়া অনুচিত।

কোরবানি ও আকিকা একসঙ্গে দেয়া যাবে কি না?

কোরবানির পশু যেকোনো মুসলমান জবাই করতে পারেন। নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবাই করা উত্তম। সেক্ষেত্রে দোয়া জানা জরুরি নয়। নিজে জবাই করতে না পারলে যেকোনো কাউকে দিয়ে জবাই করাতে পারবেন। জবাইয়ের সময় নিজে উপস্থিত থাকতে পারলে ভালো। একটি কোরবানি মানে হলো একটি ভেড়া, ছাগল বা দুম্বা কোরবানি করা। গরু, মহিষ ও উটে অনূর্ধ্ব সাতটি পর্যন্ত অংশ বা ভাগ দেয়া যাবে। আর আকিকা হলো একটি বা দুটি ছাগল কোরবানি করা। সুতরাং গরু, মহিষ বা উটের অংশ হয়ে যেভাবে কোরবানি দেয়া যায়; সেভাবে একটিকে সাতটি ভাগ ধরে সে অংশ হিসেবেও আকিকা দেয়া যায়। কোরবানি ও আকিকা একসঙ্গে করতে কোনো বাধা নেই। ওয়াজিব ও নফল কোরবানির গোশত খাওয়া যায় এবং খাওয়ানো যায়; এটি সবাই খেতে পারেন। তবে উত্তম হলো তিন ভাগের এক ভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেয়া, এক ভাগ গরিব পাড়া-প্রতিবেশীদের দেয়া এবং এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য রাখা।

কোরবানির দোয়া ও পশু জবাইয়ের নিয়ম

নিজ হাতে কোরবানির পশু জবাই: নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা মোস্তাহাব। যদি নিজে জবাই করতে না পারে তবে অন্যের দ্বারা জবাই করাবে। এ অবস্থায় নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামি: ৫/২৭২)

জবাই করার আগে ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়া মোস্তাহাব। কোরবানির পশুকে এমনভাবে জবাই করা উচিত, যাতে পশুর কোনো প্রকার অপ্রয়োজনীয় কষ্ট না হয়। এমনিভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে জবাই করা উচিত। জবাইকারী ব্যক্তির সঙ্গে যদি কেউ ছুরি চালানোর জন্য সাহায্য করে, তার জন্যও ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলা ওয়াজিব। (হেদায়া: ৪/৪৩৮; ইমদাদুল ফতোয়া: ৩/৫৪৭, ফতোয়ায়ে শামি: ৯/৪৭৩)

জবাই করার সময় কোরবানির পশু কেবলামুখী করে শোয়াবে। অতঃপর ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর’ বলে জবাই করবে। ইচ্ছাকৃত বিসমিল্লাহ পরিত্যাগ করলে জবাইকৃত পশু হারাম বলে গণ্য হবে। আর যদি ভুলক্রমে বিসমিল্লাহ ছেড়ে দেয় তবে তা খাওয়া জায়েজ আছে। (হেদায়া: ৪/৪৩৫)

পশু জবাই করার সময় মুখে নিয়ত করা জরুরি নয়। অবশ্য মনে মনে নিয়ত করবে যে আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করছি। তবে মুখে দোয়া পড়া উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামি: ৫/২৭২)

জবাই করার সময় চারটি রগ কাটা জরুরি: ১. কণ্ঠনালি, ২. খাদ্যনালি, ৩. দুই পাশের মোটা রগ, যাকে ওয়াজদান বলা হয়। এই চারটি রগের মধ্যে যেকোনো তিনটি কাটা হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে। কিন্তু যদি দুটি কাটা হয় তবে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (হেদায়া: ৪/৪৩৭)

কোরবানির দোয়া

কোরবানির পশু কেবলামুখী করে শোয়ানোর পর এই দোয়াটি পাঠ করবে- 

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ، اللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ 

‘ইন্নি ওয়াজ জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাবিবল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়ালাকা।’ আবু দাউদ: ২৭৯৫)

এই দোয়া পাঠ করার পর ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে পশু জবাই করবে। পশু জবাই করার পর এই দোয়া পাঠ করবে

—اَللهُمَّ تَقَبَّلْ لَهُ مِنِّى كَمَا تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيْبِكَ مَحَمّدٍ وَّ خَلِيْلِكِ اِبْرَاهِيْم 

‘আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মদ ও খালিলিকা ইবরাহিম।’ যদি একাধিক ব্যক্তি মিলে কোরবানি করে তবে ‘মিন্নি’র স্থলে ‘মিন্না’ পাঠ করবে এবং শরিকদের নাম পাঠ করবে। তবে তাদের নাম শুধু নিয়ত করলে হবে।

অথবা কোরবানি করার সময় এই দোয়া পাঠ করবে

—بسم الله والله أكبر اللهم هذا منك ولك هذا عني اللهم تقبل من فلان وآل فلان 

‘বিসমিল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহুম্মা হাজা মিনকা ওয়া লাকা, হাযা আন্নি। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন... ওয়া আলি।

 (ডট) দেয়া স্থানদ্বয়ে কোরবানীকারীর নাম উল্লেখ করবে।

তবে, এসব দোয়ার মধ্যে কোরবানির সময় শুধু ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ওয়াজিব। বিসমিল্লাহি আল্লাহুআকবর বলা উত্তম। এর অতিরিক্ত যে কথাগুলো আছে সেগুলো বলা মোস্তাহাব; ওয়াজিব বা জরুরি কিছু নয়। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুন্নতের অনুসরণে সঠিক নিয়মে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন। কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম, মুরগি জবাই করার নিয়ম, কোরবানির পশু জবাই করার পদ্ধতি, কোরবানির পশু জবাইয়ের দোয়া, কোরবানির পশু শোয়ানো, গরু জবাই কেবলামুখী

পশুর চামড়া খাওয়া কি জায়েজ?

এর উত্তর হলো- জবেহকৃত হালাল পশুর প্রবাহিত রক্ত ছাড়া সবই হালাল (দ্র: সুরা আনআম: ১৪৫) হালাল পশুর ভুঁড়ি বা বট খাওয়া যেমন হালাল, একইভাবে চামড়া খাওয়াও হালাল। সুতরাং কেউ যদি প্রক্রিয়াজাত করে হালাল পশুর চামড়া খেতে চায়, খেতে পারবে। তবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে বিরত থাকতে হবে। কেননা রাসুল (স.) বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়ো না এবং ক্ষতি করো না। (ইবনে মাজাহ: ২৩৪০; সহিহাহ: ২৫০) (তথ্যসূত্র: ফাতহুল কাদির, সুরা বাকারা: ১৬৮; সুরা মায়েদা: ৮৮; সুরা আনফাল ৬৯; সুরা নামল: ১১৪)

ইসলামে হালাল পশুর যে ৭টি অংশ খাওয়া নাজায়েজ, এর মধ্যে চামড়া নেই। তাই চামড়া খাওয়াকে হারাম বলার সুযোগ নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল পশুর নিষিদ্ধ অংশগুলো হলো- ১. প্রবাহিত রক্ত, ২. অণ্ডকোষ, ৩. গোশত বা চামড়ার মধ্যে সৃষ্ট জমাট মাংসগ্রন্থি, ৪. মূত্রথলি, ৫. পিত্ত, ৬ ও ৭. নর ও মাদির যৌনাঙ্গ। হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) বকরির সাতটি জিনিস অপছন্দ করেছেন: পিত্ত, মূত্রথলি, মাংসগ্রন্থি, নর ও মাদির যৌনাঙ্গ, অণ্ডকোষ, (প্রবাহিত) রক্ত।’ (কিতাবুল আসার: ৮০৮)

যবেহ করার সময় বিশেষ লক্ষণীয় ও কর্তব্য

১। পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। আর তা নিম্ন পদ্ধতিতে সম্ভব;

(ক) সেইরূপ ব্যবস্থা নিয়ে যবেহ করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই সে প্রাণত্যাগ করতে পারে।

(খ) যবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো অস্ত্র দ্বারা হয় এবং তা খুবই শীঘ্রতা ও শক্তির সাথে যবেহস্থলে (গলায়) পোচানো হয়।

  • ফলকথা, পশুর বিনা কষ্টে খুবই শীঘ্রতার সাথে তার প্রাণ বধ করাই উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ প্রত্যেক বস্ত্তর উপর অনুগ্রহ লিপিবদ্ধ (জরুরী) করেছেন। সুতরাং যখন (জিহাদ বা হদ্দে) হত্যা কর তখন উত্তমরূপে অনুগ্রহের সাথে হত্যা কর এবং যখন যবেহ কর তখন উত্তমরূপে অনুগ্রহের সাথে যবেহ কর। তোমাদের উচিত, ছুরিকে ধারালো করা এবং বধ্য পশুকে আরাম দেওয়া।’’

  • বধ্য পশুর সম্মুখেই ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মকরূহ)। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে।’’

  • আর যেহেতু পশুর চোখের সামনেই ছুরি ধার দেওয়ায় তাকে চকিত করা হয়; যা বাঞ্ছিত অনুগ্রহ ও দয়াশীলতার প্রতিকূল।

  • তদনুরূপ এককে অপরের সামনে যবেহ করা এবং ছেঁচ্ড়ে যবেহস্থলে টেনে নিয়ে যাওয়াও মকরূহ।

২। কুরবানী যদি উঁট হয়, (অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়), তাহলে তাকে বাম পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘সুতরাং দন্ডায়মান অবস্থায় ওদের যবেহকালে তোমরা আল্লাহর নাম নাও।’’ (কুঃ ২২/৩৬)

  • ইবনে আববাস (রা.) এই আয়াতের তফসীরে বলেন, ‘বাম পা বেঁধে তিন পায়ের উপর দন্ডায়মান অবস্থায় (নহর করা হবে)।’

  • যদি উঁট ছাড়া অন্য পশু হয় তাহলে তা বামকাতে শয়নাবস্থায় যবেহ করা হবে। যেহেতু তা সহজ এবং ডান হাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। তবে যদি যবেহকারী নেটা বা বেঁয়ো হয় তাহলে সে পশুকে ডানকাতে শুইয়ে যবেহ করতে পারে। যেহেতু সহজ উপায়ে যবেহ করা ও পশুকে আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্য।

  • পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে যবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছন দিকে পা মুচ্ড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ, তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়।

৩। যবেহকালে পশুকে কেবলামুখে শয়ন করাতে হবে। অন্যমুখে শুইয়েও যবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু কেবলামুখ করে শুইয়ে যবেহ করা ওয়াজেব হওয়ার ব্যাপারে কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই।

৪। যবেহকালে আল্লাহর নাম নেওয়া (‘বিসমিল্লাহ’ বলা) ওয়াজেব। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘যদি তোমরা তাঁর নিদর্শনসমূহের বিশ্বাসী হও তবে যাতে (যে পশুর যবেহ করার সময়) আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা আহার কর।’’ (কুঃ ৬/১১৮) ‘‘এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার করো না; উহা অবশ্যই পাপ।’’ (কুঃ ৬/১২১)

  • আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যা খুন বহায় এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর।’’

  • ‘বিসমিল্লাহ’র সাথে ‘আল্লাহু আকবার’ যুক্ত করা মুস্তাহাব। অবশ্য এর সঙ্গে কবুল করার দুআ ছাড়া অন্য কিছু অতিরিক্ত করা বিধেয় নয়। অতএব (কুরবানী কেবল নিজের তরফ থেকে হলে) বলবে, ‘বিসমিল্লাহি অল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা ইন্না হাযা মিন্কা অলাক, আল্লাহুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী।’

  • নিজের এবং পরিবারের তরফ থেকে হলে বলবে,‘---তাক্বাববাল মিন্নী অমিন আহলে বাইতী।’ অপরের নামে হলে বলবে, ‘---তাক্বাববাল মিন (এখানে যার তরফ থেকে কুরবানী তার নাম নেবে)

  • এই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পাঠ করা বিধেয় নয়; বরং তা বিদআত। যেমন ‘বিসমিল্লাহ’র সাথে ‘আর-রাহমানির রাহীম’ যোগ করাও সুন্নত নয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে কোন দলীল নেই। যেমন যবেহ করার লম্বা দুআ ‘ইন্নী অজ্জাহ্তু’ এর হাদীস যয়ীফ।

  • যবেহর ঠিক অব্যবহিত পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ জরুরী। এর পর যদি লম্বা ব্যবধান পড়ে যায়, তাহলে পুনরায় তা ফিরিয়ে বলতে হবে। তবে ছুরি ইত্যাদি হাতে নিয়ে প্রস্ত্ততি নেওয়ায় যেটুকু ব্যবধান পড়ে তাতে ‘বিসমিল্লাহ’ ফিরিয়ে পড়তে হয় না।

  • আবার ‘বিসমিল্লাহ’ শুধু সেই পশুর জন্যই পরিগণিত হবে যাকে যবেহ করার সঙ্কল্প করা হয়েছে। অতএব এক পশুর জন্য ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে অপর পশু যবেহ বৈধ নয়। বরং অপরের জন্য পুনরায় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া জরুরী। অবশ্য ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পর অস্ত্র পরিবর্তন করাতে আর পুনরায় পড়তে হয় না।

৫। যবেহতে খুন বহা জরুরী। আর তা দুই শাহরগ (কন্ঠনালীর দুই পাশে দু’টি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যা খুন বহায়, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ কর। তবে যেন (যবেহ করার অস্ত্র) দাঁত বা নখ না হয়।’’

  • সুতরাং রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ যবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরী; শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুই মোটা শিরা।

৬। প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। অনুরূপভাবে দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে তাহলে আরো কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করা কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যেহেতু অন্যভাবে পশুকে কষ্ট দেওয়া আদৌ বৈধ নয়।

  • পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা (হাঁস-মুরগীকে ঝুড়ি ইত্যাদি দিয়ে) চেপে রাখা যায়।

  • যবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল রাখা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

  • যবাই করে ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোন পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় যবাই করা যায়। নতুবা কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে। আর তা হালাল।

  • প্রকাশ থাকে যে, যবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা যবেহকারীকে পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যেমন মাথায় টুপী রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। অবশ্য বিশ্বাস ও ঈমানের পবিত্রতা জরুরী। সুতরাং কাফের, মুশরিক (মাযার বা কবরপূজারী) ও বেনামাযীর হাতে যবেহ শুদ্ধ নয়।

  • যেমন যবেহ করার আগে কুরবানীর পশুকে গোসল দেওয়া, তার খুর ও শিঙে তেল দেওয়া অথবা তার অন্য কোন প্রকার তোয়ায করা বিদআত।

  • প্রকাশ থাকে যে, যবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম। অতএব তা কোন ফল লাভের উদ্দেশ্যে পায়ে মাখা, দেওয়ালে ছাপ দেওয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি করে খেলা করা বৈধ নয়।

  • (মুসলিম ১৯৫৫নং)
  • (মুসনাদ আহমাদ ২/১০৮, ইবনে মাজাহ ৩১৭২নং, সহীহ তারগীব ১/৫২৯)
  • (তাফসীর ইবনে কাষীর)
  • (আবূ দাঊদ, ইবনে মাজাহ ২/১০৪৩, হাদীসটির সনদে সমালোচনা করা হয়েছে)
  • (আহকামুল উযহিয়্যাহ ৮৮,৯৫পৃঃ)
  • (বুখারী ২৩৫৬, মুসলিম ১৯৬৮নং)
  • (মানাসিকুল হাজ্জ, আলবানী ৩৬পৃঃ)
  • (আল-মুমতে ৭/৪৯২)
  • (যয়ীফ আবূ দাঊদ ৫৯৭নং)
  • (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম প্রভৃতি, সহীহুল জামে’ ৫৫৬৫নং)
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url