ঈদুল আযহা ও কুরবানী বিষয়ক কিছু হাদীস
قَدِمَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا، فَقَالَ: مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ؟ قَالُوا: كُنّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيّةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: إِنّ اللّهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا: يَوْمَ الْأَضْحَى، وَيَوْمَ الْفِطْرِ.
হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনাবাসীর দুটি উৎসবের দিবস ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ দুটি দিবস কী? (কী হিসেবে তোমরা এ দু’দিন উৎসব পালন কর?) তারা বলল, জাহেলিয়াত তথা ইসলামপূর্ব যুগে আমরা এ দিনদুটিতে উৎসব পালন করতাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন - ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ,
হাদীস ১২০০৬ এই হাদীসের ব্যাখ্যায় মাওলানা মনযূর নোমানী রাহ. তাঁর বিখ্যাত কিতাব ‘মাআরিফুল হাদীস’-এ লেখেন- ‘বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের উৎসবসমূহ প্রকৃতপক্ষে তাদের আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের মুখপত্র এবং তাদের জাতীয় চরিত্রের দর্পণ হয়ে থাকে। এ কারণে একথা স্পষ্ট যে, ইসলামের আগে জাহিলিয়্যাতযুগে মদীনার লোকেরা যে দুটি উৎসব পালন করত এগুলো জাহিলী চরিত্র ও চিন্তা-চেতনা এবং জাহিলী ঐতিহ্যেরই দর্পণ ছিল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; বরং হাদীসের শব্দমালা অনুযায়ী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা এ প্রাচীন উৎসবগুলোকে বাতিল করে দিয়ে এগুলোর স্থলে ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহার দুটি উৎসব এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা এ উম্মতের তাওহীদী চরিত্র ও জীবনধারার সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার আয়না স্বরূপ। মুসলমানেরা যদি নিজেদের এ উৎসবগুলোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও হেদায়েত অনুযায়ী উদযাপন করেন তাহলে ইসলামের প্রাণবস্তু ও এর মর্মবাণীকে বুঝা ও বুঝাবার জন্য কেবল এ দুটি উৎসবই যথেষ্ট হতে পারে।
উপরোক্ত হাদীসের শিক্ষার আলোকে মুসলিমগণ নিজ নিজ এলাকার পট-উৎসবকেও বিবেচনায় আনতে পারবেন এবং নিজেদের করণীয় সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা লাভ করতে পারবেন। ঈদ আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
- أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى، جَعَلَهُ اللهُ عِيدًا لِهَذِهِ الْأُمّةِ.
আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহা’র আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে); এ দিবসকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫ ঈদুল আযহার দিন নবীজী নামাযের পরে খেতেন
كَانَ النّبِيُّ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الفِطْرِ حَتّى يَطْعَمَ، وَلَا يَطْعَمُ يَوْمَ الأَضْحَى حَتّى يُصَلِّيَ.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন কোনো কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। আর ঈদুল আযহার দিন নামায না পড়ে কিছু খেতেন না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৪২ ঈদুল আযহার দিন নামাযের পরে খাওয়ার কারণ সম্ভবত এ হবে যে, এ দিন যেন সবার আগে কুরবানীর গোশতই মুখে উঠে, যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক ধরনের দাওয়াত ও আপ্যায়ন। আর ঈদুল ফিতরের দিন সকালে নামাযের পূর্বেই কিছু খেয়ে নেওয়া সম্ভবত এ কারণে যে, আল্লাহর নির্দেশে রমযানের সারাটি মাস দিনের বেলা পানাহার বন্ধ ছিল, আজ যখন তাঁর পক্ষ থেকে দিনের বেলা পানাহারের অনুমতি মিলে গেল এবং এতেই তাঁর সন্তুষ্টি রয়েছে বলে জানা গেল তখন একজন আগ্রহী ও মুখাপেক্ষী বান্দার মত সকাল সকালই এসব নিআমতের স্বাদ গ্রহণ করলেন। আর বান্দার অবস্থা এমনটাই হওয়া চাই। (মাআরিফুল হাদীস) নবীজী পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন, পায়ে হেঁটে ফিরতেন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَخْرُجُ إِلَى الْعِيدِ مَاشِيًا، وَيَرْجِعُ مَاشِيًا.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন এবং পায়ে হেঁটে ঈদগাহ থেকে ফিরতেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১২৯৫ নবীজী এক পথ দিয়ে যেতেন ভিন্ন পথে ফিরতেন জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন-
كَانَ النّبِيُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا كَانَ يَوْمُ عِيدٍ خَالَفَ الطّرِيقَ.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন এক পথ দিয়ে যেতেন এবং ভিন্ন পথ দিয়ে ফিরতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৮৬ ঈদের দিন একে অপরের সাথে দেখা হলে বলবে... জুবায়ের ইবনে নুফাইর রাহ. বলেন-
كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللّهِ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا الْتَقَوْا يَوْمَ الْعِيدِ يَقُولُ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ تَقَبّلَ اللّهُ مِنّا وَمِنْكَ.
সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাৎ হলে বলতেন- تَقَبّلَ اللّهُ مِنّا وَمِنْكَ. আল্লাহ কবুল করুন আমাদের পক্ষ হতে ও আপনার পক্ষ হতে। -ফাতহুল বারী ২/৫১৭ ঈদের নামায সকাল সকাল তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে খুমাইর রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
خَرَجَ عَبْدُ اللّهِ بْنُ بُسْرٍ، صَاحِبُ رَسُولِ اللّهِ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مَعَ النّاسِ فِي يَوْمِ عِيدِ فِطْرٍ، أَوْ أَضْحَى، فَأَنْكَرَ إِبْطَاءَ الْإِمَامِ، فَقَالَ: إِنا كُنّا قَدْ فَرَغْنَا سَاعَتَنَا هَذِهِ، وَذَلِكَ حِينَ التسْبِيحِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুস্র রা. ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আযহার দিন লোকদের সাথে ঈদের নামায পড়ার জন্য ঈদগাহে গেলেন। ইমামের আসতে বিলম্ব হলে তিনি এর প্রতিবাদ করলেন এবং বললেন, এ সময় তো আমরা (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে) নামায পড়ে ফারেগ হয়ে যেতাম। (রাবী বলেন) আর এটা নফলের (অর্থাৎ চাশতের) সময় ছিল। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩১৭ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুস্র রা. সিরিয়ায় অবস্থান অবলম্বন করে নিয়েছিলেন এবং সেখানকার ‘হিম্স’ নামক স্থানে তাঁর ইনতিকাল হয়। সম্ভবত সেখানকার এ ঘটনা যে, ঈদের নামাযে ইমামের বিলম্ব করার উপর তিনি আপত্তি উঠালেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে আমরা ঈদের নামায সকাল সকাল পড়ে ফারেগ হয়ে যেতাম। (মাআরিফুল হাদীস) প্রথমে ঈদের নামায তারপর কুরবানী বারা ইবনে আযীব রা. বলেন-
خَطَبَنَا النّبِيُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَوْمَ النّحْرِ، قَالَ: إِنّ أَوّلَ مَا نَبْدَأُ بِهِ فِي يَوْمِنَا هَذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمّ نَرْجِعَ، فَنَنْحَرَ فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنّتَنَا، وَمَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ عَجّلَهُ لِأَهْلِهِ لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَيْءٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশে খুতবা দিলেন। তাতে বললেন, আমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ নামায আদায় করা, এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরীকা মতো হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ তরীকা মতো হয়নি অতএব) তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানী নয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬১; সহীহ ইবনে হিব্বান ৫৯০৭ নবীজী প্রতি বছরই কুরবানী করতেন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِالمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلّ سَنَةٍ.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দশ বছরের প্রতি বছরই কুরবানী করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৯৫৫ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কুরবানী করেছেন জাবির রা. থেকে বর্ণিত-
ذَبَحَ النّبِيُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَوْمَ الذّبْحِ كَبْشَيْنِ أَقْرَنَيْنِ أَمْلَحَيْنِ مُوجَأَيْنِ، فَلَمّا وَجّهَهُمَا قَالَ إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي...
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন দু’টি সাদা-কালো, বড় শিং বিশিষ্ট, খাসি দুম্বা যবেহ করেছেন। যখন তিনি তাদের শায়িত করলেন তখন বললেন-
إِنِّي وَجّهْتُ وَجْهِيَ لِلّذِي فَطَرَ السّموَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلّةِ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ، اللّهُمّ مِنْكَ وَلَكَ، وَعَنْ مُحَمّدٍ وَأُمّتِهِ بِاسْمِ اللّهِ، وَاللّهُ أَكْبَرُ.
كَانَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَذْبَحُ وَيَنْحَرُ بِالْمُصَلّى.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে যবেহ করতেন এবং নহর করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫২ নিয়ম হল গরু, ছাগল, দুম্বা যবেহ করা হবে এবং উট নহর করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করেছেন। কুরবানীর পশু আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন-
ضَحّى النّبِيُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ، فَرَأَيْتُهُ وَاضِعًا قَدَمَهُ عَلَى صِفَاحِهِمَا، يُسَمِّي وَيُكَبِّرُ، فَذَبَحَهُمَا بِيَدِهِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিং বিশিষ্ট) নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’ বললেন। অতপর নিজ হাতে যবেহ করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৬ হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, ‘অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তেষট্টিটি উট নাহ্র করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯০৫ উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত-
وَضَحّى رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَنْ نِسَائِهِ بِالْبَقَرِ.
لَا تَذْبَحُوا إِلّا مُسِنّةً، إِلّا أَنْ يَعْسُرَ عَلَيْكُمْ، فَتَذْبَحُوا جَذَعَةً مِنَ الضّأْنِ.
তোমরা (কুরবানীতে) ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছ’মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪১ কুরবানীর উট অন্তত পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে। গরু, মহিষ দুই বছর এবং ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এক বছর হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে উপরোক্ত হাদীস থেকে জানা গেল যে, তা ছয় মাসের হলেও চলবে। যে ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী হয় না হযরত বারা ইবনে আযিব রা. কুরবানীর পশু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
أَشَارَ رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِيَدِهِ وَيَدِي أَقْصَرُ مِنْ يَدِهِ فَقَالَ: أَرْبَعٌ لَا يُضَحّى بِهِنّ: الْعَوْرَاءُ الْبَيِّنُ عَوَرُهَا، وَالْمَرِيضَةُ الْبَيِّنُ مَرَضُهَا، وَالْعَرْجَاءُ الْبَيِّنُ ظَلَعُهَا، وَالْعَجْفَاءُ الّتِي لَا تُنْقِي فَقَالُوا لِلْبَرَاءِ: فَإِنّمَا نَكْرَهُ النّقْصَ فِي السِّنِّ وَالْأُذُنِ، وَالذَّنَبِ، قَالَ: فَاكْرَهُوا مَا شِئْتُمْ وَلَا تُحَرِّمُوا عَلَى النّاسِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন -আমার হাত তো তাঁর হাত থেকে ছোট- এবং বলেছেন, ‘চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না : যে পশুর এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ণ, যে পশু সম্পূর্ণ খোড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই।’ লোকেরা বলল, আমরা তো দাঁত, কান ও লেজে ত্রুটিযুক্ত প্রাণী (দ্বারা কুরবানী করা)ও অপছন্দ করি? তিনি বললেন, যা ইচ্ছা অপছন্দ করতে পার। তবে তা অন্যের জন্য হারাম করো না।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪৪ আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-
أَمَرَنَا رَسُولُ اللّهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ نَسْتَشْرِفَ الْعَيْنَ وَالْأُذُنَيْنِ، وَلَا نُضَحِّي بِعَوْرَاءَ، وَلَا مُقَابَلَةٍ، وَلَا مُدَابَرَةٍ، وَلَا خَرْقَاءَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানীর পশুর) চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি এবং ওই পশু দ্বারা কুরবানী না করি, যার কানের অগ্রভাগ বা পশ্চাদভাগ কর্তিত। তদ্রূপ যে পশুর কান ফাড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্রযুক্ত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৭২; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৯৭ আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিং-ভাঙ্গা বা কান-কাটা পশু দ্বারা কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৫ কুরবানী প্রকৃতপক্ষে বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর দরবারে নজরানা নিবেদনের নাম। এ জন্য এটা জরুরি যে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এর জন্য উত্তম ও ভাল পশু নির্বাচন করা। এটা খুবই খারাপ কথা যে, লোলা, ল্যাংড়া, অন্ধ, কানা, অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শিং ভাঙ্গা ও কানকাটা জানোয়ার আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে। কুরআন মাজীদে মূলনীতি হিসাবে বলা হয়েছে :
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰی تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ.
অর্থাৎ তোমরা পুণ্যের স্তরে পৌঁছতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তোমাদের প্রিয় ও পছন্দনীয় বস্তু আল্লাহর রাহে খরচ করবে। যাহোক, কুরবানী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এসব দিকনির্দেশনার প্রাণবস্তু ও এগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য এটাই। (মাআরিফুল হাদীস) গরু ও উটে সাত শরীক হতে পারে জাবির রা. বলেন-
خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مُهِلِّينَ بِالْحَجِّ،...فَأَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ نَشْتَرِكَ فِي الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ، كُلّ سَبْعَةٍ مِنّا فِي بَدَنَةٍ.
আমরা হজ্বের ইহরাম বেঁধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হলাম। ...তিনি আমাদেরকে আদেশ করলেন যেন আমরা প্রতিটি উট ও গরুতে সাতজন করে শরীক হয়ে কুরবানী করি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২১৩ অন্য বর্ণনায় আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (একটি) গরু সাত জনের পক্ষ হতে এবং (একটি) উট সাত জনের পক্ষ হতে (কুরবানী করা যায়)। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮০৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৯০৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৪৪২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০০৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৯০১ অহেতুক কষ্ট দেয়া ছাড়া সুন্দরভাবে যবেহ করতে হবে হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওছ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذّبْحَ، وَلْيُحِدّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ.
আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর। যখন যবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে যবেহ কর। প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে এবং তার পশুকে শান্তি দিবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৫৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮১৫; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪০৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৭০ কুরবানীর পশুর গোশত জাবির রা. থেকে বর্ণিত-
أَنّهُ نَهَى عَنْ أَكْلِ لُحُومِ الضّحَايَا بَعْدَ ثَلَاثٍ، ثُمَّ قَالَ بَعْدُ: كُلُوا، وَتَزَوّدُوا، وَادّخِرُوا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (বিশেষ একটি কারণে) তিন রাত পর কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বলেন, ‘খাও, পাথেয় হিসাবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২ উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর এক বর্ণনায় আছে-
فَكُلُوا وَادّخِرُوا وَتَصَدّقُوا.
‘খাও, সংরক্ষণ কর এবং সদকা কর।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭১ কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া বিক্রি করা বা পারিশ্রমিক হিসেবে কসাইকে দেয়া যাবে না আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেন-
أَمَرَنِي رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَنْ أَقُومَ عَلَى بُدْنِهِ، وَأَنْ أَتَصَدّقَ بِلَحْمِهَا وَجُلُودِهَا وَأَجِلّتِهَا، وَأَنْ لَا أُعْطِيَ الْجَزّارَ مِنْهَا، قَالَ: نَحْنُ نُعْطِيهِ مِنْ عِنْدِنَا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তাঁর (কুরবানীর উটের) আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন, আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজেদের পক্ষ থেকে দিব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭১৬ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করলে... নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ، وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْربَنّ مُصَلّانَا.
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ৪৭৪৩ আল্লাহ প্রত্যেক সামর্থ্যবানকে কুরবানী করার তাওফীক দিন এবং একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কুরবানী করার তাওফীক দিন।