সামুদ জাতি ‘ধ্বংস’ হয়েছিলো যেখানে
সামুদ জাতি ‘ধ্বংস’ হয়েছিলো যেখানে
আমাদের ইতিহাসের পাতায় এমন অনেক গোপন কথা লুকানো আছে, যেগুলো কখনো কখনো চোখে দেখা ছাড়া বিশ্বাস করাও কঠিন। সৌদি আরবের আলুরা শহরের মাদাইন সালেহ বা হেগরা সেইসব রহস্যময় স্থানগুলোর অন্যতম, যেখানে প্রাচীন সামুদ জাতির বসবাস ছিল। এই জাতি আল্লাহর প্রতি অমান্য করায় গজব নেমে ধ্বংস হয়ে যায়, আর তাদের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আজো পাহাড়ের গায়ে জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই নিবন্ধে আমরা সেই প্রাচীন ইতিহাস, মাদাইন সালেহর ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব, এবং বর্তমান পর্যটন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
মাদাইন সালেহ: প্রাচীন সামুদ জাতির জনপদ
মাদাইন সালেহ, যা হেগরাও নামে পরিচিত, ছিল প্রাচীন সামুদ জাতির আবাসস্থল। সামুদ জাতি ছিল পাথর খোদাই ও স্থাপত্যশিল্পে পারদর্শী। পাহাড় কেটে তারা বিশাল প্রাসাদ ও সমাধি সৌধ নির্মাণ করত। তাদের স্থাপত্যশৈলী এতটাই অনন্য ছিল যে ধ্বংসের পরও সেই সমাধি সৌধগুলো আজও অবিকৃত রয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যরা মারা গেলে একে একে তাদের সমাধিতে দাফন করা হতো, এবং পরিবারের সর্বশেষ সদস্য মারা যাওয়ার পর সেই সমাধির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হতো। এই কবরের পদ্ধতি তাদের মেধা ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের প্রমাণ।
সামুদ জাতি আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী ছিল এবং বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তাদের এই অবাধ্যতা ও গর্বের কারণে আল্লাহর গজব নেমে তাদের ধ্বংস করে দেয়। পবিত্র কোরআনে এই ঘটনার বর্ণনা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।
মাদাইন সালেহর ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আলুরার এই অঞ্চল প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে গঠিত বেলে পাথরের সমভূমি ও পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। ধারণা করা হয়, নূহ আলাইহিস সালামের সময় মহাপ্লাবনের ফলে এই অঞ্চল পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছিল। সামুদ জাতি ছিলেন নূহের পুত্র সামের বংশধর এবং হযরত সালেহ আলাইহি সালাম তাদের নবী ছিলেন।
তাবুক সফরের সময় মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এই স্থানটি শনাক্ত করেছিলেন এবং মুসলিমদের এখানে দীর্ঘ সময় অবস্থানের জন্য সতর্ক করেছিলেন। ২০১৯ সাল থেকে সৌদি সরকার এই অঞ্চলে পর্যটন উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসছেন।
মাদাইন সালেহ ভ্রমণের প্রস্তুতি ও টিকিট ব্যবস্থা
মাদাইন সালেহ পরিদর্শনের জন্য আগের দিন টিকিট বুকিং বাধ্যতামূলক। টিকিটের মূল্য বর্তমানে ৯৫ সৌদি রিয়াল, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩০০০ টাকা সমান। অনলাইনে টিকিট কেনার সময় অতিরিক্ত মূল্য দাবি হতে পারে, তাই স্থানীয় কাউন্টার থেকে বুকিং করাই নিরাপদ।
পর্যটকরা প্রথমে উইন্টার পার্কে যান, যেখানে বাসে করে হেগরা বা মাদাইন সালেহ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়। বাসটি আধুনিক এবং পর্যটকদের জন্য আরামদায়ক।
সামুদ জাতির গজব ও নবীর সতর্কবার্তা
সামুদ জাতি আল্লাহর নবী হযরত সালেহ আলাইহি সালামের আহ্বানে ঈমান আনেনি। তারা গর্ব করত প্রাচুর্য ও শক্তিতে, নবীর প্রতি অবিশ্বাস প্রদর্শন করত। তারা নবীকে প্রমাণ দেখাতে চেয়েছিল, এবং আল্লাহর অনুগ্রহে একটি গর্ভবতী উট পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসে। এই অলৌকিক ঘটনা দেখে কিছু লোক ঈমান আনলেও, সমাজপতিদের বাধায় অধিকাংশই অবিশ্বাসেই রয়ে যায়।
উটটির জন্য আল্লাহর নির্দেশমতো পানি পান করার নিয়ম ছিল, যা তারা লঙ্ঘন করে উটটি হত্যা করে। এর পর আল্লাহর গজব নেমে তাদের ধ্বংস করে দেয়, যা পবিত্র কোরআনে সূরা আরাফে বর্ণিত।
মাদাইন সালেহর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ
মাদাইন সালেহতে নাবাতিয়ান জাতির স্থাপত্যশৈলী স্পষ্টভাবে দেখা যায়। জাবাল ইথলিব পাহাড়ের কাছে নাবাতিয়ানদের তৈরি হলরুম রয়েছে, যেখানে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনা করত। এই হলরুমটি পাহাড় কেটে গুহার মতো তৈরি করা হয়েছে এবং শব্দ পরিবহণের দিক থেকে অনন্য।
এছাড়াও বিভিন্ন উপাসনালয় ও ধর্মীয় প্রতীক খোদাই করা হয়েছে। নাবাতিয়ানরা একাধিক স্রষ্টায় বিশ্বাস করত এবং বিভিন্ন ভাস্কর্যে ইগলকে তাদের স্রষ্টার প্রতীক হিসেবে সম্মান করত।
জাবাল আল বানাত বা কসর আল বিন্ত পাহাড়ে ৩১টি পারিবারিক সমাধি রয়েছে, যেখানে নারীদের সমাধি বেশি থাকায় এটিকে ‘নারীর প্রাসাদ’ বলা হয়। এই সমাধিগুলো গ্রিক ও রোমান স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব বহন করে। এখানে সমাধিগুলোর গঠন সামাজিক মর্যাদা অনুসারে ভিন্ন ছিল।
কাসর আল ফরিদ: মাদাইন সালেহর আইকনিক নিদর্শন
কাসর আল ফরিদ মাদাইন সালেহর সবচেয়ে পরিচিত সমাধি সৌধ। এটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যা গজব নেমে আসার আগের সময়ের কাজ অসমাপ্ত থাকার ইঙ্গিত। এই সমাধিতে নামাতিয়ান সমাজের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দেহ সমাহিত রয়েছে। এর বিশালতা ও স্থাপত্য শিল্প পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
পর্যটন ও বর্তমান অবস্থা
২০১৯ সাল থেকে সৌদি সরকার মাদাইন সালেহকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নত করতে শুরু করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টের আয়োজন করা হয়, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। যদিও নবীজির সতর্কবার্তা ছিল এই স্থান দ্রুত অতিক্রমের, ইসলামিক স্কলাররা মনে করেন অল্প সময়ের জন্য শিক্ষা ও ইতিহাস জানতে আসা অনুমোদনযোগ্য।
আলুলা শহরে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে, যেমন ক্যাফে, ডিজিটাল প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং স্থানীয় গাইডের সেবা। পর্যটকরা এখানে এসে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখে মুগ্ধ হন, যা তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
মাদাইন সালেহ ভ্রমণের স্মৃতি ও শিক্ষা
মাদাইন সালেহ ভ্রমণ শুধুমাত্র একটি পর্যটন কার্যক্রম নয়, এটি একটি ইতিহাসের সাক্ষাৎ, যেখানে প্রাচীন সভ্যতার গর্ব, তাদের পতন এবং আল্লাহর ন্যায়বিচার স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে এসে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, পাহাড় কাটা প্রাসাদ ও সমাধি সৌধ দেখে যেকোনো মানুষের মুগ্ধতা ও ভাবনার জাগরণ ঘটে।
এছাড়াও, এখানে মৃতদের প্রতি সম্মান, তাদের কবরের সিস্টেম, এবং তাদের সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসের নানা দিক সম্পর্কে ধারণা লাভ হয়। এই স্থানটি ইতিহাস ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য এক অনন্য গন্তব্য।
মাদাইন সালেহ বা হেগরা প্রাচীন সামুদ জাতির ইতিহাস ও সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। এখানে এসে আমরা দেখতে পাই কিভাবে তাদের মেধা, স্থাপত্যশিল্প, এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সময়ের পরেও টিকে আছে। তাদের অবাধ্যতা ও গজবের গল্প আমাদের সতর্ক করে যে আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে তার ফল ভয়াবহ হতে পারে।
বর্তমানে সৌদি আরবের উদ্যোগে এই স্থানটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে, যা ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মাদাইন সালেহ ভ্রমণ আমাদের অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি গর্ব অনুভব করায়।
যারা ওমরাহর পাশাপাশি সৌদি আরবের ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরতে চান, তারা বিশ্বস্ত ট্রাভেল এজেন্সি চলঘুড়ি এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তারা থাকার ব্যবস্থা, খাবার ও সাইডসিংসহ সবকিছু কম খরচে করে দেয়।
মাদাইন সালেহর এই ভ্রমণ স্মৃতি আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। আশা করি এই নিবন্ধ পড়ে আপনাদেরও এই গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে ভালো ধারণা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এই স্থানটি পরিদর্শনের আগ্রহ তৈরি হবে।