যে পাহাড়ে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিলো


যে পাহাড়ে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছিলো

মক্কার ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বসম্পন্ন স্থানগুলোর মধ্যে জাবালে নূর বা হেরা পাহাড়ের স্থান বিশেষ। এই পাহাড়ের এক ছোট্ট গুহাতেই পবিত্র কোরআন শরীফ নাযিল হয়েছিল এবং এখানেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবুয়াত লাভ করেছিলেন। এই অভিজাত স্থানটি দেখতে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আমি এবং সুরভী অনুভব করেছি এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক টান। এই ব্লগে আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব সেই অভিজ্ঞতা এবং জাবালে নূরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব।

জাবালে নূরের গুরুত্ব ও ইতিহাস

জাবালে নূর, যার অর্থ 'আলোর পাহাড়', পূর্বে হেরা পাহাড় নামে পরিচিত ছিল। এটি মক্কার প্রাচীনতম ও পবিত্র পাহাড়গুলোর মধ্যে একটি। ইসলামিক ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম কারণ এই পাহাড়ের চূড়ার কাছে অবস্থিত হেরা গুহাতেই প্রথম ওহী নাযিল হয়। মহানবী (সা.) যখন এখানে ধ্যান করতেন, তখনই হযরত জিব্রাঈল (আলাইহিস সালাম) এসে প্রথমবারের মতো পবিত্র কোরআনের সূচনা করণীয়আয়াতসমূহ পাঠ করেন।

এই গুহাটি ইসলামের ইতিহাসের এক অমূল্য স্মারক, যেখানে নবীজির নবুয়াতের সূচনা ঘটেছিল। কোরআনের প্রথম পাঁচ আয়াত এখানে নাযিল হয়েছিল, যা মানুষের জন্য আলোর পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে আসছে।

মক্কা থেকে জাবালে নূরে যাত্রা: একটি চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা

মক্কা নগরীর আধুনিকতা ও প্রাচীন ঐতিহ্যের মিলনস্থল থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি জাবালে নূরের উদ্দেশ্যে। মসজিদুল হারাম থেকে মাত্র প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পাহাড়ে উঠা সহজ নয়। যদিও আগে ঝুঁকিপূর্ণ সরু পথ ছিল, বর্তমানে সৌদি সরকার নতুন ও প্রশস্ত পথ তৈরি করেছে। তবে এখনও অনেকেই পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ পথ ব্যবহার করেন, যা প্রশাসনিকভাবে নিষিদ্ধ।

আমরা নতুন পথ ধরে হাঁটা শুরু করি। নতুন পথটি অনেক প্রশস্ত এবং পাহাড় কেটে তৈরি হওয়া, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময়। তবে পাহাড়ের তীব্র রোদ এবং উচ্চতার কারণে ওঠা বেশ কঠিন, বিশেষ করে যারা শারীরিকভাবে দুর্বল তাদের জন্য। তাই সকালের নাস্তা করে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি, যা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেও স্পষ্ট।

বাংলাদেশি ভাইদের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ

পাহাড়ের নিচে একটি ছোট দোকানে বাংলাদেশের মনসুর ভাইয়ের সাথে কথা হয়, যিনি বলেন যে পুরানো পথটি এখন বন্ধ। সরকার নতুন পথ চালু করেছে এবং পুরানো পথটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও কিছু মানুষ পুলিশ ফাঁকি দিয়ে পুরানো পথ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন।

নতুন পথ ও মিউজিয়াম: আধুনিকায়নের ছোঁয়া

নতুন পথের শুরুতে একটি মিউজিয়াম নির্মিত হয়েছে, যা দর্শনার্থীদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য। এই মিউজিয়ামে ইসলামিক ইতিহাস, হেরা গুহার গুরুত্ব ও বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন প্রদর্শিত হয়। এছাড়া এখানে বিভিন্ন খাবারের দোকান ও শপিং সেন্টার রয়েছে, যা দর্শনার্থীদের জন্য একটি বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠেছে।

মিউজিয়ামের উদ্দেশ্য দর্শনার্থীদের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করা এবং পর্যটন বৃদ্ধি করা। তবে এই আধুনিকায়ন নিয়ে কিছু বিতর্কও রয়েছে, কারণ অনেকেই মনে করেন যে নবীজির সেই পথ বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়।

জাবালে নূরে ওঠার অভিজ্ঞতা

পাহাড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয় নতুন প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে। পথের মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে, কারণ উচ্চতা ও গরমের কারণে ক্লান্তি হওয়া স্বাভাবিক। আমরা দেখেছি বিভিন্ন বয়সী মানুষ—ছোট শিশু থেকে বৃদ্ধ—অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে এই পবিত্র স্থান পরিদর্শনে আসছেন।

পাহাড়ের উপরের অংশে পৌঁছে চারপাশের দৃশ্য অপরূপ। মক্কার নগরী, মসজিদুল হারাম ও কাবা শরীফের ক্লক টাওয়ার স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে অনেক মানুষ নামাজ আদায় করতে আসেন, যার মাধ্যমে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

পাহাড়ের চূড়ায় পাখিদের উপস্থিতি

উপরে পৌঁছানোর পরে দেখা যায় অনেক কবুতর এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দর্শনার্থীরা তাদের জন্য গম ছিটিয়ে দেন, যা পাখিদের আকর্ষণ করে। এই ছোট্ট মুহূর্তগুলো পাহাড়ের তীব্র গরমের মাঝে একটি প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি দেয়।

হেরা গুহায় প্রবেশ ও ধ্যান

জাবালে নূরের চূড়া থেকে কিছুটা নিচে নামতেই আমরা পৌঁছাই হেরা গুহায়। গুহাটি প্রবেশের পথ খুবই সরু ও খাড়া, যেখানে একসাথে দুইজন প্রবেশ করা সম্ভব নয়। প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য একে অপরের অপেক্ষা করতে হয়।

গুহার ভিতরে প্রবেশ করে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলাম। ভাবতেই অবাক লাগে যে, এই গুহাতেই মহানবী (সা.) ধ্যানাত্মক অবস্থায় বসেছিলেন এবং পবিত্র কোরআনের প্রথম ওহী নাযিল হয়েছিল। গুহার পাথরে স্পর্শ করার সময় এক গভীর আধ্যাত্মিকতা মিশে যায়।

গুহার ভেতরে দর্শনার্থীদের আচরণ

দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু দর্শনার্থী গুহায় পাথর চুম্বন করেন, যা ইসলামে শিরকের পর্যায়ে পড়ে এবং নিষিদ্ধ। এছাড়া অনেকেই এখানে নামাজ আদায় করেন, যা গুহার নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত নয়। এই ধরনের আচরণ দেখে মন খারাপ হয়, কারণ এটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানটির মর্যাদা কমিয়ে দেয়।

ধারণা ও অনুভূতি: একটি জীবনের স্মৃতি

হেরা গুহা থেকে নেমে আসার সময় অনুভব করলাম, এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন। কষ্টসাধ্য পথ পেরিয়ে এই পবিত্র স্থান দেখার আনন্দ অন্যরকম। পাহাড়ের চূড়া থেকে মক্কার দৃশ্য, হেরা গুহার গভীরতা, এবং নবুয়াতের স্মৃতিচিহ্ন একসাথে মিলে এক অনন্য আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করে।

আমাদের যাত্রা হয়েছিল শুধু দর্শনের জন্য নয়, বরং সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোকে মনের মাঝে ধারণ করার জন্য। হেরা গুহায় বসে ভাবলাম, কত কঠিন সময় পেরিয়ে নবীজির ওপর আল্লাহর ওহী নাযিল হয়েছিল এবং সেই কোরআন আজও পৃথিবীকে আলোকিত করছে।

জাবালে নূর ও হেরা গুহা কেবল একটি প্রাকৃতিক পাহাড় বা গুহা নয়, এটি ইসলামের ইতিহাসের এক মহৎ অধ্যায়ের সাক্ষী। এখানে পবিত্র কোরআনের প্রথম ওহী নাযিল হয়েছিল, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক আলোকবর্তিকা। পাহাড়ে ওঠার কঠিন পথ পেরিয়ে এই স্থান পরিদর্শন করা একটি আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক যাত্রা।

সৌদি আরব সরকার নতুন পথ নির্মাণ করে নিরাপত্তা ও পর্যটন উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে, যদিও কিছু বিতর্কও আছে। তবে যাত্রীরা অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করে এবং ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা করে এই স্থান পরিদর্শন করবেন।

যারা ওমরাহ বা হজ্বের পরিকল্পনা করছেন, তাদের জন্য জাবালে নূরের এই ভ্রমণ একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হতে পারে। এটি শুধু ধর্মীয় তথ্য গ্রহণের স্থান নয়, বরং ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, যেখানে প্রতিটি পাথরই গল্প বলে।

আশা করি এই বিস্তারিত বিবরণ আপনাদের জন্য উপকারী হয়েছে এবং জাবালে নূরের মহিমা ও গুরুত্ব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। এই পবিত্র স্থান পরিদর্শন করার সুযোগ পেলে অবশ্যই যান এবং নিজ চোখে দেখুন সেই গুহা যেখানে আল্লাহর নাজিলকৃত পবিত্র কোরআন প্রথম পাঠ হয়েছিল।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url