Breaking News

গোধূলীর আলোয় । পর্ব -৩৮



পরেরদিন সকালবেলা আয়মান কিছুতেই মিথিলাকে ছাড়ছেনা। বুকে চেপে রেখে দিয়েছে। বগুড়া যেতেও তার একদম ইচ্ছা করছেনা গর্ভবতী বউটাকে রেখে।আয়মান মিথিলাকে আরো বুকে চেপে ধরে বললো,
“বউ?”
“হুম”
“ও বউ?
“কি?”
“তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো? আমার টুনটুনি, টুনটুনাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবো?”
“যেমন ভাবে এতদিন ছিলেন তেমন ভাবেই।”
আয়মান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“অনেক কষ্ট করে থেকেছি, তোমাকে ছাড়া, পরিবার ছাড়া খুব কষ্ট লাগে ওখানে আচ্ছা না গেলে হয় না?”
“হবে না কেনো? অবশ্যই হবে তবে জিবনে ভালো থাকার জন্য একটু পরিশ্রম, একটু কষ্ট তো করতেই হবে। আপনি তো বেশি দূরে থাকছেননা, বগুড়া এখান থেকে এখানেই। চাইলেই যেকোন সময় চলে আসতে পারবেন। যারা দূরে থাকে বা যারা দেশের বাইরে থাকে তাদের কথা একবার ভাবেন! তারা কত বছরের জন্য নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের পরিবার ছেড়ে, কাছের মানুষকে ছেড়ে, আত্মীয়-স্বজনকে ছেড়ে অন্য দেশে থাকে, কত কষ্ট করে। বিশেষ কোন দিন যেমন, ঈদে পর্যন্ত তারা পরিবারের সাথে থাকতে পারেনা।”
আয়মান মিথিলার কপালে একটা চুমু দিয়ে আবার মিথিলাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
“ঠিক বলেছো। তোমার কথাগুলো শুনে আমার অনেক শান্তি লাগছে এই মুহূর্তে সাথে গর্বও হচ্ছে এই ভেবে যে, আল্লাহ তোমাকে আমার জীবনসঙ্গী করেছে। ‘আলহামদুলিল্লাহ’! আমি অনেক ভাগ্যবান। এমন বুঝদার একটা মানুষ আমার জীবনসঙ্গী। আল্লাহকে অনেক শুকরিয়া তোমাকে আমার কাছে এনে দিয়েছে সেজন্য। দেশের বাইরে যারা থাকে তাদের জন্য সত্যিই খারাপ লাগে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে থাকে জীবনে নিজে একটু ভালো থাকার জন্য, পরিবারকে ভালো রাখার জন্য।”
“হুম।”
“তোমার আমাকে মনে পড়েনা?”
“কে বললো পড়ে না? সবসময় মনে পড়ে। খারাপ লাগে তবে সেটাকে পাত্তা দিইনা কারণ আমাদের সুখের জন্যই তো দূরে আছেন।”
আয়মান মিথিলার কপালে আবার ভালোবাসা এঁকে দিলো। নিজের বাহুডরে শক্ত করে আগলে নিয়ে বললো,
“সাবধানে থাকবে, আমার আব্বাজান, আম্মাজানের খেয়াল রাখবে সাথে নিজেরও।”
“আপনিও সাবধানে থাকবেন, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করবেন। ঘুমাবেন ঠিক সময়ে।”
“হুম, আমি চেষ্টা করছি এখানে ট্রান্সফার হওয়ার জন্য তবে এবার আরো চেষ্টা করবো। আমার জানটাকে এভাবে, এই অবস্থায় ফেলে আমি দূরে থেকে কিছুতেই কাজে মনোযোগ দিতে পারবোনা।”
“সে দেখা যাবে, এখন বের হোন। দেরি হয়ে যাচ্ছেনা!”
“হ্যাঁ চলো।”
আয়মান তার বউকে আরেকটু আদর-সোহাগ করে বাইরে আসলো। বাবা-মা, দাদি, বোনের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো বগুড়ার উদ্দেশ্যে।তার আগে মিথিলাকে তার কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলো।
মিতু খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে মিথিলাকে বললো,
“আমরা তাহলে খালামনি হয়েই গেলাম। কিযে ভালো লাগছে। মিথিলা আজ তুই আমাদের ফুচকা খাওয়াবি বিকালে।”
“আমি কেনো খাওয়াবো? খাওয়াবি তোরা আমাকে।”
“আমরাও খাওয়াবো। কি খেতে ইচ্ছা করছে তাই বল?”
“আন্টিকে ফোন দিয়ে বল আমার জন্য আচার পাঠাতে।আচার খেতে ইচ্ছা করছে আন্টির হাতের।”
“আচ্ছা বলবো। খুব জলদি যেনো পাঠিয়ে দেয়। বিকালে কিন্তু তুই আমাদের ফুচকা খাওয়াবি।”
“আচ্ছা খাওয়াবো। ফুচকাই শুধু, অন্য কিছু পারবোনা।”
“অন্য কিছু খাবো না। শুধু ফুচকা পেট ভরে খাওয়ালেই হবে।”
“পেট ভরে মানে? এত গুলোর পেট ভরাতে গেলে কত টাকা খরচ হবে জানিস?”
“হোক খরচ, তুই খাওয়াবি ব্যস।”
“দুপুরে বেশি করে ভাত খাবি। রাতের আগে যেনো হজম না হয় এমনভাবে।”
“ওওওও,,, তাহলে কম টাকা লাগবে তোমার তাইনা?”
“বুঝছিস যখন তখন বলছিস কেনো?”
“আজ দুপুরে ভাত নাহয় খাবো না। ওই সবাই শোন, কেউ আজ ভাত খাবি না।”
“তোর কথা কেউ শুনবেনা।”
“যতক্ষণ আমরা খাবো ততক্ষণ তুই কিনে দিবি ব্যাস।”
আছরের নামাজ পড়ে সবাই তৈরি হয়ে গেলো ফুচকা পার্টিতে যাওয়ার জন্য। পার্টিটা হবে পর্দ্মা গার্ডেনের ওইদিকে। কোন আয়োজন ছাড়া হঠাৎ পার্টি। পাঁচজন কেউ বোরখা,কেউ আবায়া পড়ে তৈরি হয়ে গেলো। সবাই দল বেঁধে এসে গেইটের কাছে দাঁড়ালো। নিপা একটা অটো ঠিক করলো।পাঁচজন যখন অটোতে আরাম করে বসলো তখন অটোর সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে এসে বসলো নিলয়। নিপা নিলয়কে বললো,
“এক্সকিউজ মি! কে আপনি? এভাবে আমাদের অটোতে উঠলেন কেনো?”
নিলয় সামনের দিকে তাকিয়েই বললো,
“আপনাদের মানে, বুঝলামনা?”
“আমাদের মানে আমাদের, উই রেন্টেড দিস অটো।”
“ওকে, আপনারা ভাড়া নিয়েছেন আমিও ভাড়া নিলাম। আপনারাও ভাড়া দিবেন আমিও ভাড়া দিয়ে দিবো! এখন বেশি কথা না বলে মুখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকেন।”
“আমরা অন্য কাউকে নিবো না।”
“কেনো?”
“আমরা পাঁচজনই থাকবো, আপনি নেমে যান।”
“না নামলে কি করবেন?”
“না নামলে আমরাই নেমে যাবো। ওই সব নাম।”
মিথিলা এবার কথা বললো,
“নিপা আপু কি শুরু করলে? চুপচাপ বসো তো। নিলয় ভাইয়া, তুমিও চুপচাপ বসে থাকো।”
নিলয় নাম শুনেই নুসরাতের মায়াবী মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। রাগে থমথমে হয়ে গেলো। নিলয় এবার ঘাড় ঘুড়িয়ে নুসরাতের দিকে তাকালো। নুসরাতের ঠোঁট কাঁপছে, চোখ জ্বলজ্বল করছে।নিলয় একটা চোখ টিপি দিলো। নিপা হে হে করে দাঁত মেলিয়ে বললো,
“ওমা, আগে বলবিনা মিথিলা যে নিলয় ভাইয়া এইটা।সরি ভাইয়া! আপনার মুখটা দেখেছিলাম না তো তাই…!”
নিলয় নুসরাতের রাগে লাল হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“ইট’স ওকে! আমি কিছু মনে করিনি।”
অটো চলতে শুরু করেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে অটো এসে থামলো। সবাই নেমে পড়লো। সব শেষে নামলো নুসরাত। নিলয় নুসরাতের পাশে এসে দাঁড়ালো।প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে টাকা বের করে অটো ভাড়া দিলো। নুসরাত বললো,
“আমার ভাড়া আমি দিচ্ছি।”ব্যাগ থেকে টাকা বের করে অটোওয়ালাকে দিতেই নিলয় বাঁধা দিলো।
“আমি তোমারটাও দিয়ে দিয়েছি। চলো যাই।”
অটোওয়ালা অটো নিয়ে চলে গেলো। নিলয় সামনের দিকে হাঁটা দিলো কিন্তু নুসরাত সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। ভাড়া দেওয়ার জন্য যে টাকাটা ব্যাগ থেকে বের করেছিলো সেই টাকাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ইচ্ছা মত দুমড়ালো।
সবাই সামনের দিকে চলে গিয়েছিলো। মুক্ত মঞ্চের কাছে গিয়ে সুমনা বললো,
“নুসরাত আপু কোথায়? ওই তো,ওখানেই দাঁড়িয়ে আছ বলে সুমনা জায়গাটায় আঙ্গুল দিয়ে তাক করলো। তোমরা দাঁড়াও, আমি আপুকূ নিয়ে আসি।”
সুমনা নুসরাতের কাছে গেলো। অনেক বুঝিয়ে নুসরাতকে নিয়ে আসলো। সবাই যখন এক সাথে ফুচকা খেতে ব্যস্ত সে সময় নুসরাতকে দেখতে ব্যস্ত নিলয়।নিলয় ওভাবে তাকিয়ে থাকায় নুসরাতের আনইজি লাগছিলো তাই সে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলো। তাকাতে তাকাতে এক সময় নুসরাতের চোখটা পাশের টেবিলে আটকে গেলো। নুসরাত দেখলো একটা ছেলে একটা একটা মেয়ে খুব যত্ন করে চটপটি খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা লজ্জ্বায় বার বার নিষেধ করছে না খাওয়াতে, ছেলেটা শুনছেনা। নুসরাতের দৃষ্টি অনুযায়ী নিলয়ও সেদিকে তাকালো।মুচকি হেসে নুসরাতকে বললো,
“বিয়েতে রাজি হয়ে যাও, আমিও এভাবে তোমাকে খাইয়ে দিবো।”
নিলয়ের কথা শুনে নুসরাত সহ উপস্থিত সবাই নিলয়ের দিকে তাকালো। নিলয় সবাইকে পাশের টেবিল ইশারা করে দেখালো। সুমনা পাশের টেবিলের দুই কপোত-কপোতিকে দেখে আফসোসের সুরে বললো,
“আমি কবে পাবে তারে? আমাকে কবে এভাবে মুখে তুলে খাওয়াবে?”
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আল্লাহ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাহারে আমার কাছে পাঠাইয়া দাও আল্লাহ। তাকে বলো, সুমনা তার জন্য খালি হাতে অপেক্ষা করছে, সে আসলে এত্ত এত্ত শপিং করে হাত ভর্তি করবে বলে। খালি পেটে অপেক্ষা করছে, তার টাকাই দামি রেস্টোরেন্টে খাবে বলে।ভ্যালেন্টাইন ডে, রোজ ডে, চকলেট ডে, কিস ডে, হাগ ডে সহ আরো যত ডে আছে সব পালন করবে বলে। “
সুমনার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। গোমড়া মুখো নুসরাতো ফিক করে হেসে উঠলো। নিলয় এক হাত নুসরাতের কাছে নিয়ে গিয়ে নুসরাতের মহা মুল্যবান হাসিটা মুঠো বন্দি করে নিলো। নিলয়ের এই কাজেও সবাই হেসে উঠলো শুধু নুসরাত ছাড়া। নুসরাত নিলয়ের এমন কান্ডে একটু লজ্জ্বায় পেয়ে গেলো। লজ্জ্বা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।
সূর্যি মামা ঘুমাতে যাবে বলে অস্থির হয়ে আছে। অনুও অস্থির হয়ে রিকশা খুঁজছে বাসায় যাবে বলে। বাজারে এসেছে অনু কিছু দরকারি জিনিস কেনার জন্য। কেনাকাটা শেষ তাই বাড়ি যাওয়ার জন্য রিকশা দেখছে। একটা রিকশাও ওদিকে যেতে চাচ্ছেনা। অনু আনমনে হেঁটে সামনের দিকে যাচ্ছিলো তখনি একটা ছেলের সাথে তার ধাক্কা লাগতে গিয়ে বেঁচে গেলো। ছেলেটা অনুকে দেখেই মুচকি হাসলো । শার্টের সাথে আটকানো সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি চোখে পড়ে থতমত হয়ে বললো,
“ভালো আছো?”
অনু ছেলেটার আগা-মাথা ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,
“আপনি সায়ন ভাইয়া না?”
সায়ন আবারো হাসলো।বললো,
“হ্যাঁ।”
“আপনার এই অবস্থা কেনো? অনেক শুকিয়ে গেছেন, কালোও হয়ে গেছেন।”
“একটু অসুস্থ ছিলাম তাই হয়তো। তুমি এখানে?শপিংয়ে এসেছিলে?”
“হ্যাঁ, টুকটাক শপিং। আপনি আমাদের বাসায় আসেন না কেনো? আপনাকে আমার ধন্যবাদ জানানোর আছে। সেদিন আপনি না থাকলে…!”
অনু একটু ইমোশনাল হয়ে গেলো। সায়ন বললো,
“যা হওয়ার হয়ে গেছে, ওসব মনে রেখোনা আর ধন্যবাদ দিলে আল্লাহকে দাও কারণ তিনিই তোমাকে রক্ষা করেছে।”
“আমাদের বাসায় আসবেন। ভাইয়া নাই তো কি হয়েছে আমরা তো আছি।”
“হুম যাবো। সামনে তোমার বিয়ে, তখন গিয়ে পেট পুরে খেয়ে আসবো।” কথাগুলো সায়ন সহজভাবে বললেও ওর খুব কষ্ট লাগছিলো।
“তখন তো আসবেনি। তার আগে একদিন আসবেন আমি আপনাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো।”
“তাই, আচ্ছা চেষ্টা করবো।”
“আচ্ছা, আজ তাহলে আসি।”
সায়ন অনুকে রিকশা ঠিক করে দিলো। কালো চশমার আড়াল থেকে যতটুক পাড়লো মন ভরে অনুকে দেখে মনটাকে অল্পর জন্য হলেও প্রশান্ত করলো।
চলবে…

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com