কোরবানির ফজিলত ও শরিকের বিধান
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে কুরবানী
কুরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা ঈদুল আযহার সময় আদায় করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং তাকওয়া অর্জন। কুরবানি শব্দটি আরবি "কুরবুন" শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো নিকটবর্তী হওয়া বা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।
কুরবানি কী? কুরবানির ফজিলত কী? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের উত্তরে সুস্পষ্ট ও সুন্দর জবাব দিয়েছেন। যে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহু। কী আছে সেই হাদিসের বর্ণনায়?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, ‘(কুরবানির জন্তুর) প্রতিটি লোমের পরিবর্তে (একটি করে) নেকি রয়েছে।’
তাঁরা আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, পশম বিশিষ্ট পশুর বেলায় কি হবে? (পশুরতো পশম অনেক বেশি)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তেও একটি করে নেকি রয়েছে। (মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার আশায় জিলহজ মাসের ১০-১২ তারিখ উট, গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া জবেহ করাই হলো কুরবানি। আর এ পশুর পশম যতবেশিই হোক না কেন, প্রতিট পশমের বিনিময়ে রয়েছে একটি করে সাওয়াব।
কুরবানির ইতিহাস
পৃথিবীর ইতিহাসে হযরত আদম আ. এর দুই পুত্রের কুরবানির মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর কুরবানি সূচনা হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর তাদের একজন থেকে গ্রহণ করা হল, আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হল না।
সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন’। (সূরা মায়েদা-২৭) যদি তুমি আমার প্রতি তোমার হাত প্রসারিত কর আমাকে হত্যা করার জন্য, আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য আমার হাত তোমার প্রতি প্রসারিত করব না। নিশ্চয় আমি সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহকে ভয় করি’। (সূরা মায়েদা-২৮)
কুরবানির সূচনা হয় ইব্রাহিম (আঃ) ও তার পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে। আল্লাহ ইব্রাহিম (আঃ)-কে স্বপ্নে আদেশ করেন যেন তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে কুরবানি দেন। পিতা-পুত্র উভয়েই আল্লাহর আদেশ মান্য করে প্রস্তুতি নেন। আল্লাহ তা'আলা তাদের এই আত্মত্যাগের পরীক্ষা সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ইসমাঈলের পরিবর্তে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনার স্মরণেই আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ কুরবানি করে আসছে।
কুরবানির ফজিলত ও গুরুত্ব
কুরবানীর ফযীলতউম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কুরবানীর দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কুরবানী করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কুরবানীকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কুরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী কর। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৪৯৩)
সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এই ইবাদত পালন করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর ধমকি এসেছে,
আল্লাহ তাআলা বলেন:
"তাদের মাংস ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।"
(সূরা হজ্জ: ৩৭)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন:
“আদম সন্তানের কোনো কাজ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কুরবানির চেয়ে অধিক প্রিয় হবে না।”
(তিরমিযী)
অন্য হাদীসে আছে:
“যে ব্যক্তি কুরবানির সামর্থ্য রাখে কিন্তু কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকট না আসে।”
(ইবনে মাজাহ)
হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ বছর মদিনায় অবস্থান করেছেন। মদিনায় অবস্থানকালীন প্রত্যেক বছরেই কুরবানি করেছেন।
(মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ (ও সুন্দর) দুই শিং বিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত (মেটে বা ছাই) রঙের দুইটি দুম্বা কুরবানি করেছেন।
(বুখারি, মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো বছর কুরবানি থেকে বিতর থাকেননি। তিনি কর্মে দ্বারা যেমন কুরবানি করতে অনুপ্রাণিত করেছেন আবার বক্তব্য দিয়ে কুরবানির প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। হাদিসে এসেছে-
যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাজের আগে (পশু) জবেহ করে সে নিজের জন্য জবেহ করে। আর যে নামাজের পর জবেহ করে তার কুরবানি সিদ্ধ হয় এবং সে মুসলমানদের তরিকার অনুসারী হয়।
(বুখারি)
সামর্থ্যবানদের মধ্যে যারা কুরবানি করে না, তাদের প্রতি তিনি এভাবে হুশিয়ারী করেছেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের ধারে-কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহামদ, ইবনে মাজাহ, মুসতাদরেকে হাকেম)
কুরবানীর বিধান
শরীয়তের দৃষ্টিতে কুরবানি দেওয়া ওয়াজিব সেই সকল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের ওপর, যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। অর্থাৎ, যাদের কাছে ঈদুল আযহার দিন ও তিন পরবর্তী দিনে (১০-১২ যিলহজ) যাকাতযোগ্য সম্পদ বা মূল্যমান থাকে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে।
পুরুষ ও নারীদের ক্ষেত্রে একই বিধান প্রযোজ্য। ফকির-মিসকিন বা গরিবদের ওপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তবে সামর্থ্য থাকলে তাদের জন্যও কুরবানি করায় অনেক ফজিলত রয়েছে।
কুরবানীর উদ্দেশ্য :
কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। যাতে মানুষ এটা উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ্র বিশেষ অনুগ্রহের কারণেই শক্তিশালী পশুগুলি তাদের মত দুর্বলদের অনুগত হয়েছে এবং তাদের গোশত, হাড়-হাড্ডি-মজ্জা ইত্যাদির মধ্যে তাদের জন্য রূযী নির্ধারিত হয়েছে। জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিলের অসীলা হিসাবে তাদের মূর্তির নামে কুরবানী করত। অতঃপর তার গোশতের কিছু অংশ মূর্তিগুলির মাথায় রাখত ও তার উপরে কিছু রক্ত ছিটিয়ে দিত। কেউবা উক্ত রক্ত কা‘বা গৃহের দেওয়ালে লেপন করত। মুসলমানদের কেউ কেউ অনুরূপ করার চিন্তা করলে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।[6] আল্লাহ বলেন,
অর্থঃ ‘কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহ্র নিকটে পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকটে পৌঁছে কেবলমাত্র তোমাদের ‘তাক্বওয়া’ বা আল্লাহভীতি’ (হজ্জ ২২/৩৭)।
কুরবানির প্রয়োজনীয় মাসায়েল
জীবজন্তুর ধরণ: কুরবানির জন্য গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে। যেমন, গরু কমপক্ষে দুই বছর পূর্ণ হতে হবে, ছাগল এক বছর পূর্ণ হতে হবে।
অঙ্গহানিজনিত ত্রুটি: যে পশুর একটি চোখ অন্ধ, খোঁড়া বা অতিরিক্ত অসুস্থ, তা কুরবানির উপযোগী নয়।
নিয়ত করা: কুরবানির পশু জবাই করার সময় “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” বলে জবাই করতে হবে এবং নিয়ত থাকতে হবে যে এটা কুরবানির জন্য।
কুরবানিতে শরিকের বিধান
১. ছাগল, ভেড়া, দুম্বায় একজনের বেশি শরিক হয়ে কোরবানি করা যায় না। এগুলো একটা একজনের নামেই কোরবানি দিতে হবে।
২. একটা গরু, মহিষ, উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারে।
৩. যে ব্যক্তি খাঁটি অন্তরে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নয়, বরং গোশত খাওয়া বা লোকদেখানো ইত্যাদি নিয়তে কোরবানি করে, তাকে অংশীদার বানিয়ে কোরবানি করলে সকল অংশীদারের কোরবানিই নষ্ট হয়ে যাবে। তাই শরিক নির্বাচনের সময় খুবই সতর্ক থাকা জরুরি।
৪. কোরবানির পশু ক্রয় করার সময় শরিক রাখার ইচ্ছা ছিল না, পরে শরিক নিতে চাইলে ক্রেতা গরিব হলে তা পারবে না, ধনি তথা নেসাবের মালিক হলে পারবে।
৫. যার যাবতীয় উপার্জন বা অধিকাংশ উপার্জন হারাম, তাকে শরিক করে কোরবানি করলে অন্য সকল শরিকের কোরবানি অশুদ্ধ হয়ে যাবে।
৬. নিজের কোরবানিতে পরিবারের মৃত ও জীবিত ব্যক্তিদের নিয়তের মাধ্যমে শরিক করা বৈধ।
৭. মৃত ব্যক্তি জীবিত থাকা অবস্থায় তার পক্ষ থেকে কোরবানি করার ওসিয়ত করে থাকলে ওসিয়ত বাস্তবায়ন করার জন্য মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েয আছে।
গরু ও উটে সাতজন ব্যক্তি শরিক হতে পারেন। তবে শর্ত হলো সকলের নিয়ত আল্লাহর জন্য কুরবানি হওয়া। যদি কারো নিয়ত ভিন্ন হয়, যেমন গোশত পাওয়ার উদ্দেশ্যে, তাহলে সব অংশীদারের কুরবানি বাতিল হয়ে যাবে।
হাদীসে এসেছে:
“উট ও গরুতে সাত জন পর্যন্ত শরিক হতে পারো, কিন্তু সকলের নিয়ত কুরবানি হতে হবে।”
(মুসলিম)
যদি কেউ শরিক হতে চায়, তাহলে পশু কেনার সময়ই তা নির্ধারণ করে নেওয়া উত্তম, এবং পরে বিভ্রান্তি বা ঝগড়ার সম্ভাবনা থাকে না।
কুরবানির মাংস বন্টন
- এক ভাগ নিজের জন্য
- এক ভাগ আত্মীয় ও বন্ধুদের জন্য
- এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের জন্য
তবে সব মাংস দান করা, বা নিজে রেখে খাওয়া জায়েজ আছে। গরিবদের হক অবশ্যই আদায় করতে হবে।
কুরবানি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। এটি কেবল একটি পশু জবাই নয়, বরং আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক। তাই মুসলমানদের উচিত কুরবানি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করে তা আন্তরিকতার সাথে পালন করা। শরিকি কুরবানিতে সতর্কতা অবলম্বন করা, মাসায়েল জানা এবং যথাযথ নিয়তের মাধ্যমে কুরবানি দেওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মহান ইবাদত সঠিকভাবে পালনের তাওফিক দিন।