Breaking News

মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ৩২



ছাতা নেই! মীরা বিড়বিড় করল, আল্লাহ তুমি কি আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ! ছাতা আবার থাকে না কীভাবে? নিশ্চিত আছে। কিন্তু উনি জানেন না। মীরা দরজার কাছ থেকে ফিরে এলো। জায়িন এখনও কিচেনে কী করছে কে জানে। মীরা কিচেনের দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল,


"ছাতা মনে হয় আছে। আপনি জানেন না। আন্টিকে কল দিন। আন্টি বলে দিবে ছাতা কোথায় আছে।"
মীরা কথাটা বলে অপেক্ষা করল। অনেকক্ষণ পরেও কোন জবাব না পেয়ে সে ব্যাগ সোফার উপর রেখে কিচেনে এসে ঢুকলো। জায়িন কফি বানিয়ে মগে ঢালছে। মীরা কিচেনের সামনে থেকে বলল,
"জায়িন ভাই, আন্টিকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করুন। ছাতা আছে মনে হয়।"
জায়িন মীরার দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মীরা চুপ মেরে গেল।
সে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসেছে। এই লোকের সাথে এক কথার বেশি দুই কথা বললেই কেমন কটমট করে তাকায়। শয়তান লোক। মীরা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পড়ল। আসার সময় দোয়া করছিল যেন বৃষ্টি হয়। এখন দোয়া করছে তাড়াতাড়ি যেন বৃষ্টি থেমে যায়। জায়িন কফির মগ হাতে বেরিয়ে এসেছে। মীরা সোফার উপর পা তুলে বসেছিল। জায়িনকে দেখে তাড়াতাড়ি করে পা নামিয়ে নিল। মীরা নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবছে, জায়িন ভাই একবার ঘরে যাক। প্রথম সুযোগেই মীরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু জায়িন রুমে গেল না। কফিতে চুমুক দিতে দিতে মীরার পাশের সোফায় আরাম করে বসে পড়ল। হায় আল্লাহ! ইনি কি এখন এখানেই বসে থাকবে? জায়িন সময় নিয়ে কফি খাচ্ছে। কিন্তু মীরার ঘড়িতে সময় যে আটকে আছে। একেকটা সেকেন্ড একেক বছর মনে হচ্ছে।
দু'মিনিট নীরবতার পর মীরা ধীর গলায় বলল,

"জায়িন ভাই, আমি চলে যাই? বৃষ্টিতে ভিজলে আমার কিছু হয় না। আবির ভাই শুধু শুধু টেনশন করে।"
"মীরা যত বাহানাই দেক, যা কিছুই বলুক। ভুলেও তুই ওকে বৃষ্টির মধ্যে বেরুতে দিবি না। মাথায় এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লেও ওর ১০০° জ্বর এসে যায়। এটা তোমার ভাইয়েরই কথা।"
মীরা ফোঁস করে দম ফেলল। আবির ভাই তাকে ভালো ভাবেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এই লোক তো মনে হচ্ছে তাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে।
সময় কাটছে না। ইনি মজা করে কফি খেলেও মীরা শুধু মুখে বসে আছে। ভয়ে ভয়ে টিভির রিমোট নিয়ে টিভি ছেড়ে দিল। কয়েকটা চ্যানেল ঘুরিয়েও ভালো কিছু না পেয়ে একটা হিন্দি মুভিই দেখতে লাগলো। আগে কখনও দেখেনি। সময় কাটানোর জন্য মাঝখান থেকেই মুভি দেখা শুরু করেছিল। কিছুক্ষণ দেখে মজাই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে নায়ক নায়িকার চুমাচাটির সিন শুরু হয়ে গেলে মীরার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে ভাবতেই পারেনি এখন এমন কিছু হবে। মীরা রিমোট খুঁজে হুড়মুড়িয়ে টিভি অফ করে দিল। কী লজ্জা কী লজ্জা! জায়িন ভাইও কি এসব দেখেছে? লজ্জায় সত্যি সত্যিই মীরার ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সে চোখ বন্ধ করে জায়িনের দিকে তাকাল। দূর কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে একচোখ খুলল। না, জায়িন ভাই মনে হয় দেখেনি। কারণ তিনি মনোযোগ সহকারে ফোন চাপছে। মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। বিড়বিড় করে বলল,

"যাক বাঁচা গেল। উফ আল্লাহ।"
মীরা মনে মনে শপথ করল, আজকের পর কোন মানুষের সামনে টিভি দেখতে বসবে না। দেখা মুভিও দেখবে না। আসলে টিভি দেখাই ছেড়ে দিবে সে। জায়িন ভাইও যদি টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতো তাহলে কী লজ্জাটাই না পেত! কোনোদিন উনার সামনে আসতে পারত না।
জায়িন ফোন থেকে মুখ তুলে দেখল মীরা টিভি বন্ধ করে বসে আছে।
"কফি চলবে?"
জায়িন ভাইয়ের সামনে থাকলে মীরা কি কানে কম শুনে? নাকি উনার মুখের বাংলা কথাও বুঝতে পারে না। একটা কথা দুই তিনবার জিজ্ঞেস করতে হয়। এতে উনি বিরক্তও হয়। এবারও জায়িন ভাই কী বলল মীরা বুঝতে পারল না। কথাটা তাকে বলেছে কি-না এটাও বুঝলো না। উনার মুখের দিকে হাবার মতো তাকিয়ে আছে। ওকে এরকম ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়িন ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল। মীরা তখনও উত্তর দিতে পারল না। জায়িন স্পষ্ট বিরক্ত হলো। পরিষ্কার গলায় ঝরঝরে উচ্চারণে জিজ্ঞেস করল,
"কফি খাও?"
মীরা মাথা নাড়ল। জায়িনের ভ্রু কোঁচকাতে দেখে সাথে সাথে বলে উঠল,
"কফি খাই না। চা খাই।"

"হু।"
জায়িন নিজের খালি মগ নিয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে মীরাও উঠল। জায়িনের পেছনে পেছনে কিচেন চলে এলো। অবাক হয়ে দেখতে লাগল জায়িন ভাই ছেলে হয়েও কিচেনে কোন জিনিস কোথায় আছে সব জানে। কত দক্ষ হাতে গ্যাসে চায়ের পাতিলে পানি বসিয়ে দিল। আর মীরা এখন পর্যন্ত রান্নাঘর কোনদিকে এটাই বলতে পারবে না। রান্নাঘরে কোন জিনিস কোথায় রাখা আছে বলবে তো দূরের কথা। জায়িন ভাই তাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে। সে অপদার্থের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? তাই সাধারণ মানবতা থেকে বলল,
"আমি সাহায্য করি? কী সাহায্য লাগবে বলুন।"
"চা পাতা কোথায় আছে দেখো।"
হায় হায়! জায়িন ভাইয়ের যে স্বভাব, মীরা ভেবেছিল সে সাহায্য করার কথা বললে জায়িন ভাই বলবে, না থাক। তোমার সাহায্য করতে হবে না। তুমি গিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখো। কিন্তু ইনি তো সাহায্য চাচ্ছেন! মীরা তো এবার ফেঁসে গেল। চা পাতা কোথায় আছে কে জানে। আন্টি কতদিন চা করে খাইয়েছে। কিন্তু চা পাতার খোঁজ তো সে রাখেনি৷ মীরা পেঁচা মুখ করে এই ড্রয়ারে, ওই তাকে চা পাতা খুঁজে যাচ্ছে। পাচ্ছে না তো কোথাও। জায়িন ভাইকে বলবে, পাচ্ছি না। জায়িন আড়চোখে মীরাকে দেখছে। হাসি পেলেও হাসছে না।
"কী হলো, পাওনি?"
মীরা ঠোঁট ফুলিয়ে মিনমিন করে বলল,
"পাচ্ছি না জায়িন ভাই।"
"ভালো করে দেখেছ?"
"হ্যাঁ। সব জায়গায় খুঁজেছি। আন্টি কোথায় রেখেছে পাচ্ছি না। চা খেতে হবে না। আপনি রেখে দিন। এমনিতেও আমি এত চা খাই না।"
মীরা জায়িনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। জায়িন হঠাৎ পেছনে ফিরলে মীরা চুপ হয়ে গেল। জায়িন ওকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে উপরের একটা তাক থেকে চা পাতার কৌটো বের করে আনলো। এটা চা পাতার কোটা! মীরা তো এটা দেখেছেই। কিন্তু বুঝতে পারেনি। সে লজ্জিত মুখে বলল,
"এই কৌটৌটা বুঝতে পারিনি।"

জায়িন সুন্দর করে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই চা বানিয়ে ফেলল। এবং হাতপা না পুড়িয়ে কাপেও ঢাললো। মীরা আশ্চর্য হয়ে ওকে নিপুণভাবে কাজ করতে দেখেছে। মীরাকে চা ঢালতে দিলে এতক্ষণে গরম চা ফেলে নির্ঘাত হাতপা পুড়িয়ে বসে থাকত। জায়িন চায়ের কাপটা মীরার দিকে এগিয়ে দিল। মীরা এই প্রথম জায়িনের সামনে মন থেকে আন্তরিক ভাবে হাসল। কিচেন থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে চায়ে চুমুক দিয়ে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না। এই চায়ের প্রশংসা না করলে চা তাকে অভিশাপ দিবে। এত সুন্দর চা বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য জায়িন ভাইকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। মীরা পিছন দিকে ঘুরে বলতেই যাচ্ছিল,
"ধন্যবাদ ভাইয়া।"
এমম সময় হঠাৎ কানে তালা লাগিয়ে আশেপাশেই মনে হয় কোথাও বজ্রপাত হলো। সাথে সাথে ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গেল। এতো জোরে বাজ পড়ায় মীরা ভয় পেয়ে হাত থেকে চায়ের কাপ ফেলে দিল। গরম চা পায়ের উপর পড়তেই যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। সবকিছু ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে। মীরা কিছুই দেখতে পারছে না। আবারও পরপর কয়েকটা বজ্রপাত হলো। মীরা কানে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে ডাকল।
"জায়িন ভাই! জায়িন ভাই! কোথায় আপনি?"
অন্ধকারের মাঝেই দু'টো হাত মীরার হাত ধরল। মীরা তখন থরথর করে কাঁপছে। সে জায়িনের হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। জায়িন ওর ভয় কমাতে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
"আমি এখানেই আছি। ভয় পেয়ো না। আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছি।"

জায়িনের দুই হাতই মীরা শক্ত করে ধরে রেখেছে। মেয়েটা ভয় পেয়ে কবুতরের বাচ্চার মতো কাঁপছে। জায়িন একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আরেক হাতে মীরাকে ধরে রেখে কিচেনে মোমবাতি খুঁজছে। অনেক খোজাখুজি করেও মোমবাতি পেল না। জায়িন মীরাকে নিয়ে অন্ধকারেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে মীরা সোফার সাথে ধাক্কা খেল। একে তো পায়ে গরম চা পড়ে প্রচণ্ড জ্বালা করছে। তার উপর সোফার সাথে বেশ জোরেই নখে বাড়ি খেল। মীরা অস্ফুটে কেঁদে উঠল। জায়িন অন্ধকারে মীরার মুখ দেখতে না পারলেও মীরা কষ্ট পাচ্ছে ঠিকই বুঝতে পারল। ড্রয়িংরুমে সোফার উপরেই তার ফোনটা রেখে গিয়েছিল। জায়িন অন্ধকার হাতড়ে ফোন খুঁজছে। এরকম সময় ঠিক আরেকটা বজ্রপাত হলো। এবং এটা যেন জায়িনদের ছাঁদেই হলো এত প্রচন্ড শব্দ হয়েছে। মীরা ভয়ে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলল। সজ্ঞানে থাকলে সে হয়তো এরকম কাজ কোনোদিনও করতো না৷ কিন্তু এই মুহূর্তে লাজলজ্জা, বোধবুদ্ধি ভুলে মীরা জায়িনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওর এরকম আচরণে জায়িনও স্তব্ধ হয়ে গেল। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। এদিকে মীরা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জায়িনকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। জায়িন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
"আমার ভয় লাগছে। জায়িন ভাই আমার ভয় লাগছে। প্লিজ আলো জ্বালুন।"
অজান্তেই জায়িনের একটা হাত মীরার পিঠে উঠে এলো। মৃদু হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে লাগল।
"ভয় নেই মীরা। আমি আছি তো। তোমার কোন ভয় নেই।"

চলবে....

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com