Breaking News

প্রেয়সী | পার্ট: ৮ | লেখিকা: সুলতানা তমা

চোখেমুখে পানির ছিটা পড়তেই শরীর কেঁপে উঠলো, আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম, অর্পির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে, হানিফ আর সাজিদ কাঁদছে।
অর্পি: এইতো সেন্স ফিরেছে।
সাজিদ: কি হয়েছে তোর?
আমি: তেমন কিছুনা হঠাৎ বুকে ব্যথা ধরলো আর চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে আসলো।
হানিফ: হবে না? আরো বেশি করে টেনশন কর। খুব তো বলিস সবকিছু ভুলে গেছিস তাহলে আজ এমন হলো কেন?
আমি: আসলে অনেক দিন পর সাজিদকে দেখে সবকিছু মনে পড়ে গেল।
সাজিদ: সব দোষ তোর, কেন নিয়ে আসতে গেলি ওকে?
হানিফ: নাহলে ও পরে রাগ করতো।
সাজিদ: চল ডক্টর এর কাছে।
আমি: না, আমি ঠিক আছি।
অর্পি: কেমন ঠিক আছেন তাতো দেখতেই পাচ্ছি, চলুন তো ডক্টর এর কাছে। (অর্পির কান্না শুনে উঠে বসে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, আমার জন্য অর্পি কাঁদছে? কিন্তু কেন? সাজিদ অর্পির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে ওকে ধাক্কা দিলাম)
সাজিদ: অর্পিতা রায়? তোর বউ?
আমি: হুম। কিন্তু তুই জানলি কিভাবে?
হানিফ: আমি সব বলেছি।
সাজিদ: এখন বাসায় যা।
আমি: তুই যাবি না?
সাজিদ: না।
আমি: সাজিদ ঠিক হচ্ছে না কিন্তু… (উঠে দাঁড়াতে চাইলাম কিন্তু দাঁড়াতে পারলাম না, পড়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু একদিক থেকে সাজিদ আর অন্যদিক থেকে অর্পি আমাকে ধরে ফেললো। সাজিদ অর্পিকে বারবার অবাক হয়ে দেখছে শুধু)
হানিফ: দেখছিস তো ওর কি অবস্থা হয়েছে? তুই সাথে যা নাহলে অর্পিতা একা ওকে সামলাতে পারবে না। আমাকে বাসায় যেতে হবে, তাছাড়া আমার মনে হয় তোর আয়াসদের বাসাতেই থাকা উচিত।
সাজিদ: হুম যাচ্ছি।
গাড়ি বাসার দিকে যাচ্ছে, আমি অর্পির কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছি। সাজিদ সামনের সিটে বসেছে আর বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। সাজিদকে যতো দেখছি ততোই সবকিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। ভিতরটা একদম দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, ভিতরে যেন ঝড় বইছে আমার। কেন সেদিন এমন হয়েছিল? সেদিন এমন নাহলে তো আজ…
অর্পি: আয়াস আপনার কি খারাপ লাগছে?
সাজিদ: কি হয়েছে আয়াস?
আমি: কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি চিন্তা করিস না।
অর্পি: একটা কথা বলবো?
আমি: বলো।
অর্পি: উনাকে দেখে আপনি কাঁদছিলেন কেন? এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলেন, আমি তখন না ধরলে তো আপনার মাথায় আঘাত পেতেন।
আমি: (নিশ্চুপ)
অর্পি: আমি লক্ষ করেছি আপনি মাঝেমাঝে কেমন যেন উন্মাদ হয়ে যান পাগলামো করেন, কান্নাকাটি করেন। কিন্তু কেন? কিসের এতো কষ্ট আপনার মনে?
আমি: বলবো একদিন সব সময় করে।
অর্পি: ঠিক আছে।
চোখ বন্ধ করলাম, কষ্ট তো হবেই। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার চেয়ে বড় কষ্ট যে এই পৃথিবীতে আর নেই। খুব ভালবাসতাম যে পাগলীটাকে, ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে আমার থেকে অনেক দূরে। বড্ড অভিমানী ছিল পাগলীটা, অভিমান করে অনেক দূরে চলে গেছে আমার থেকে। পাগলীটার স্মৃতি গুলো বড্ড যন্ত্রণা দেয় আমাকে, একটু বেশিই পাগলামি করতো পাগলীটা।
দরজায় কলিংবেল চাপতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলেন, সাজিদকে দেখে আম্মু বোবার মতো ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। জানি সবাই অবাক হবে ওকে দেখে, কেউ কেউ তো রাগও করবে।
সাজিদ: আন্টি! সাজিদ আম্মুকে সালাম করতে যাচ্ছিল আম্মু ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন সাজিদ: কাঁদছেন কেন? এসেছি তো।
আম্মু: এতদিন পর? তিন বছর হতে চলল।
সাজিদ: আসতে তো মন চায় কিন্তু… (সাজিদ আমার দিকে তাকালো, আমি চুপচাপ রুমের দিকে পা বাড়ালাম)
আম্মু: অর্পিতা আয়াসকে রুমে দিয়ে এসো, দেখে মনে হচ্ছে ওর শরীর ঠিক নেই।
অর্পি: ঠিক আছে আন্টি।
অর্পি এসে আমাকে ধরে ধরে রুমের দিকে নিয়ে আসলো।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছি, অর্পি আমার গায়ে বিছানাটা টেনে দিয়ে আমার পাশে বসলো।
আমি: কিছু বলবে?
অর্পি: হুম।
আমি: কি?
অর্পি: সরি!
আমি: কেন?
অর্পি: এয়ারপোর্টে তখন আপনাকে রাগ দেখানোর জন্য। এখন কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি আপনার মনে কোথাও একটা খুব কষ্ট জমে আছে যা আপনার বন্ধু সাজিদের সাথে সম্পর্কিত, আর তাইতো আপনি উনার জন্য এভাবে ছুটে এসেছেন।
আমি: (নিশ্চুপ)
অর্পি: আসছি। (অর্পি চলে যেতেই আম্মু এসে রুমে ঢুকলেন)
আম্মু: সাজিদ আমাকে সব বলেছে, এখন ঠিক আছিস তো?
আমি: হ্যাঁ, বসো।
আম্মু: সাজিদ হঠাৎ…
আমি: ভালোই হয়েছে এসেছে, আর কতো? তিন বছর তো হতে চলল।
আম্মু: আমিও তো সেটাই বলি, আর কতো? তিনবছর হতে চললো এবার তো তোকে নিজেকে সামলে নেওয়া উচিত। সব ভুলে নিজের জীবনটাকে নতুন করে সাজা আয়াস।
আমি: (নিশ্চুপ)
আম্মু: মনে আছে তোর স্বপ্নের সেই মানবীর কথা?
আমি: হুম।
আম্মু: আজ অর্পিতাকে দেখে সেই মানবীর কথা মনে পড়ছে না? (অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম)
আম্মু: একদম তোর স্বপ্নের মানবীর মতোই, কাকতালীয় হলেও আমার মনে হয় তোর স্বপ্নে দেখা সেই মানবী অর্পিতাই।
আমি: কিন্তু এইটা কি করে সম্ভব আম্মু?
আম্মু: হয়তো বিধাতার কোনো খেলা।
আমি: এও কি সম্ভব?
আম্মু: হয়তো। রেস্ট নে আসছি আমি।
আম্মু চলে গেলেন কিন্তু কিসব বলে গেলেন? এ কি করে সম্ভব? সত্যিই কি স্বপ্নের সেই মেয়েটা অর্পি? যাকে কখনো দেখিনি সে স্বপ্নে এসে বারবার দেখা দিচ্ছিল আর বাস্তবেও কিনা সেই আমার জীবন সঙ্গী হলো? এইটা কাকতালীয় নাকি নিয়তির খেলা আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। এবার তো মনে হচ্ছে বিধাতাই অর্পিকে আমার জীবনে আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পাঠিয়েছেন কিন্তু কেন? আর অর্পি তো হিন্দু।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি হঠাৎ মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙ্গলো, ঘুম ঘুম চোখে তাকালাম দাদি আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। দূরের চেয়ারটায় সাজিদ মাথা নিচু করে বসে আছে।
দাদি: এখন কেমন আছিস?
আমি: ভালো। সাজিদ কিছু খেয়েছে।
সাজিদ: হ্যাঁ খেয়েছি, আমাকে নিয়ে এতো টেনশন করিস নাতো।
আমি: আমরা ছাড়া তোর কে আছে বলতো টেনশন করার জন্য। একজন যে আছে সেতো আমাদের এখন শত্রু ভাবে, সবকিছুর জন্য নাকি আমি দায়ী।
সাজিদ: (নিশ্চুপ)
আমি: জিসান বা তোর চাচ্চু জানেন তুই যে দেশে এসেছিস?
সাজিদ: না। ওরা সবকিছুর জন্য তোকে দায়ী করলেও আমিতো করছি না, কেন এসব ভেবে কষ্ট পাচ্ছিস? (ওর কথা শুনে ম্লান হাসলাম)
সাজিদ: হাসছিস কেন?
আমি: সত্যিই তো সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। সেদিন যদি আমি…
সাজিদ: আবার শুরু করেছিস?
তনিমা: ভাইয়া আসবো? (তনিমার ডাকে চোখের কোণে আসা পানি তাড়াতাড়ি মুছে নিলাম)
আমি: আয়।
তনিমা: তুমি নাকি অসুস্থ কি হয়েছে?
সাজিদ: তেমন কিছুনা।
তনিমা: সাজিদ ভাইয়া তুমি কখন এলে?
সাজিদ: আমি এসেই তো আয়াসের এই অবস্থা করলাম।
তনিমা: বুঝতে পেরেছি।
আমি: ঘোড়ার ডিম বুঝেছিস, যা এখান থেকে।
তনিমা: রাগ দেখালেই তো সব শেষ হয়ে যায় না। ভুলে যাও ভাইয়া সব, যে এখন তোমার জীবনে আছে তাকে ভালোবাস তাকে নিয়েই বাকি জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখো।
আমি: খুব পেকে গেছিস, যাবি তুই? (তনিমা চলে যেতেই সাজিদ এসে আমার পাশে বসলো, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম)
আমি: কি?
সাজিদ: ভালোবাসিস?
আমি: কাকে?
সাজিদ: অর্পিতাকে।
আমি: কি বলছিস এসব তুই? এ কখনো সম্ভব নাকি?
সাজিদ: কেন সম্ভব নয়? তাছাড়া তোদের তো বিয়ে হয়েছে।
আমি: বিয়েটা হয়নি কারণ অর্পি হিন্দু। আর আমি কাউকে নতুন করে ভালবাসতে পারবো না।
সাজিদ: পারবি না মানে? ভালোবেসে ফেলেছিস তো।
আমি: মানে?
সাজিদ: আমি তোর চোখে অর্পিতার জন্য ভালোবাসা দেখেছি।
আমি: ভুল দেখেছিস।
সাজিদ: অর্পিতার চোখেও কিন্তু তোর জন্য…
আমি: ভুল, অর্পি অন্য কাউকে ভালোবাসে।
সাজিদ: হতেও পারে, কিন্তু তুই অর্পিতাকে ভালোবাসিস এইটা মিথ্যে নয়। তুই শুধু নিজে ভালোবাসাটা বুঝতে পারছিস না।
আমি: ভুল করছিস।
সাজিদ: প্রমাণ করে দিবো আমি ভুল নই।
সাজিদ চলে গেল, চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। সত্যি কি আমার চোখে অর্পির জন্য ভালোবাসা আছে? কিন্তু আমিতো অর্পিকে ভালোবাসি না। সাজিদ কেন বলল এসব?
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার আকাশ দেখছিলাম হঠাৎ সাজিদ এসে পাশে দাঁড়ালো।
সাজিদ: চল মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসি।
আমি: হুম।
সাজিদ: একটু ঘুরে আসলে মন হালকা লাগবে।
আমি: চল।
সাজিদ: আর একটা কথা আমি যে এখানে আছি জিসান যেন জানতে না পারে।
আমি: জানলেই তো অশান্তি করবে।
সাজিদ: হুম।
মাগরিবের নামাজ পড়তে দুজন মসজিদের দিকে রওনা হলাম।
নামাজ শেষে রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে বসে আছি। এমন অনেক সন্ধ্যা আসতো আমার জীবনে যে সন্ধ্যায় ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিতাম। আমি সবার সাথে আড্ডা দিতাম বললে ভুল হবে, সবাই আড্ডা দিতো হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতো আর আমিতো আড়চোখে শুধু তাকে দেখতাম, ওর হাসি মুখ দেখে নিজের অজান্তেই মুচকি হাসতাম।
সাজিদ: সেই সন্ধ্যা গুলোর কথা ভাবছিস?
আমি: (নিশ্চুপ)
সাজিদ: তুই কিন্তু চাইলেই সে দিন গুলো ফিরে পেতে পারিস।
আমি: মানে?
সাজিদ: অর্পিতা, ভেবে দেখ…
আমি: অর্পিকে নিয়ে আমি কিছু ভাবতে চাই না।
সাজিদ: নিজের মনের কথা শুন।
আমি: (নিশ্চুপ)
রাত দশটা বাজে, সাজিদ আর আমি বাসার দিকে যাচ্ছি। সাজিদ ফোন টিপছে আর আমি ভাবছি অর্পিকে দুর্জয় ওর কথা বলবো কিভাবে? অর্পি বিশ্বাস করবে তো আমার কথা? দুর্জয় খারাপ, দুর্জয় অর্পিকে ভালোবাসে না এইটা আমি প্রমাণ করবো কিভাবে? মেয়েটা দিনের পর দিন ঠকে যাচ্ছে আর আমি কিছুই করবো না? যেভাবেই হউক দুর্জয় এর আসল চেহারাটা অর্পিকে দেখাতে হবে।
আমি: উহ্! (আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম আর হাটছিলাম হঠাৎ পায়ে কিছু একটা লেগে ব্যথা পেলাম, বসে পড়লাম রাস্তায়)
সাজিদ: দেখে হাটবি না? সবসময় যে কি এত চিন্তা করিস বুঝিনা। (রাস্তার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলাম, সাজিদের দিকে তাকালাম সাজিদের চোখে পানি টলমল করছে)
সাজিদ: চল তো এখান থেকে। (খুব জোড়ে হেসে উঠলাম, আনন্দের হাসি নয় তাচ্ছিল্যের হাসি)
সাজিদ: মারবো এক থাপ্পড়।
আমি: দেখেছিস নিয়তিও আমাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দেয়, সারা রাস্তা হেটে আসলাম কিছু হলো না কিন্তু এখানে এসেই ব্যথা পেতে হলো?
সাজিদ: আয়াস এইটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট।
আমি: এই একই জায়গায়?
সাজিদ: চল তো।
সাজিদ আমাকে টেনে বাসার দিকে নিয়ে আসলো।
ঘড়ির কাটায় রাত দুটো বেজে চব্বিশ মিনিট, ছাদের এক কোণায় বসে আছি আর এক দৃষ্টিতে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আছি। চাঁদের কাছের বড় তারাটা আমার দিকে কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, এই তারাটা কিছু যেন আমায় বলতে চায়। কিন্তু কি বলতে চায়? কেঁপে উঠলাম কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে, পিছন ফিরে দেখি আব্বু।
আব্বু: ঘুমাবি না?
আমি: আসছে না ঘুম। তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?
আব্বু: আমারো ঘুম আসছে না।
আমি: সাজিদকে দেখে?
আব্বু: (নিশ্চুপ)
আমি: আমার না আজ বড্ড বেশি মন খারাপ।
আব্বু: (নিশ্চুপ)
আমি: দিবা?
আব্বু: (নিশ্চুপ)
আমি: তুমি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলে।
আব্বু উঠে চলে যেতে লাগলেন, জানি কিছুক্ষণ পর ফিরে আসবেন আর হাতে থাকবে রক্তমাখা ট্রি-শার্ট।
আব্বু রক্তেমাখা ট্রি-শার্ট’টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে চলে গেলেন। আমি ট্রি-শার্ট বুকে জড়িয়ে ধরে তারাটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছি। এবার মনে হচ্ছে তারাটা হাসছে, হাসবেই তো আমাকে কষ্ট পেতে দেখলে যে ওর আনন্দ হয়।
আমি: খুব মজা তাই না? আমি কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি আর তুমি ওখান থেকে দিব্যি হেসে যাচ্ছ। আমাকে কষ্ট দিতে তোমার এতো ভালো লাগে?
অর্পি: কার সাথে কথা বলছেন? (হঠাৎ অর্পির কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলাম, এতো রাতে ও ছাদে কি করছে?)
আমি: এতো রাতে তুমি এখানে?
অর্পি: আপনি এতো রাতে ছাদে আসতে পারলে আমি কেন পারবো না? (আমার পাশে বসে আমার সামনে কফির মগটা রাখলো, এতো রাতে দু মগ কফি নিয়ে অর্পি ছাদে? আব্বু ওকে পাঠিয়েছেন নাতো?)
অর্পি: আপনি বলেছিলেন সময় করে কিছু কথা বলবেন, আজ কিন্তু অনেক সময় আছে। তারা ভরা আকাশ, চাঁদের আলো আ…
আমি: একটু একা থাকতে চাচ্ছি আমি।
অর্পি: উঁহু হচ্ছে না, একা থাকতে আজ দিবো না।
আমি: (নিশ্চুপ)
অর্পি: আপনি তো সবসময় নামাজ পড়েন, এইযে একটা হিন্দু মেয়ে…
আমি: এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না।
অর্পি: ঠিক আছে। একটা প্রশ্ন তো করতে পারি? আচ্ছা আপনি নামাজ পড়ে কি দোয়া করেন? না মানে বিশেষ কোনো দোয়া তো থাকতেই পারে যেমন আমার আছে, আমি কিন্তু প্রতিদিন পূজা দিয়ে একটাই প্রার্থনা করি।
আমি: (নিশ্চুপ)
অর্পি: কি দোয়া করেন?
আমি: সে যেন জান্নাতে থাকে। (আমার এমন উত্তরের জন্য মনে হয় অর্পি মুটেও প্রস্তুত ছিলনা, এমন উত্তর শুনে ও কেমন যেন বিব্রত হয়ে গেল)
অর্পি: মামামাননে?
আমি: সে যেন জান্নাতে থাকে, আল্লাহ্‌ যেন তাকে জান্নাত দান করেন এই দোয়াই করি নামাজ পড়ে।
অর্পি: সে কে? জানতে পারি? (অর্পি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো, আমি ওর চোখের দিকে শান্তভাবে তাকালাম)
আমি: ইরা।
অর্পি: ইরা?
আমি: আমার ভালোবাসা। বড্ড অভিমানী ছিল পাগলীটা, সবসময় হুটহাট অভিমান করে ফেলতো। একদিন এতটাই অভিমান করল যে আমার থেকে এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে গেল। অনেক চেষ্টা করেছিলাম পাগলীটার অভিমান ভাঙ্গাতে কিন্তু তা কি আর সম্ভব? একবার এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে যে আর ফিরে আসা যায় না।
অর্পি: কি করে মারা গেল ও?
আমি: এক্সিডেন্ট।
অর্পি: (নিশ্চুপ)
আমি: সাজিদ.. সাজিদ ইরার ভাই।
অর্পি: এজন্যই উনাকে দেখে আপনি…
আমি: সাজিদ আর ইরা ছিল জমজ ভাই বোন, দুজনের মুখের গঠন কিছুটা একরকম। আর তাইতো সাজিদ আমার চোখের সামনে থাকলে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারিনা।
অর্পি: কবে মারা গেছে ইরা?
আমি: তিন বছর হতে চললো।
অর্পি: খুব ভালোবাসতেন?
আমি: হুম, এখনো বাসি। জানো তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার মতো যন্ত্রণা আর কিছুতে নেই। খুব কষ্ট হয়, ইরার রক্তমাখা মুখ বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
অর্পি: বাঁচানোর কোনো উপায় ছিলনা?
আমি: যেতে দিতাম নাকি ওকে উপায় থাকলে? আমার উপর রাগ করে পাগলের মতো ড্রাইভ করছিল, আমি বাইক নিয়ে পিছন থেকে বারবার ডাকছিলাম, ভয় হচ্ছিল কখন জানি এক্সিডেন্ট করে ফেলে। আর আমার ভয়টাই সত্যি হলো, হঠাৎ কোথা থেকে একটা ট্রাক এসে ইরার গাড়ি একদম দুমড়ে মুছড়ে দিলো। আমি দূর থেকে দেখছিলাম রক্তে রাস্তাটা একদম ভেসে গেছে, ইরা হাত বাড়িয়ে আমাকে কাছে ডাকছিল। ইরার কাছে যেতেই আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো, ওর মাথাটা একদম তেতলে গিয়েছিল, একটা পা কেটে আলাদা পড়েছিল, মুখটা রক্তে মেখে গিয়েছিল একদম। ইরাকে কোলে তুলে গাড়িতে তুলবো তখনি…
অর্পি: (নিশ্চুপ)
আমি: তখনি ও আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়। এতটাই অভিমান করেছিল যে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ টুকুও দেয়নি। ইরাকে বুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম, বারবার বলেছিলাম ওর সব কথা শুনবো ওকে আর অভিমান করার সুযোগ দিবো না তবুও পাগলীটা ফিরে আসলো না। (অর্পি নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছে, আমার চোখের পানি টুপটুপ করে ট্রি-শার্টে পড়ছে আর শার্টে লেগে থাকা রক্ত গুলো যেন একটু একটু করে তাজা হয়ে উঠছে)
অর্পি: ইরা খুব ভাগ্যবতী, মারা গেছে তবুও আপনি ওকে ভুলে যাননি, এখনো ঠিক আগের মতোই ভালোবাসেন। খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ইরাকে। (অর্পির কথা শুনে বেশ জোড়েই হেসে উঠলাম)
আমি: কি করে দেখবে আমি নিজেই তো ওকে দেখিনা তিন বছর হতে চললো।
অর্পি: ইরার কোনো ছবি নেই?
আমি: ইরাকে দাফন করার পর আমি অজ্ঞান হয়ে ওর কবরের উপর পরে গিয়েছিলাম। তারপর চারমাস আমাকে হসপিটালে থাকতে হয়েছিল। এতটাই আঘাত পেয়েছিলাম যে দুমাস আমি কোমায় ছিলাম। ফিরে এসে আমি ইরার জিনিসপত্র নিয়ে পাগলামি করবো তাই ইরার সব জিনিস ওরা পুড়িয়ে ফেলেছিল সাথে ইরার ছবি গুলোও। অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের ছবি ছিল ইরা আর আমার, সব শেষ করে দিয়েছে ওরা।
অর্পি: কত দিনের সম্পর্ক ছিল আপনাদের?
আমি: পনেরো বছর। (আমার কথা শুনে অর্পি বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো)
অর্পি: পনেরো বছর?
আমি: হুম। যখন ভালোবাসা কি বুঝতাম না তখন থেকেই ইরাকে আমার ভালো লাগতো। আর এই ভালো লাগা যে কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেল দুজনের কেউই ঠের পেলাম না।
অর্পি: (নিশ্চুপ)
আমি: চলো।
অর্পি: কোথায়?
অর্পিকে টেনে ছাদের কিনারায় নিয়ে আসলাম। আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে রাস্তা দেখালাম।
আমি: ওইযে ল্যাম্পপোস্ট’টা জ্বলছে এইটার ঠিক দুহাত দূরেই আমার ইরা এক্সিডেন্ট করেছিল। এই জায়গাটাই আমার থেকে আমার ইরাকে কেড়ে নিয়েছে। জানো তো আজকেও আমি ঠিক এই জায়গাটায় পায়ে ব্যথা পেয়েছি। নিয়তিও আমার সাথে মজা করে।
শার্ট বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লাম। তারা’টার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছি, আমার ইরা তারা হয়ে আমার কান্না দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। আমি চিৎকার করে কাঁদছি আর ভাবছি ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার মধ্যে এত যন্ত্রণা কেন…
চলবে?

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com