Breaking News

মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ৩১



মীরার এরকম কাজে তার বাড়ির সকলে হতভম্ব। ইভার বাবা মা হাসলেও তারা হাসতে পারছে না। কারণ মেয়েটা করেছেই একটা গাধামি কাজ। হাসি আসবে কীভাবে? ইভানের মা এই মেয়ের নির্বুদ্ধিতা দেখে বাকরুদ্ধ। ভুলবশত মেহেদি লেগেছে ঠিক আছে। তুই আবার কোন আক্কেলে তা মুছতে যাস? তিনি চাপা গলায় মীরাকে ধমক দিয়ে বললেন,

"ছেলেটার শার্ট নষ্ট করে দিলি।"
বড়মার দিকে তাকিয়ে মীরার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
"আমি কি ইচ্ছে করে করেছি? উনি দেখেছিলেন না আমি পড়ে যাচ্ছি।
উনি কেন সামনে থেকে সরে গেলেন না।"

কিন্তু মীরা এই কথাটা বলতে পারলো না। দোষ এখন সবাই তাকেই দিবে। মাহার খেলনা কে নিচে ফেলে রেখেছে এটা দেখবে না। খেলনা পড়ে না থাকলে সে-ও স্লিপ খেত না। দোষ কার কাঁধে চাপানো যাবে মীরা এটা নিয়ে মোটেও ভাবছে না। তার আসল ভাবনা জায়িন ভাই তাকে খেয়ে ফেলবে। মীরা জায়িনের দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলের মতো করে বলল,
"সরি জায়িন ভাই। ইচ্ছে করে করিনি। আপনার শার্ট নষ্ট হয়ে...আপনি শার্ট খুলে দিন আমি ধুয়ে..'
কী বলছে সে এসব? জায়িন ভাইকে শার্ট খুলতে বলছে! মাথাটা পুরো গেছে।
"আমি আপনাকে নতুন শার্ট কিনে...'
"ওয়াশরুমটা কোনদিকে নিয়ে চলো।"
জায়িনের এমন নির্লিপ্ত ভাব দেখে মীরা যথেষ্টই অবাক হলো। জায়িন ভাই তাকে কিছু বলবে না? একটুও বকবে না? অন্তত দু'একটা বকা দেওয়াই উচিত। সে কাজটাই ওরকম করেছে। বড়মা দাঁত চেপে চোখ ইশারা করে জায়িনকে নিয়ে যেতে বলল। মীরার হুঁশ হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,
"আসুন আসুন। আমি ওয়াশরুম দেখিয়ে দিচ্ছি।"
ওয়াশরুমে জায়িন শার্ট পরিষ্কার করলেও মীরা বাইরে দাঁড়িয়ে বকবক করে যাচ্ছে,
"আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি জায়িন ভাই। আপনি কি রাগ করেছেন?"
জায়িন ভেতরে আয়নায় নিজেকে দেখে হাসলো। মীরা একা একাই বলে যাচ্ছে,
"মেহেদির দাগ মনে হয় উঠে যাবে। আর না উঠলেও শার্টটা যদি আপনার খুব প্রিয় হয় তাহলে আপনি আমাকে বকতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না।"
জায়িন ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। মীরা জায়িনকে দেখে চুপ করে গেল। জায়িন সরু চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,
"কিছু ক্ষেত্রে এক প্রিয় জিনিস, আরেক প্রিয় জিনিসের থেকেও বেশি প্রিয় হয়ে যায়।"
মীরা হাঁ করে জায়িনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল না কিছুই। জায়িন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
"বুঝলে কিছু?"
মীরা দু'পাশে মাথা নেড়ে না জানাল। জায়িন হেসে বলল,
"সময় হলে বুঝবে।"
মীরা যন্ত্রের মতো প্রশ্ন করলো,
"কী বুঝবো?"
"এইযে তুমি আমার পছন্দের শার্ট নষ্ট করে দিলে। এর পরিবর্তে আমি তোমার থেকে কিছু নেব না? কী নিব সেটাই সময় হলে বুঝবে।"

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই আকাশে মেঘ করেছিল। কয়দিন ধরেই এমন হচ্ছে।
আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়ে চারিদিক অন্ধকার করেও বৃষ্টি হয় না।
কতক্ষণ উল্টাপাল্টা বাতাস বয়ে সব ঠান্ডা। মীরা আজও তেমনই ভেবেছিল।
বৃষ্টি তো হবেই না। শুধু শুধু প্রাইভেট মিস দিয়ে কাজ নেই।
তাই ছোট চাচীর বারণ স্বত্বেও ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ল। প্রচুর বাতাস বইয়ে।
গাছের ডালপালা নুইয়ে যাচ্ছে। মেঘাচ্ছন্ন এমন দিনে মীরার ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না।
বৃষ্টিতে ভেজার আশা নিয়ে কবে থেকে বসে আছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ারই খবর নেই।
রাস্তায় মানুষজন ছোটাছুটি করে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছুচ্ছে।
মীরা ব্যাগ বুকের সাথে চেপে ধরে দৌড় লাগাল।
বাতাসের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করছে এমন একটা ভাব।
মুবিন ভাইদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ঝিরিঝিরি ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগল।
মীরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ে দু'হাত মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে এবছরের
প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে মাখল। প্রাইভেট থেকে ফেরার সময়ও বৃষ্টি থাকলে ভিজে বাসায় ফিরবে।
এটা ভেবেই দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে পড়ল। এটুকু জায়গা আসতে আসতেই মোটামুটি ভিজে গেল।
জাম কালারের জামায় যেখানে যেখানে বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে সেটুকু কালো রঙ হয়ে গেছে।
মাথার চুলও হালকা ভেজা। মীরা হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে কলিংবেল চাপছে।
একবার, দু'বার, তিনবার। তারপরও কেউ দরজা না খুললে বিরক্ত হয়ে কলিংবেলের
সুইচে চাপ দিয়ে ধরে রাখল। মীরা নিচু হয়ে পায়জামার নিচের দিকটা দেখছিল।
ময়লা লেগে গেছে। তখনই দরজা খুলে গেল। কে দরজা খুলেছে এটা না দেখেই মীরা বলল,
"উফ, এত দেরি হলো কেন আন্টি?"

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো
মানুষটাকে দেখে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। আন্টি না। জায়িন ভাই দরজা খুলেছে।
মীরা অপ্রস্তুত হাসল। ইনি কবে এসেছে? সেদিন শার্ট নষ্ট করার ঘটনাই তো এখনও পুরোপুরি ভুলেনি।
জায়িন ভাবলেশহীন মুখে দরজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মীরাকে দেখে তার চেহারায়
কোন ভাবান্তর হলো না। বরং এভাবে কলিংবেল চাপায় একটু বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হলো।
মীরা জায়িনের হাতের নিচ দিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরের দিকে দেখল।
মনে মনে ভাবল, ইনি এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে আমি ভেতরে যাব কীভাবে?
জায়িন দরজার সামনে থেকে সরছে না দেখে গলা পরিষ্কার করে মীরাই হালকা স্বরে বলল,
"একটু সরুন জায়িন ভাই। আমি ভেতরে যাব।"
জায়িন সরে দাঁড়ালে মীরা ভেতরে চলে এলো। রান্নাঘর, মুবিন ভাইয়ের ঘরের দিকে উঁকি
দিয়ে আন্টি মুবিন ভাইকে খুঁজছে। মীরা উঁকি ঝুকি চালিয়ে যাওয়ার সময় জায়িন
দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে রুমে চলে গেল। জায়িন চলে গেলে মীরা
জোরে মুখ মোচড় দিয়ে ভেঙিয়ে বলল,
"কথা বললে হায়াত কমে যাবে!"

রান্নাঘর থেকে কোন শব্দ আসছে না। আন্টি কি বুঝেনি সে এসেছে? মুবিন ভাই রুমে কী করে?
বেরিয়ে এসে দরজা খুললো না। মীরা গলা ছেড়ে ডাকতে যাচ্ছিল। কিন্তু জায়িন ভাই বাড়ি
আছে মনে পড়তে ধীরে ডাকল। এই লোক আবার শব্দদূষণ সহ্য করতে পারে না।
"আন্টি। ও আন্টি...
নিজের ঠিক পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মীরা ঝট করে পেছনে ফিরল।
জায়িনকে দেখে ভয় পেয়ে বুকে হাত দিয়ে বলে উঠল,
" ওরে বাবা!"
জায়িন শান্ত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে হাতের তোয়ালে এগিয়ে দিল।
এই মেয়ের কোন আচরণেই এখন আর সে বিরক্ত হওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
কারণ এই মেয়ের প্রতিটা উদ্ভট আচরণে বিরক্ত হওয়ার শুরু করলে তার
বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতা লোপ পেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
বৃষ্টিতে ভিজে আসার কী দরকার ছিল? মীরা প্রথমে বুঝতে পারল না। তাই জিজ্ঞেস করল,
"কী করব এটা দিয়ে?"

"বৃষ্টিতে ভিজে এসেছ খেয়াল নেই?"
কথা না যেন চাবুকের বাড়ি। জন্মের সময় মুখে মধু দিলে এই অবস্থা হতো না।
হাহ! মীরা সংকোচে তোয়ালেটা নিল। মাথা মুছতে মুছতে মুবিন ভাইয়ের রুমের দিকে হাঁটা ধরল।
আর তখনই পেছন থেকে গমগমে গলায় শুনতে পেল।
"মুবিন আজ সকালে মা খালামনিকে নিয়ে নানার বাড়ি গেছে।"
বাংলা কথা। তবুও মীরার কাছে চায়নিজ বলেই মনে হলো। সে বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল,
"মুবিন ভাই বাড়িতে নেই?"
জায়িনের চেহারায় স্পষ্ট হতাশা দেখা গেল। সে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে এগোতে লাগল। মীরার কথার উত্তর দিল না। মীরা জায়িনের পেছন পেছন আসতে আসতে আবার জিজ্ঞেস করল,
"আন্টিও বাড়িতে নেই? ওরা কেউ বাড়িতে নেই?"
লোকটার ভাব দেখে মীরার গা জ্বলে যাচ্ছে। এক কথা দুই বার বললে সমস্যা কি?
মানুষ বুঝতে না পারলে জানতে চাইবে না? আশ্চর্য! ইনি এমন কেন?
কেমন রোবটের মতো আচরণ করে। স্বাভাবিক মানুষের মতো কোন কথা বলতে পারে না কেন?
মীরার ঠেকা পড়েছে উনার সাথে কথা বলতে।
মুবিন ভাই বাড়িতে নেই এখন আর এখানে একমিনিটও থাকার প্রশ্নই আসে না।
আজকের পড়া ছুটি। মীরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে,
যাবার আগে এই লোকটাকে বলে যাওয়ারও প্রয়োজন মনে করল না।
সে দরজা খুলতে নিলে গুরুগম্ভীর সেই গলা শুনে থামতে হলো।
"বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।"
মীরা নাক ফুলিয়ে বলল,
"আমি যেতে পারব।"
"সাথে ছাতা আছে?"
"না। কিন্তু আমি ভিজে চলে যাব। আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে ফেরার জন্যই ইচ্ছে করে ছাতা আনিনি।"
"বৃষ্টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবির অপেক্ষা করতে বলেছে।"
মীরা মনে মনে ভাবল, হায় আল্লাহ! এ কোন জ্বালা! আবির ভাই আবার কোত্থেকে জানলো সে ছাতা ছাড়া এসেছে। বৃষ্টি কখন থামে কে জানে। এতক্ষণ মীরা এখানে অপেক্ষা করবে? এই লোকের সাথে? অসম্ভব।
ইনি নিজে তো একটা কথাও বলবে না। মীরা কথা বললে তাকেও মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বসিয়ে রাখবে।
না বাবা তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো। মীরার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে বলল,
"আপনাদের একটা ছাতা দিন। আমি কাল এসে দিয়ে যাব।"
"ছাতা নেই।"

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com