সুস্থ থাকতে দিনে কয়টি ডিম খাবেন? – জানুন ডিমের পুষ্টিগুণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত


ডিম একটি আদর্শ পুষ্টিকর খাবার, যা বিশ্বজুড়ে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ডিমকে “নেচার’স পারফেক্ট ফুড” বলে থাকে। এটি এমন একটি খাবার যেখানে প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান — প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, চর্বি ও প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড।

তবে অনেকেই প্রশ্ন করেন — “প্রতিদিন কয়টি ডিম খাওয়া নিরাপদ?” বা “ডিমে থাকা কোলেস্টেরল কি ক্ষতিকর?”। এই আর্টিকেলে আমরা বিস্তারিত জানব ডিমের গঠন, উপকারিতা, সঠিক পরিমাণ, এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সম্পর্কে।

ডিম সম্বন্ধে বিস্তারিত

ডিম সাধারণত দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত —

  1. Egg White (অ্যালবুমেন) – এটি ডিমের সাদা অংশ, যা মূলত প্রোটিন ও পানি দিয়ে তৈরি।
  2. Egg Yolk (কুসুম) – হলুদ অংশটি, যেখানে থাকে ফ্যাট, কোলেস্টেরল, ভিটামিন ও মিনারেল।

ডিম মূলত হেন বা মুরগির ডিম, তবে হাঁস, কোয়েল বা রাজহাঁসের ডিমও অনেক দেশে জনপ্রিয়।

একটি মাঝারি মাপের ডিমের ওজন প্রায় ৫০–৬০ গ্রাম এবং এতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান থাকে।

ডিমের পুষ্টিগুণ

একটি মাঝারি ডিমে যে পরিমাণ পুষ্টি থাকে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। নিচে প্রতিটি ডিমের আনুমানিক পুষ্টি উপাদান দেওয়া হলো:

১টি মাঝারি ডিমে যেসকল উপকারিতা থাকে তা নিচে দেওয়া হলো:

উপাদান: ৭০–৮০ ক্যালোরি, প্রোটিন ৬–৭ গ্রাম, ফ্যাট ৫ গ্রাম, কোলেস্টেরল ১৮৬ মি.গ্রা. , ভিটামিন A, D, E, B12 সামান্য পরিমাণ, মিনারেল (আয়রন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক) যথেষ্ট।

উপকারিতা: শক্তি প্রদান, পেশি গঠন ও মেরামত, শক্তি ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, কোষ ও হরমোন তৈরিতে প্রয়োজনীয়, চোখ, হাড় ও স্নায়ুর জন্য উপকারী, ইমিউন সিস্টেম ও রক্ত তৈরিতে সহায়তা করে।

ডিমের প্রোটিনকে বলা হয় “Complete Protein”, কারণ এতে সব ধরনের অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড বিদ্যমান।

ডিমের স্বাস্থ্য উপকারিতা

পেশি গঠনে সহায়তা করে: ডিমে থাকা উচ্চমানের প্রোটিন শরীরের পেশি, চুল, নখ ও টিস্যু পুনর্গঠনে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যায়ামকারীদের জন্য ডিম একটি আদর্শ খাবার।

মস্তিষ্কের জন্য ভালো: ডিমে থাকা কোলিন (Choline) নামক উপাদান মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে, স্মৃতিশক্তি বাড়ায় এবং স্নায়ুর বিকাশে সাহায্য করে।

চোখের দৃষ্টি উন্নত করে: ডিমের কুসুমে রয়েছে লুটিন ও জিয়াজ্যান্থিন, যা চোখের রেটিনা সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে এবং বয়সজনিত চোখের সমস্যা (যেমন: ছানি বা ম্যাকুলার ডিজেনারেশন) প্রতিরোধ করে।

হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়: যদিও আগে ধারণা ছিল ডিমে থাকা কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে পরিমিত ডিম খাওয়ায় হৃদরোগের ঝুঁকি বরং কমে।

হাড় মজবুত রাখে: ডিমে থাকা ভিটামিন D ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করে, যা হাড় ও দাঁতের জন্য অপরিহার্য।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে: সকালের নাস্তা হিসেবে ডিম খেলে দীর্ঘ সময় ক্ষুধা লাগে না। এতে ক্যালোরি কম কিন্তু প্রোটিন বেশি, ফলে ওজন কমাতে সহায়ক।

কীভাবে ডিম খাবেন?

ডিম খাওয়ার পদ্ধতি ও সময়ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভুলভাবে খেলে উপকারের বদলে ক্ষতিও হতে পারে। নিচে সঠিক উপায়গুলো দেওয়া হলো —

সকালের নাস্তায় ডিম: দিনের শুরুতে এক বা দুইটি সিদ্ধ বা অমলেট করা ডিম খেলে দীর্ঘ সময় ক্ষুধা লাগবে না, শরীরে শক্তি বজায় থাকবে।

সিদ্ধ ডিম (Boiled Egg): সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি হলো সিদ্ধ ডিম খাওয়া। এতে তেল ব্যবহার হয় না, ফলে ক্যালোরি বাড়ে না।

পোচ বা ওমলেট: অল্প তেলে পোচ বা ওমলেট করলে প্রোটিনের মান বজায় থাকে, তবে অতিরিক্ত তেল বা মশলা ব্যবহার এড়িয়ে চলা ভালো।

কাঁচা ডিম এড়িয়ে চলুন: অনেকে ব্যায়ামের পর কাঁচা ডিম খান, কিন্তু এটি ঝুঁকিপূর্ণ। কাঁচা ডিমে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা খাদ্য বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।

ডিমে থাকা কোলেস্টেরল ভালো না খারাপ?

এটি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত প্রশ্ন।

একটি মাঝারি ডিমে প্রায় ১৮৬ মিলিগ্রাম কোলেস্টেরল থাকে, যা মূলত ডিমের কুসুমে থাকে। আগের ধারণা ছিল যে এই কোলেস্টেরল রক্তে LDL (খারাপ কোলেস্টেরল) বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে —

  • ডিম খাওয়ার ফলে বেশিরভাগ মানুষের রক্তে HDL (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়ে।
  • শরীর নিজেই প্রয়োজন অনুযায়ী কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে।
  • যারা প্রতিদিন ১–২টি ডিম খান, তাদের হৃদরোগ বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে না।

অর্থাৎ, ডিমে থাকা কোলেস্টেরল ক্ষতিকর নয়, বরং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়।

কি বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা ডিম সম্পর্কে ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি: হার্ভার্ডের গবেষণায় বলা হয়, দিনে একটি ডিম খাওয়া নিরাপদ, এবং এটি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় না।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (AHA): AHA-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, “সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন ১টি পূর্ণ ডিম (whole egg) খেতে পারেন। যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, তারা সপ্তাহে ৩–৪টি ডিম সীমিত রাখতে পারেন।”

বাংলাদেশের পুষ্টিবিদদের মত: বাংলাদেশের পুষ্টিবিদরা বলেন,

“ডিম হলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্রোটিন উৎস। শিশু, কিশোর, গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধ — সবার জন্য ডিম উপকারী, তবে রান্নার সময় তেলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।”

দিনে কয়টি ডিম খাওয়া উচিত?

  • সাধারণ সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি: দিনে ১ থেকে ২টি ডিম খাওয়া নিরাপদ ও উপকারী।
  • শিশু ও কিশোর: বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রতিদিন ১টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন।
  • খেলোয়াড় বা জিমে যাওয়া ব্যক্তি: প্রতিদিন ২–৩টি ডিম (১টি কুসুমসহ, বাকিগুলো শুধু সাদা অংশ) খাওয়া যেতে পারে।
  • যাদের রক্তে কোলেস্টেরল বা হৃদরোগের ইতিহাস আছে: সপ্তাহে ৩–৪টি ডিম সীমিত রাখা ভালো, এবং ডিমের সাদা অংশ বেশি খাওয়া উচিত।

ডিম খাওয়ার কিছু সতর্কতা

যদিও ডিম অত্যন্ত পুষ্টিকর, কিছু ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার —

  • কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ ডিম খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • রেফ্রিজারেটরে রাখলেও মেয়াদোত্তীর্ণ ডিম ব্যবহার করবেন না।
  • ডিম রান্নার আগে ও পরে হাত ভালো করে ধুয়ে নিন।
  • প্রতিদিন অতিরিক্ত ডিম খেলে ওজন ও ফ্যাট বেড়ে যেতে পারে।

পরিশেষে ডিম হলো প্রকৃতির উপহারস্বরূপ একটি সম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাবার। এতে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল ও উপকারী ফ্যাট।

প্রতিদিন ১–২টি ডিম খেলে —

  • শরীর পায় প্রয়োজনীয় শক্তি,
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে,
  • হাড় ও পেশি শক্তিশালী হয়,
  • চোখ, মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে।

তাই ভয় না পেয়ে ডিম খান নিয়ম মেনে, স্বাস্থ্যকর উপায়ে। মনে রাখবেন — “প্রতিদিন একটি ডিম, সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা।”

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url