গাঁইয়া বউ । পর্ব ১ ও ২
ডাক্তার,আমি এখন বাচ্চা চাইনা।আপনি Abortion এর ব্যবস্থা করুন।
বরের মুখ থেকে আগত এই কথা টুকুই যথেষ্ট,আনন্দময় হাসি টুকু কান্নায় পরিণত হবার জন্য।
আমার বর আমাকে কখনোই মন থেকে ওর স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি।কারণ আমি তার কাছে গাঁয়ের মেয়ে এবং অশিক্ষিত।গ্রাম থেকে আমি মাত্র এস.এস.সি পাশ করেছি। ওর কাছে আমি গাঁইয়া বউ।
বিয়েটা ও ওর বাবা মায়ের পছন্দে করেছে।আমার বাবা আর ওর বাবা দুজন বন্ধু ছিলেন।পরে ওর বাবা শহরে চলে আসেন।এখানেই থেকে যান।বন্ধুত্বটা পোক্ত করতে আমাদের বিয়ে দেন।
অপূর্ব যে আমাকে পছন্দ করেনি বা তার অমতে যে বিয়ে হয়েছে এসবের কিছুই আমি জানতাম না।
আমি যখন দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে বাসর ঘরে বউ সেজে বসে ছিলাম অপূর্বের অপেক্ষায়।ঠিক তখনি সে আমার স্বপ্ন গুলোকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করে দিয়ে বলে দিয়েছিলো,কোন দিন তুমি আমার কাছে স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আসবেনা।আমি তোমায় সেই অধিকার দিতে পারবোনা।ঘুমিয়ে পড়ো।আমি সোফায় ঘুমিয়ে নিবো।
ঢাকার শহরের যানজটের ভীড়ে এসে বন্দি হলাম আমি মুক্ত এক পাখি।
অপূর্বকে চাকুরীর জন্য বাবা মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়।এ বাসায় আমি আর অপূর্বই দুজন মানুষ মাত্র।
ও সকালে অফিসে চলে যায়,রাতে আসে।
সারাদিন বন্দি পাখির মত দিন কাটে আমার।সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাংসারিক কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকি বলে অতটা খারাপ লাগেনা।সব কাজ একাই করি,দুজন মানুষ মাত্র কাজই বা কি?ঘর গোছানো,ঝাড়পোছ,রান্না বান্না,কাপড় চোপর ধোয়া।S.S.C পরীক্ষার পর যেই সময়টায় ছুটি ছিলো,সেই সময়টায় রান্নাটা শিখে নিয়েছি।তাই রান্না করতেও কষ্ট হয়না আমার।ভালোই লাগে তার জন্য রান্না করতে।
বিয়ের পর আমি শাড়ী পরি।শুনেছি বর রা নাকি শাড়ী পরলে খুব খুশি হয়।
তাই আমিও শাড়ী পরা শিখে নিয়েছি।কিন্তু আমার বর তো আমাকে চেয়েও দেখেন না।কি জানি,হয়তো আমাকে তার ভালোই লাগেনা।
আজ তার জন্য আমি খুব সুন্দর করে সেজেছি।
চোখে কাজল দিয়েছি,হাতে রেশমি চুড়ি পরেছি,ঠোঁটে লিপ্সটিক দিয়েছি।
আর তার পছন্দের কালো রঙের শাড়ী পরেছি।
কলিংবেল বাজছে,উনি এসে গেছেন।
দরজা খুলে দিলাম,কিন্তু উনি আমার দিকে না তাকিয়েই রুমে চলে গেলেন।থাক তাতে কি?
আজ আমি তার জন্য তার পছন্দের খাবার ও রান্না করেছি।
হঠাৎ তার ডাক।
~অর্না এই অর্না।
~জ্বী আসছি।
~তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যেও।আমি আমার বন্ধুদের সাথে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।
কেন যেন চোখের কোণে জল এসে গেলো।
~জ্বী আচ্ছা।
না খেয়েই শুয়ে পরলাম।খুব কান্না পাচ্ছে আজ।কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।
সকাল হয়েছে,কিন্তু অপূর্ব আজ উঠেনি কেন?সেতো আরো সকালে উঠে যান।
তবে কি তার শরীর খারাপ?
ভাবতে ভাবতেই তার কাছে গিয়ে কপালে হাত দিলাম,দেখি প্রচুর জ্বর।
হঠাৎ করে এতো জ্বর এলো কি করে?
তাড়াতাড়ি জল পট্টি দেয়া শুরু করলাম।অপূর্ব হঠাৎ চোখ খুলে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।
~এই মেয়ে এই!কি পেয়েছো কি তুমি?তোমাকে না বলেছি আমার কাছে আসবেনা।
~না মানে আপনার জ্বর।
~চুপ একদম চুপ!আমার জ্বর হোক বা আমি মরে যাই,তাতে তোমার কি?একদম অধিকার ফলাতে আসবেনা।গাঁইয়া কোথাকার।
কথা গুলো শুনে আমার চুপ চাপ চোখে জল নিয়ে সরে যাওয়া ছাড়া আর কি ই বা করার আছে।
নাস্তা রেডি করে টেবিলে রেখেছি।
কিন্তু সে না খেয়েই চলে গেলেন।আমারো আর খাওয়া হলোনা।
সারাটা দিন খুব খারাপ লাগছে আমার।তার কথা মনে হচ্ছে,তার শরীর কেমন লাগছে।এখনো কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?ভাবলাম একটা ফোন দেই।
কিন্তু পরে মনে হলো,না।উনি রাগ করবেন।
রাতের অপেক্ষায় আমি।কখন সে ফিরবেন।আর আমি তাকে একটু দেখবো।
কলিংবেল বাজছে।উনি এসে গেছেন।ভিজে একাকার।বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।
~শরীর মুছে,হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।খেতে দিচ্ছি।
~আচ্ছা।
খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা দুজনি শুয়ে পরলাম।
হঠাৎ জোরে এক শব্দ হয়ে বিদ্যুৎ চমকালো।আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে তার কাছে গেলাম।
~এই কি হয়েছে তোমার?কাঁপছো কেন?
~আমার খুব ভয় হচ্ছে।
আবার বিদ্যুৎ চমকালো,আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
সে প্রথমে আমাকে না ধরলেও,কিছু ক্ষণ পর আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।
দিলেন আমাকে স্ত্রীর অধিকার।
আজকের সকাল টা অন্যরকম মনে হচ্ছে,
স্তব্ধ নগরী আজ প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে।
আমি গোসল করে রেডি হয়ে কিচেন রুমে গিয়ে রান্না করছি।
পেছন থেকে সে আসছেন অনুভব করছি।
~অর্না।
~জ্বী।
~কালকের রাতের জন্য আমি সরি।আমি আসলে বুঝে উঠতে পারিনি কিছু।
কি হতে কি হয়ে গেছে।আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি অফিসে যাচ্ছি।খেয়ে নিও।
অথচ আমি ভেবেছিলাম সে এসে আমাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলবে ভালবাসি।কিন্তু এ আমি কি শুনলাম?
একই ছাদের নিচে চলছে আমাদের জীবন।কিন্তু দুজন দুজনের খুব যেন অচেনা।পাশাপাশি থেকেও নেই যেন কাছাকাছি।
এভাবে ২ মাস কেটে গেলো,হঠাৎ একদিন রাতে আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
আর অপূর্ব দ্রুত ডাক্তারকে ফোন করে আনলেন।
ডাক্তার আমাকে দেখে বল্লেন,
মিঃ অপূর্ব!গুড নিউজ।আপনার স্ত্রী মা হতে চলেছে।
আর আপনি বাবা।
এ কথা শুনে যেন আমার খুশির অন্ত নেই।কিন্তু আমার ঠোঁটের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেলো যখন অপূর্ব বলে উঠলো,
~ডাক্তার,আমি এখন বাচ্চা চাইনা।আপনি Abortion এর ব্যবস্থা করুন।
~এ কি বলছেন আপনি?(ডাক্তার)
~জ্বী,আমি এ বাচ্চা এখন চাইনা।(অপূর্ব)
~কিন্তু আমি চাই।(আমি)
আচ্ছা আপনারা দুজনই ভাবুন আপনারা কি করতে চান।তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিন।
আমি আসি।(ডাক্তার)
শোনো অর্না,
যেখানে আমাদের সম্পর্কেরই কোন ঠিক নেই সেখানে এই বাচ্চাকে কিভাবে আমরা এই দুনিয়ায় আনি?
~আমি আমার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাবো।
~আমি তোমাকে আজো আমার স্ত্রী হিসেবে মানতে পারিনি।আমার কাছে তুমি সেই গাঁইয়া বউ ই।
আমি পারবো না এ সন্তানকে এক্সেপ্ট করতে।
যেখানে তোমাকেই আমি এখনো এক্সেপ্ট করতে পারিনি,সেখানে এই সন্তানকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব না।
~তাহলে আপনি কি চান?
~আমি চাই তুমি বাচ্চাটাকে Abortion করে ফেলো।আমি যদি কোন দিন তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মনে জায়গা দিতে পারি তবে তখন বাচ্চার চিন্তা করা যাবে।এখন নয়।
~এটাই আপনার শেষ কথা?
~হ্যাঁ এটাই আমার শেষ কথা।আমার সাথে থাকতে হলে এই সন্তান তুমি রাখতে পারবেনা।ভেবে দেখো এখন তুমি কি করবে।
সারা রাত ভাবলাম আমি কি করবো?স্বামীর সংসার করবো?নাকি করবো আমার সন্তানকে হত্যা?
সকাল হলো,
~অর্না অর্না।কোথায় তুমি?
সারা বাড়ী খুঁজে অপূর্ব শুধু একটা চিঠি পায়।
অপূর্ব
আমি জানি আপনার পক্ষে আমার এই গর্ভের সন্তানকে মেনে নেয়া সম্ভব না।কিন্তু আমি মা হয়ে কি করে আমার সন্তানকে হত্যা করবো বলতে পারেন?
তাই আমি এ সংসার ছেড়ে আমার সন্তানকেই বেছে নিলাম।আপনি ভালো থাকবেন।আর আমার বিশ্বাস একদিন আপনি আপনার ভুল ঠিকই বুঝতে পারবেন।আর আপনি আমার সন্তানকে মেনে নিবেন।আর একটা কথা,জানিনা কখন কিভাবে আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি।খুব বেশি ভালবাসি আপনাকে আমি অপূর্ব।নিজের খেয়াল রাখবেন।
ইতি
আপনার গাঁইয়া বউ।
কেটে গেলো একটা মাস।অপূর্বের কোন খবর নেই।
আমি আমার বাবার বাড়ীতে চলে আসি,
অপূর্বের মা বাবা আমার খবর নিলেও সে আমার কোন খবর নেয়না।
তার বাবা মা আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখেন,খোঁজ খবর নেন।
এদিকে আমার আম্মু আব্বুও আমার খুব যত্ন নিচ্ছেন।
এখানে একটা স্কুলে আমি বাচ্চাদের পড়াই।বাচ্চারা আমাকে খুব ভালবাসে।ওদের মুখ দেখেই নিজের কষ্ট গুলো কিছুটা ভুলে থাকি।
দিন যাচ্ছে,সময় চলে যাচ্ছে।
আর আমি শুধু অপেক্ষায় আছি অপূর্বের।কবে সে আমায় একটা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস কবে আমি কেমন আছি,
কিন্তু ও আমার কোন খবর নেয়না।
দেখতে দেখতে কত গুলো মাস কেটে যায়,
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে,
তবুও সে আসেনা।
আমার ডেলিভারি ডেইট চলে আসে।
আজ আমার সিজার হবে,
জানিনা আমি বেঁচে ফিরবো কিনা।
দেখতে পারবো কিনা আমার মেয়ের মুখ।
ও হ্যাঁ, আমার মেয়ে হবে।
কিছু দিন আগে আমার হঠাৎ করেই পেটে ব্যথা হয়।তাই আল্ট্রা করা লাগে,আল্ট্রা করার পর জেনেছিলাম আমি কন্যা সন্তান জন্ম দিবো।
অনেক খুশি হয়েছিলাম আমি।
কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হলো,
আমার মেয়ের জীবন টাতো আবার আমার মত হবেনা?
না না,আমার মেয়েকে আমি স্মার্ট করে তুলবো,শিক্ষিত করে তুলবো।কেউ যেন ওর দিকে আঙুল তুলতে না পারে।
একটু পরেই আমাকে অটিতে নিবে।অপেক্ষা করছিলাম অপূর্বের।ইশ আজ অন্তত ও যদি আমাকে একটু দেখতে আসতো।ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আর আমার মেয়েটাকেও,জানিনা কোলে নিতে পারবো কিনা আমি আমার মেয়েটাকে,
আমি আমার মেয়েটাকে অনেক ভালবাসি।ওর জন্যই তো আমি আমার সব ছেড়ে ওকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি।ওই আমার শেষ অবলম্বন।ওকে নিয়েই আমি বাঁচতে চাই বাকিটা জীবন।
ডায়েরীটায় এই পর্যন্তই লিখা ছিলো।
চলবে…
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com